স্লাটশেমিং ও রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার গল্প

৪৬ পঠিত ... ৮ ঘন্টা ২২ মিনিট আগে

লেখা: ফারিয়া জামান নিকি

আমি জাকসু কেন্দ্রীয় নির্বাচন করব অনেক ভয়ে ভয়ে পরিবারকে জানাই। আমার বাবা এটা জানার পর প্রচন্ড টেনশনে পড়ে যায় আর আমাকে নমিনেশন না ওঠানোর কথা বলে। প্রথমে অনেক বকা এরপর অনুনয় বিনয় করতে থাকে। তবুও খানিকটা জোর করেই নমিনেশন তোলার পর আমার বাবা এই পোস্ট লেখা পর্যন্ত আমার সাথে আর কথা বলছে না।

সামাজিক অর্থনৈতিক ক্যাপিটালের কারণে আমি সমাজের অনেক মানুষের থেকেই বেশি প্রিভিলেজ প্রাপ্ত। আমার শিক্ষিত পরিবারই যদি এমন করে, যে মেয়েটা কৃষকের সন্তান কিংবা যার বাবা মাদ্রাসার সামান্য বেতনভুক্ত কর্মচারী তার মেয়ে রাজনীতিতে আসলে কেমন আচরণ করবে তা খালি কল্পনাই করতে পারি। অনুভব করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি কাউকে দোষ দেই না। আমার মা যখন ফেইসবুক খোলেন, তিনি নারী রাজনীতিবীদদের নিয়ে নানা বাজে রিলস দেখতে পান। আমাকে নিয়ে হওয়া প্রত্যেকটা ভিডিও আমার আম্মু দেখেন। প্রত্যেকটা কমেন্ট পড়েন। যখন দেখেন আমাকে স্লাটশেম করা হচ্ছে, আমার বাপ-মা তুলে গালাগালি করা হচ্ছে তখন আমার মা আমার কাছে এসে খালি কান্দেন। আমি মনটা শক্ত করে বসে থাকি। এইসব যেন না দেখতে হয় তাই খুব কম কম বাড়ি যাই। আগে প্রত্যেকটা মিছিলের পরপরই বাসা থেকে কল আসত। বাবা যেন না দেখে তাই আমি মিছিলের পেছনে পেছনে থাকতাম। ক্যামেরা দেখলে লুকাইতাম। ক্যাম্পাসের কত সাংবাদিকদের যে অনুরোধ করছি বাসার সমস্যার জন্য আমার ছবি-ভিডিও না করতে তার হিসাব নাই। তবুও রক্ষা হতো না আমার বিভাগের আওয়ামীপন্থী শিক্ষক যেকোনো মিছিলে গেলেই আমার বাসায় জানিয়ে দিতেন। ফারজানাবিরোধী আন্দোলন করার জন্য দীর্ঘ ৬ মাস আমার বাবা আমার সাথে ঠিকঠাক কথা বলে নাই। সাংবাদিক শামস ভাইয়ের জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করায় প্রথম আলোতে আমার ছবি দেখে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। মাস্টারপ্ল্যান ঢাকা থেকে যেদিন পরিবেশবাদীরা ক্যাম্পাস আসে, ওইদিন বাসায় মিথ্যা অ্যাসাইনমেন্টের কথা বলে ক্যাম্পাস এসেছিলাম। আবার এক শিক্ষক ফোন করে 'আন্দোলন করতেছি' জানানোয় মিথ্যা বলে ক্যাম্পাস এসেছি জেনে প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলেন। সিএসির সামনে গাছ কাটার ভিডিও দেখে আবারও মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। এই লড়াই সংগ্রাম করতে এসে কতবার যে বাপ-মায়ের মনে কত কষ্ট দিয়েছি তার হিসাব নাই। এমনকি গণঅভ্যুত্থানে আহত হওয়ার পরও সাংবাদিক মিজান ভাইকে অনুরোধ করেছিলাম সব সাংবাদিকদের বলে দিতে আমাকে নিয়ে যেন কোনো নিউজ না হয়। আমার বাপ এখনও জানে না আমাকে ছাত্রলীগ পিটাইছে। বাপকে বলেছি, পুলিশের দৌড়ানি খেয়ে ফোন হারিয়ে ফেলেছি।

