লেখা: ড. লুবনা ফেরদৌসী (লুবনা তুরীন)
ইসহাক দারের দাবি যে শিমলা চুক্তি ও মুশাররফের সফরে ৭১ এর গণহত্যার সমাধান হয়ে গেছে, সেটা ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড়ানো এক politically convenient fabrication, ইতিহাসগতভাবেও ভুল, আইনি দিক থেকেও অসংগত, সেই সাথে এইটা রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, এবং ভিকটিমদের প্রতি নির্লজ্জ অমানবিকতা।।
কারণ...................
১. শিমলা চুক্তি (১৯৭২)
প্রথমেই মনে রাখা দরকার, শিমলা চুক্তি (১৯৭২) ছিল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমিত এক সমঝোতা। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধোত্তর সীমান্ত ইস্যু, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ ইত্যাদি। বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র যদি তৃতীয় রাষ্ট্রের হয়ে চুক্তি করে, সেটি বৈধ নয় (Vienna Convention on the Law of Treaties, 1969 অনুযায়ী ‘pacta tertiis nec nocent nec prosunt’, কোনো চুক্তি তৃতীয় পক্ষের জন্য দায়বদ্ধ নয়)। গণহত্যার ভিকটিম বাংলাদেশ সেখানে অনুপস্থিত থাকায়, শিমলা চুক্তিকে গণহত্যার ‘সমাধান’ বলা আইনগতভাবে অবৈধ ও অযৌক্তিক। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ‘গণহত্যা’ বা জবাবদিহি, এই শব্দই চুক্তিতে নেই। ফলে এই চুক্তিকে গণহত্যা মীমাংসার দলিল বলা ইতিহাস বিকৃতি ছাড়া কিছু নয়।
২. ১৯৭৪ এর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি
দ্বিতীয়ত, ১৯৭৪ এর ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে যা হয়েছিল, তা হলো যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যাবর্তন। পাকিস্তান তখন কিছুটা ‘deep regret’ প্রকাশ করেছিল, কিন্তু সেটি ছিল সাধারণ মানবিক ভাষা, না ছিল স্পষ্ট ক্ষমা, না ছিল অপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি, regret ≠ apology। আন্তর্জাতিক আইনে ‘expression of regret’ কেবল কূটনৈতিক ভদ্রতা, অপরাধের দায় স্বীকার নয়। তাছাড়া, বাংলাদেশ সেই সময় মানবিক কারণেই ১৯৫ অভিযুক্ত অফিসারকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয়, শর্ত ছিল ওদের নিজেদের দেশে বিচার হবে। পাকিস্তানও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অভিযুক্ত ১৯৫ অফিসারকে বিচার করবে। বাস্তবে কোনো বিচার হয়নি। ইতিহাসবিদ সাফিয়া আখতার ও গ্যারি বাস (The Blood Telegram) দেখিয়েছেন, এইটা ছিল ক্ষমতার রাজনীতির এক ধরনের ‘deal’, যেখানে ন্যায়বিচারকে ত্যাগ করা হয় ভূরাজনীতির কারণে। সুতরাং ‘সমাধান’ হয়নি, বরং দায় স্থগিত করা হয়েছিল।
৩. মুশাররফের সফর (২০০২)
মুশাররফের ২০০২ সালের সফরের কথাও বারবার ঘুরিয়ে আনা হয়। তিনি শহীদ স্মৃতিসৌধে গিয়ে ফুল দিয়েছেন, বলেছেন ‘regret the excesses’, কিন্তু এটাও political regret, strategic ambiguity, কোনো আইনি দায় স্বীকার নয়।
অর্থাৎ এমন ভাষা যা শুনে বাংলাদেশে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ মনে হয়, অথচ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তা ‘অতিরঞ্জন ছিল’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। আন্তর্জাতিক transitional justice studies এ (Teitel, 2000) স্পষ্ট বলা আছে: true reconciliation requires acknowledgment of responsibility। মুশাররফ দায় অস্বীকার করে শুধু দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তিনি কোথাও বলেননি ‘আমরা অপরাধ করেছি, আমরা দায়ী, আমরা জবাবদিহি করব।’ তাই এটিও সমাধান নয়, বরং অর্ধসত্যের মাধ্যমে দায় এড়ানোর চেষ্টা।
৪. আন্তর্জাতিক আইন: গণহত্যা অব্যবহারযোগ্য অপরাধ
Genocide Convention (1948) অনুযায়ী গণহত্যা একটি jus cogens crime, যা ক্ষমা, আপস বা bilateral settlement দ্বারা এড়ানো যায় না। ‘No statute of limitation’ (UN General Assembly Resolution 2391, 1968) অনুসারে, গণহত্যার বিচার কখনো পুরোনো হয় না। তাই শিমলা চুক্তি বা কোনো সফর দিয়েই এই অপরাধকে মীমাংসিত ঘোষণা করা আইনবিরোধী।
৫. ইতিহাসের রাজনৈতিক প্রমাণ
যদি সত্যিই সমাধান হয়ে যেত,
তাহলে পাকিস্তান পার্লামেন্ট ২০১৬ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব দিত না।
তাহলে আজও কেন বাংলাদেশ বারবার আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করছে?
