(রয়টার্সের চুক্তিভিত্তিক ফটোগ্রাফার ভ্যালেরি জিঙ্ক তার তোলা বিভিন্ন ছবির জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। সম্প্রতি তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে চাকরি ছাড়লেন রয়টার্সের। কেন? eআরকির পাঠকদের জন্য সেটা বোঝার জন্য তুলে ধরা হলো ইংরেজি স্ট্যাটাসটির বাংলা অনুবাদ।)
গত আট বছর ধরে আমি রয়টার্সের সাথে চুক্তিভিত্তিক কাজ করে আসছি। আমার তোলা প্রেইরি প্রভিন্সের ছবিগুলো নিউইয়র্ক টাইমস, আল-জাজিরাসহ আরও অন্যান্য আউটলেটগুলো নর্থ-আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপসহ আরও অন্যসব জায়গায় প্রকাশ করেছে। এই মুহূর্তে রয়টার্সের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে, কারণ গাজায় ২৪৫ জন সাংবাদিকের সুনিয়ন্ত্রিত হত্যাযজ্ঞকে সংগঠিত করা ও তাকে ন্যায়সঙ্গত করে তোলার ক্ষেত্রে রয়টার্স ভূমিকা রেখেছে। ফিলিস্তিনে আমার সহকর্মীদের প্রতি অন্তত এতটুকু ঋণ তো আছেই, কিংবা চেয়েও অনেক বেশি।
১০ আগস্ট গাজা সিটিতে আল-জাজিরার পুরো টিমসহ আনাস আল-শরীফকে ইসরায়েল হত্যা করলে, রয়টার্স ইসরায়েলের একটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন দাবি, যে আল-শরীফ হামাসের সদস্য, তা প্রচার করে। ইজরায়েলের এমন অসংখ্য মিথ্যা দাবির মধ্যে এটাও একটা, যা রয়টার্সের মতো সংবাদমাধ্যম বারবার সত্য বলে প্রচার করেছে এবং এসবের বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েলের মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রয়টার্সের এমন আগ্রহ তাদের নিজেদের সাংবাদিকদেরকেও ইসরায়েলের গণহত্যা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আজ সকালে নাসের হাসপাতালে চালানো আরেক হামলায় রয়টার্সের ক্যামেরাপার্সন হোসাম আল-মাসরিসহ আরও পাঁচজন সাংবাদিক এবং মোট ২০ জন নিহত হয়েছেন। এটি ছিল তথাকথিত ‘ডাবল ট্যাপ’ হামলা, যেখানে ইসরায়েল শুরুতে কোন বেসামরিক স্থাপনা, যেমন স্কুল বা হাসপাতাল, বোমা মারে, তারপর অপেক্ষা করে চিকিৎসাকর্মী, উদ্ধারকারীদল ও সাংবাদিকরা পৌঁছানোর জন্য, এবং শেষে তাদের উপরও হামলা চালায়।
এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য পশ্চিমা গণমাধ্যম সরাসরি দায়ী। ড্রপ সাইট নিউজের জেরেমি স্কাহিল যেমন বলেছেন, প্রত্যেকটা বড় সংবাদমাধ্যম, নিউইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন পোস্ট, এপি থেকে রয়টার্স, সবাই ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডার বাহক হিসেবে কাজ করছে। তারা যেমন যুদ্ধাপরাধকে বৈধতা দিয়েছে তেমনি ভুক্তভোগীদের জীবনচক্র অমানবিক করে তুলেছে। তারা যেমন তাদের নিজেদের সহকর্মীদের ত্যাগ করেছে তেমনি তারা যে সত্যনিষ্ঠ ও নৈতিক সাংবাদিকতার প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বলে সেটার সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
এরা ইসরায়েলের গণহত্যা নিয়ে মিথ্যাচারগুলিকে কোনো যাচাই ছাড়াই বারবার প্রচার করে, অর্থাৎ সাংবাদিকতার সবচেয়ে মৌলিক যে দায়িত্ব সেটাকেই তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে মাত্র দুই বছরে একটা ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে যত সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তার সম্মিলিত সংখ্যা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, যুগোস্লাভিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধে নিহত সাংবাদিকদের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া পুরো একটি জাতিকে না খাইয়ে মারা, তাদের শিশুদের হত্যা করা এবং মানুষকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে ফেলার মতো ঘটনা তো আছেই।আনাস আল-শরীফের কাজ রয়টার্সের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার এনে দিয়েছিল, এরপরও ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী যখন তাকে হামাস ও ইসলামিক জিহাদ যোদ্ধা বলে সাংবাদিকদের হিটলিস্টে অন্তর্ভুক্ত করল, তখন তারা আনাসের পক্ষে দাঁড়ায়নি। ক্রমশ বাড়তে থাকা দুর্ভিক্ষ নিয়ে করা একটা রিপোর্টের জেরে যখন আনসকে ইজরায়েলি বাহিনী হত্যা করার হুমকি দেয়, তখন আনাস আন্তর্জাতিক এক মিডিয়ায় নিজের নিরাপত্তার দাবি জানায়, তখনও রয়টার্স তার পাশে দাঁড়ায়নি। এমনকি মৃত্যূর পর মৃত্যুর সংবাদটাও তারা প্রকাশ করে নিজেদের মতো বানিয়ে।
গত আট বছরে রয়টার্সের জন্য আমি যে কাজগুলো করেছি, তা আমি সবসময় মূল্যায়ন করেছি, কিন্তু এখন আমি এই প্রেস পাসটা বহন করার কথা চিন্তা করলে কেবল গভীর লজ্জা ও শোক ছাড়া কল্পনা করতে পারি না। আমি জানি না কীভাবে গাজার সাংবাদিকদের, এখন পর্যন্ত যারা পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে সাহসী ও সেরা সাংবাদিক, সাহস এবং আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে পারি? সামনে আমি আমার দ্বারা যেভাবে সম্ভব সেভাবে কিছু একটা করার কথা মাথায় রেখে কাজ করব।
পাঠকের মন্তব্য