বিএনপি, বাগছাস, শিবির কোন দলের নারীদের সাইবার বুলিং করা হয় না? নোংরা রিলস বানানো হয় না? বিএনপির রুমিন ফারহানাকে স্লাটশেইম, বডি শেম করা একপ্রকার নরমালই হয়ে গেছে। তার যে বিয়ে হয় নাই এটা নিয়ে প্রায়ই ফেইসবুকে রগরগে ভিডিও দেখতে পাই। বিএনপির 'দেশটা কারও বাপের না' গানের মৌসুমির শাড়ির আঁচল সরে যাওয়ার ভিডিও রিলস হয়ে যায়।

বাগছাসের তাসনিম জারাকে নিয়ে যে পরিমাণ নোংরামি হয়েছে যে এখন তাসনিম জারার যেকোন ভিডিও আসলে আমি সরিয়ে দেই। সবশেষে ছাত্রীসংস্থার মেয়েদের নিয়ে 'কুৎসিত', 'দেখতে বাজে' এমন মিম অহরহ দেখা যায়।

আর বামপন্থী নারীদের নিয়ে কত কিসিমের, কত ধরনের যে নোংরা ভিডিও হয় তা কি আর বলার প্রয়োজন আছে?

তো আসলে আপনি কোন দল করছেন এটা মূখ্য নয়, মূখ্য হলো আপনি নারী। আপনি আপনার স্বাচ্ছন্দের পোশাক পরেন কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরেন, কোনো কিছুতেই আপনি রক্ষা পাবেন না। কারণ আসলে আপনি যে পোশাকই পরেন না কেন, যে আদর্শেরই রাজনীতিই করেন না কেন এই যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এটা নিয়েই তাদের সমস্যা।

তো আমরা কী দেখলাম? রাজনীতি করা কোনো নারীকেই আমরা সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারি নাই। এ তো গেল সোশ্যাল মিডিয়া বুলিং-এর কথা। বাস্তবে কোনো নারীই রাজনীতি করলে তাকে এক ধরনের আদারিং-এর স্বীকার হতে হয়। তখন সে আর ছাত্রী থাকে না, হয়ে ওঠে 'পলিটিক্যাল'। গণরুমে প্রথমদিনই আমাকে শুধুমাত্র টিপ দেওয়ার জন্য বাম ট্যাগিং করে ফাঁপড় দেওয়া হতো। তখন বামপন্থী কী সেটাও জানতাম না।

আর এটা শুধু আমার রিয়ালিটি না, আমাদের সকলের রিয়ালিটি। একটা মেয়েও দলমত নির্বিশেষে বলতে পারবেন যে তারা রাজনীতি করেন কিন্তু আদারিং-এর স্বীকার হন নাই? বুলিং-এর স্বীকার হন নাই?

গণঅভ্যুত্থানেও নারীরা সামনের সারিতে থাকার পরও তাদের কোথাও রাখা হয় নাই। ঘরের মেয়েরা আন্দোলন করে 'কিছু না চেয়ে' ঘরে ফিরে গেছে এটাকে এক ধরনের গ্লোরিফাই করা হয়েছে। এটাকে আমি বলি হিন্দি সিরিয়াল নায়িকা সিন্ড্রোম। নারীরা খালি স্যাক্রিফাইস করবে, নারীরা খালি ছাড় দেবে। কোনো পদ বা স্টেক তারা নেবে না এটাই তো নারীদের কাজ

