মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে প্রশিক্ষণরত যুদ্ধবিমান আঘাত হানার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যুবলীগ এলাকাটা ঘিরে ফেলতো। কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগ তাদের প্রতিহত করতো। কেবল ব্যারিস্টার সুমনকে দেখা যেতো স্কুল মাঠে বুক থাবড়ে বিলাপ করছে, পুলের (ফুলের) মতো শিশুদের হারালাম।
একাত্তর টিভিতে টিকার চলতো, স্কুল ছুটির পরে এই দুর্ঘটনা; ফলে ক্ষয়ক্ষতি কম।
সুলাইমান সুখন বর্ণনা করতো, নিউইয়র্কে প্রশিক্ষণরত বিমান ভেঙ্গে পড়ে কি করে ১৩৪ জন মারা গিয়েছিলো। জনপদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এয়ারফোর্সের কি প্রয়োজনীয়তা।
সময় টিভি শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্তলাল সেনকে ঘিরে ধরতো। উনি কপালের ঘাম মুছে বলতেন, আজ আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী নই; নেহাত ডাক্তার। জীবন বাঁচাতে ছুটে এসেছি।
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে অপু উকিল কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেলে নিউজ টোয়েন্টি ফোরে ব্রেকিং নিউজ আসতো, ঘটনাস্থলে অপু উকিল অজ্ঞান। অমনি আরো বাইশটি টিভি সে ব্রেকিং নিউজ দিতো।
শিবব্রত দাদা তখন ফেসবুকে বর্ণনা করতো অপুদিদির মানব হিতৈষী কার্যক্রমের ফিরিস্তি। ললিতা দিদি ও আনারকলি আপা, প্রেইং ফর মাইলস্টোন এবং অপু দিদি লিখে পাশে থাকতো। সহমত ভাই তখন মাইলস্টোন ও অপু উকিলের মাঝে কান্না বন্টন করতো।
সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান আশফাক একাত্তরের সংবাদ সংযোগে যুদ্ধ বিমান আছড়ে পড়ার টেকনিক্যালিটিজ বর্ণনা করতেন।
হঠাত ব্রেকিং নিউজ আসতো মির্জা আজমের ভাগ্নে মাইলস্টোন কলেজে পড়তো। লাইভে মাঠের মধ্যে বসে মির্জা আজমের বিলাপের দৃশ্য নিয়ে হাজির হতো সময় টিভি।
ছাত্র-ছাত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে শিক্ষিকার মৃত্যুর খবর বর্ণনা করতে গিয়ে তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার বীরত্বগাথা উঠে আসতো।
ফেসবুকে মুক্তিযোদ্ধা গবেষক সেই স্টোরি শেয়ার করে বলতো, মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে মুক্তিযোদ্ধাই হয়।
তারেক সিদ্দিক ব্যবস্থা করতেন, তার ঘনিষ্ট মাইলস্টোনের মালিককে ক্যামেরার সামনে গ্রেফতার করে এরপর সিএমএইচ-এর ভি আইপি কেবিনে রাখা হবে।
বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছাকাছি স্কুল ও কলেজ নির্মাণের দায়ে এর মালিককে গ্রেফতার দৃশ্য বাইশটি বিটিভিতে চলে এলে সারাদেশ ন্যায়বিচারের সুগন্ধে মৌ মৌ করতো।
দুর্ঘটনা স্থলের ক্ষুদে দোকানি পানির দাম বাড়িয়ে দেয়ায়, রিক্সা ও স্কুটার ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় জাতির বিবেক ফেসবুকে নেমে এসে সবাইকে অসভ্য ইতর ছাপড়ি গালি দিয়ে নিজেকে বড্ডো আর্য জমিদার বংশ হিসেবে জাহির করতো। অথচ ওর গুষ্টির আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে দারিদ্র্যে বিশীর্ণ ক্ষুদে দোকানি, রিক্সা ও অটোরিক্সাচালক দারিদ্র্য রেখার নীচে রয়ে গেছে; পুষ্টি না পেয়ে তাদের মস্তিষ্ক বর্ধিত হয়নি; তা বোঝার কোন প্রয়োজন নেই।
নিহত শিশুদের অন্ততঃ ২৪টি পরিবারকে গণভবনে নিয়ে গেলে শোকের কালো জামদানি পরিহিতা হাসিনা বেরিয়ে আসতেন শোকাহতদের আরো কাঁদাতে। নেপথ্যে সেই একই থিম সং, স্বজন হারানোর বেদনা কি তা আমি বুঝি। এস আলম, দরবেশ দাঁড়িয়ে থাকতো কাঁচু মাচু হয়ে। শোকাহত পরিবারের হাতে চেক তুলে দিতে দিতে হাসিনা কান্নায় আলুথালু হতেন।
ফেসবুকে তখন কান্নার মাতম, মাথার ওপর উনি আছেন বলেই ভরসা পাই।