কেন ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতে?
এসব স্পষ্ট প্রমাণ যে, গণহত্যার দায় অমীমাংসিত।বরং পাকিস্তান ক্রমাগত এড়িয়ে যাচ্ছে।
৬. victim-centric justice
Transitional justice এর তত্ত্ব অনুযায়ী (Hayner, ‘Unspeakable Truths’), ভিকটিমের কণ্ঠ ও প্রতিকার ছাড়া কোনো চুক্তি বা ক্ষমা ‘legitimate resolution’ নয়। বাংলাদেশের কোটি ভিকটিম পরিবার কোনো সময় বলেননি যে তাঁরা পাকিস্তানের দায় ভুলে গেছেন। ফলে পাকিস্তানের একতরফা দাবি ভিকটিমদের অধিকারকেই অস্বীকার করে।
৭. রাজনৈতিক প্রভাব
আজকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যখন দাবি করে, ‘বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে’, এটা আসলে এক ধরনের institutional denialism। ইতিহাস বিকৃতি তো আছেই, সেই সাথে ভিকটিমদের প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো অন্যায় করা। Holocaust denial যেমন জার্মানি বা ইউরোপে আইনগতভাবে অপরাধ, তেমনি বাংলাদেশের গণহত্যাকে ‘মীমাংসিত’ বলা একটি dangerous revisionism, এটা অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, এই অস্বীকার পাকিস্তানের ভাবমূর্তি শক্তিশালী করে না, বরং প্রমাণ করে যে তারা আজও অতীতের দায় নিয়ে সৎ হতে পারেনি। প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রটি আজও নিজের অতীতের দায় স্বীকার করতে রাজনৈতিকভাবে অক্ষম। একটি দেশ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের অপরাধের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তার ‘reconciliation diplomacy’ কেবল ভান হয়ে থাকে।
সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো, গণহত্যা কখনোই কোনো bilateral compromise এর মাধ্যমে মাফ হয়ে যায় না। আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা একটি jus cogens crime, non-derogable, অর্থাৎ ক্ষমা, আপস বা রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে এর দায় মুছে ফেলা যায় না। ভিকটিমদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার, অপরাধীদের জবাবদিহি এবং সত্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা আন্তর্জাতিক আইনে স্পষ্টভাবে স্বীকৃত।
ফলে ‘সমাধান হয়ে গেছে’ বলাটা কেবল খালি রাজনৈতিক চাল নয়, এটা ইতিহাস, আইন এবং মানবতার বিরুদ্ধে এক ধরনের অস্বীকারবাদ, যা পাকিস্তানের ভবিষ্যৎকেও দায়মুক্ত করবে না।
মোটকথা, শিমলা চুক্তি হোক বা মুশাররফের সফর, কোথাও গণহত্যার দায়ের সমাধান হয়নি। হয়েছে কেবল কূটনৈতিক দায় এড়ানো। প্রকৃত সমাধান তখনই হবে, যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্পষ্টভাবে দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে, পাকিস্তানি চেইন অব কমান্ডের বিচার বা সত্য কমিশন,
আর্কাইভ উন্মুক্ত করে সত্য প্রকাশ, এবং ভিকটিম পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ দিবে ।
৭১ এর গণহত্যা ইতিহাসের বুক চিরে লেখা এক রক্তাক্ষর সত্য। এটা মুছে ফেলার চেষ্টা, ন্যায়ের প্রতি সরাসরি অমানবিক অবজ্ঞা। যারা আজকের দিনে ‘মীমাংসিত’ বলে বিষয়টি গায়েব করতে চান, তারা আসলে গণহত্যার শিকারদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে ইতিহাসকে পুনর্লিখনের চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশের জন্য প্রকৃত সমাধান কেবল তখনই সম্ভব, যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে স্পষ্ট ও অদ্ব্যর্থ ভাষায় স্বীকার করবে,
‘হ্যাঁ, আমরা গণহত্যা করেছি।’ ‘হ্যাঁ, আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধের দায় বহন করি।’ ‘হ্যাঁ, আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইছি।’ ‘হ্যাঁ, আমরা ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার দেব।’
এর আগে পর্যন্ত যে কোনো সমঝোতা, ফুল দেওয়া, প্রতীকী শ্রদ্ধা নিবেদন বা কূটনৈতিক ‘রিগ্রেট’ শুধু political expediency, যা ভিকটিমদের প্রতি এক নতুন অবমাননা এবং গণহত্যা অস্বীকারেরই আরেক রূপ।
তথ্যসূত্র:
১. https://www.mea.gov.in/Portal/LegalTreatiesDoc/PA72B1578.pdf
৩. https://www.youtube.com/watch?v=laTqKxSV0Ao
৪. https://ihl-databases.icrc.org/.../genocide.../article-6...
ড. লুবনা ফেরদৌসী
শিক্ষক ও গবেষক
ইংল্যান্ড
পাঠকের মন্তব্য