এটা নিয়ে নারীরা প্রবল সমালোচনা আর আপত্তি করলে মান রক্ষায় বিভিন্ন দল নারীদেরকে 'টোকেন' বা শোপিস হিসেবে রেখেছেন । এমনকি জাকসুর অনেক প্যানেল থেকেও বিভিন্ন নারীকে অ্যাপ্রোচ করা হয়েছে তাদের প্যানেলে 'মেয়ে নাই, মেয়ে দেখানো লাগবে' এই জাতীয় কথা বলে। আর যে প্যানেলে নারীরা স্বতঃস্ফুর্ত এসেছেন তাদের শাহবাগী, বেপর্দা, বাম এমনকি ইসলাম বিদ্বেষী ট্যাগিং করা হয়েছে।

এতদিন এই অবস্থার পর যখন হলে লড়াই করার জন্য নারীদের পাওয়া যাচ্ছে না তখন সবার হঠাৎ মনে হয়েছে হায় হায় নারীরা কই গেল! কেন এতদিন আপনারা জানতেন না? নারীদের রাজনীতিতে সেইফ ফিল করানোর জন্য কেউ কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন? নেন নাই। তো হঠাৎ করে সবার 'নারীরা কেন নাই' এই কৌতূহল দেখে আমার বরং একটু হাসিই পাচ্ছে।

যে প্রক্রিয়ায় নারীদের রাজনীতিতে আরও অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল সেটি না করে তাদের আরও বেশি সেগরিগেশন করা হয়েছে। তাদের নিরাপদ বোধ করানো তো দূর, যেকোনো মেয়েই নমিনেশন তুললেই তাকে ট্যাগিং করা হয়েছে। হলগুলোয় স্বতন্ত্র পদে দাঁড়ানোর জন্য এক ধরনের পুশ করা হয়েছে। খালি পুশ না, বিভিন্ন 'গুপ্ত' সিনিয়র নারী, বিভিন্ন বোকা লিবারেল নারীর গুপ্ত নেতা তাদের এক রকম বাধ্য করেছেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বজায় রাখার জন্য।

এছাড়া ছাত্রশিবিরের একটা বড় এজেন্ডা ছিলো শিক্ষার্থীদের 'অরাজনৈতিক' বানানো। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অনেক শিক্ষার্থীই আবার রাজনীতিতে উৎসাহী হয়েছিলেন যেটা আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক ছিল। কিন্তু শিবির গণঅভ্যুত্থানের পরপরই রাজনীতি বাজে, রাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে অনলাইন-অফলাইনে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। হলে হলে, ডিপার্টমেন্টে তারা এক ধরনের ক্যাম্পেইন চালায় রাজনীতি নিষিদ্ধ নিয়ে। সময়ের খেলায় আমরা দেখি সর্বপ্রথম যে হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যানার টাঙ্গানো হয় সেখান থেকেই তাদের নেতারা উঠে আসেন। এই যে তাদের এই রাজনীতি বিরোধী প্রচারনা তাতে সত্যিই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই প্রভাবিত হয়েছেন। সে-সকল শিক্ষার্থীদের পলিটিক্স আর পাওয়ার পলিটিক্স এর পার্থক্য আমরা বোঝাতে পারি নাই। শিবির যেহেতু গুপ্ত রাজনীতি করে অভ্যস্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে তারাই সবচেয়ে বেশী আপার হ্যান্ড পায় আর এটাকে তারা ব্যবহারও করতে চেয়েছিল। অবশেষে বামপন্থীদের থেকে আশানুরূপ বাঁধা না পাওয়ায় তারা আবার রাজনীতি শুরু করেছেন। ওনারা ভেবেছিলেন বামপন্থীরা রাজনীতি চালু করতে মাঠে নামবেন তখন সেই সুযোগ রাজনীতি নিয়ে যেকোনো ঝামেলায় আমাদের দোষ দেওয়া যাবে। আমাদের নীরবতা আর একই সাথে বাগছাস (তৎকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন) এর রাজনৈতিক কার্যক্রমের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধের সেই আলাপ আর ধোপে টেকে নাই।