লোকজন এয়ারফোর্সের সমালোচনায় কথা-বার্তা বলতে শুরু করলে, ২২টি বিটিভিতে আকাশে অতন্দ্র প্রহরী সিরিজের বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হতো।
ভারত থেকে বার্ন সার্জারি টিম এসে পড়লে; গুজরাট, কাশ্মীর, মণিপুরে বার্ন চিকিতসায় তাদের শতভাগ সাফল্যের গল্পে মাতোয়ারা হতো বাংলা ট্রিবিউন, বিবিসি বাংলা ও ডয়চেভেলে বাংলা।
শিবব্রত দাদা এসে টিপ্পনি কাটতো, অহন ভারতরে লাগে কেন? হাট হাজারির ছাগুগুলিরে আইয়া সার্জারি করতে কন। সহমত ভাই চোখ টিপ দিয়ে লিখতো, বুকে আসো দাদা।
শোক প্রকাশ করে মিরপুর স্টেডিয়ামে শুরু হতো বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ। মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে কারো হাতে পাকিস্তানের পতাকা থাকলে তাদের কান ধরে উঠবস করাতো।
সংস্কৃতি মামা ও খালারা প্রেসিডেন্টশিয়াল গ্যালারিতে বসে জাতীয়তাবাদের গভীরতায় নয়ন জলে ভাসতো।
ফেসবুকে বল গুনে গুনে খেলার ধারাবিবরণী আর সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদার রগড়। ললিতাদি ও আনার কলি আপা "এ আরেক মুক্তিযুদ্ধ" শিরোনামে একটার পর একটা স্টেটাস লিখতে থাকতো। মাইলস্টোনের লাশের হিসাব হারিয়ে যেতো ক্রিকেটের রানের হিসাবের নীচে।
খেলায় জিতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ গবেষকেরা ফেসবুকে শুরু করতো মুক্তিযুদ্ধের টুকরো গল্প। পাপন ভাই ঠিকই ফোন করে জায়নামাজে বসা হাসিনাকে জানাতো বিজয় সংবাদ।
সিপি গ্যাং-এর চ-বর্গীয় গালিতে আওয়ামী লীগ সমর্থক বাদে সবাই জামায়াত-বিএনপি-ছাগু-পাকিস্তানপন্থী সেই ন্যারেটিভ দোলা দিতো।
শিবব্রত দাদা এসে বলতো, রাজাকার শিবিরে সুনশান নীরবতা। সহমত ভাই তাকে চোখ টিপ দিয়ে বলতো, বুকে আসো দাদা।
পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে লোকে দেখতো, কোণাবাড়ি আশকোনাতে জঙ্গিদের একটি বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ, রেব ও বিজিবি। জঙ্গি বিশেষজ্ঞ পুলিশ মনিরুল টিভিতে জঙ্গিবাদের ঝুঁকির দিক বর্ণনা করছে। হারুন তার ভাতের হোটেলে কয়েকজন দাড়ি টুপি ওয়ালাকে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
প্রতিটি টিভিতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের লাইভ। মাঝে মাঝে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি আপডেট। আরাফাত আঙ্গুল নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে থাকে, এই জঙ্গিরা ড্রাগড।
নর্থ ইস্ট ওয়েব পোর্টালে চন্দন নন্দী প্রশিক্ষণ বিমানে জঙ্গিরা নীচ থেকে গুলি করে ভূপতিত করেছে ইঙ্গিত দিয়ে ছক কষে দিলে; একাত্তর জার্নালে কচি কলাপাতার মতো নড়ে উঠতো মিথিলা ফারজানা ও মাছুদা ভাট্টির ঠোঁট। শাহরিয়ার কবির জিহাদিরা কি করে দেশটাকে আফঘানিস্তান বানাতে চায় সেই ঝুঁকি তুলে ধরতেন। শ্যামল দত্ত কান চুলকে বলতেন, ১৯৭০ সালের ভোটে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি; তাদের সংখ্যা জ্যামিতিকহারে বেড়েছে। আর আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি তাদের সংখ্যাটা গাণিতিক হারে বেড়েছে। তাই অবস্থাটা এমন ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকি থেকে একমাত্র বাঁচাতে পারেন শেখ হাসিনার সরকার; তাই নির্বাচন টির্বাচন বুঝিনা; তাকে বারবার দরকার।
মাইলস্টোন ততক্ষণে বিস্মৃত; মেট্রোরেল ছিলো বলে শিশুদের সময় মতো বার্ন ইউনিটে নেয়া গেছে; জয় শেখ হাসিনার জয় বয়ানের কাঁধে চেপে আওয়ামী লীগ তখন প্রগতিশীলতার ফুলকে বাঁচাতে কোণাবাড়িতে যুদ্ধ করতে থাকতো। শিবব্রত দাদা তখন হ্যাশ ট্যাগ মেরে দিতো, আমার মাটি আমার মা, পাকিস্তান হবে না।
পাঠকের মন্তব্য