এই সামগ্রিক অবস্থায় একটা বড় অংশের শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই তাদের নিজেদের গায়ে রাজনীতির তকমা লাগাতে চায় না৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে হলে অনেক নারীদের সাথে কথা বলেছি। তারা কোনোভাবেই 'পলিটিক্যাল' হওয়ার পর যে আদারিং,যে ট্যাগিং, যে শেইমিং; সেটার মধ্য দিয়ে যেতে চান না।

রাজনৈতিক নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারলে আপনি যতই মুখে বলেন রাজনীতিতে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করানো সম্ভব না।

যাইহোক, আমি জানি অবস্থা অনেক প্রতিকূল। আসলে আমরা সবাই জানি নারীরা কেন রাজনীতিতে আসছে না। এটার উত্তর খোঁজার কিছু নেই।

তবুও এই ক্যাম্পাসের নারী শিক্ষার্থীদের কাছে আমি একটু অনুরোধ করতে চাই। দেখেন নারী হিসেবে আপনার চলাফেরা, পড়ালেখা কোনোটাই সহজ ছিল না। আমরা সব নারীই সংগ্রাম করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে এসেছি। আমি জানি রাজনীতি করা সহজ না। সমস্ত লজিক-ই এটা নির্দেশ করে আপনার রাজনীতি করার কথা না।

কিন্তু জাহাঙ্গীরগর, জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েরা খুবই অদ্ভুদ। বোনেরা আমার, আমরা তো আসলে সবসময় লজিক দিয়ে পরিচালিত হই নাই।

যখন সবাই ভিসির বাসার ভিতরে আটকা পড়েছিল লজিক তো এটাই বলত তাদের কেউ রক্ষা করতে যাবে না। লজিক তো এটাই বলত শত শত ছাত্রলীগ তাদের মেরে ফেলবে। লজিক এটা বলত শত শত আর্মড ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আমরা নিরস্ত্র নারীরা কিছুই করতে পারব না। লজিক বলে সারাদিন এত রক্ত দেখার পর আর কোনোদিন কেউ আন্দোলনে যাব না।

আদতে কী হয়েছিল আমরা সবাই জানি। আমরা মেয়েরা ওইদিন কিন্তু লজিক মানি নাই। আমরা গিয়েছি, আটকা পড়া  শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করেছি, পরেরদিন আবার ভয় ভুলে মিছিল করেছি।

আমাদের ক্যাম্পাসের মেয়েরা একটা অদ্ভুত শক্তি। ওইদিন আমরা যে সাহস দেখিয়েছি তা সারা বাংলাদেশকে সাহস যুগিয়েছিল।

দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাকসু হতে যাচ্ছে। এই যে জাকসু হতে যাচ্ছে এটা আমাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফল। এখনও  ক্যাম্পাসের চিপাচাপায় আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া চিকা দেখতে পারবেন জাকসু নিয়ে। ২০১৯ সালে অনেক আন্দোলনের পর প্রশাসন জাকসুর প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ মুহুর্তে এসে জাকসু আর হতে দেয় নাই। অবশেষে এবার আসলেই জাকসু হচ্ছে। এই যে ৩৩ বছর পর জাকসু হচ্ছে এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। সমস্ত লজিকই বলে আপনাদের রাজনীতি বিমুখ হবার কথা কিন্তু জাহাঙ্গীরগরের মেয়েরা তো আসলে লজিকে চলার মানুষ না। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ করব ইতিহাসের অংশ হওয়ার কথা চিন্তা করে হলেও হল সংসদের জন্য অংশগ্রহণ করেন। মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছেন, লড়াইয়ের প্রবণতাটা আপনার জন্মগত।

একটা নারী রাজনীতিবান্ধব ক্যাম্পাসের প্রত্যাশায় আজ আলাপ এখানেই শেষ করলাম।

ফারিয়া জামান নিকি

নৃবিজ্ঞান ৪৮

 

৪৬ পঠিত ... ৮ ঘন্টা ২২ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top