দীর্ঘ পাঁচ দশক সাংবাদিকতা করে রিক্ত হাতে চলে গেলেন বিভুরঞ্জন সরকার, যিনি তার রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি সতত নিষ্ঠাবান ছিলেন। আওয়ামী লীগ যে সামাজিক সুবিচারের স্বপ্ন দেখিয়েছিল; বিভুদা তাতে আস্থা রেখেছিলেন। ফলে সে আস্থাবিন্দু থেকে না সরে তিনি সততার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। বামপন্থী রাজনীতি থেকে সাংবাদিকতা জীবনে এসে পাঁচটি দশক তিনি আওয়ামী লীগের চশমা পরে সমাজ বাস্তবতাকে দেখেছেন; তাই তো অন্তর্মুখী এই মানুষটি নিঃসঙ্গ শেরপার মতো আওয়ামী লীগের পক্ষে লড়াই করেও লীগের পনের বছরের দ্রুত ধনী হয়ে ওঠা সৌভাগ্যবান হতে পারেননি। কারণ আওয়ামী লীগ সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। বিভুদা তাই সামাজিক সুবিচার পাননি।
শেখ হাসিনার পিয়নের চারশ কোটি টাকা আর পণ্ডিত বিভুরঞ্জনের ওষুধ কেনার পয়সার অভাব সেই সৈয়দ মুজতবা আলীর পণ্ডিত মশাই গল্পের মতোই ট্র্যাজিক। শেখ হাসিনার 'প্রশ্ন নয় প্রশংসা' করতে এসেছির আসরে যে হাজার কোটি টাকা ক্লাবের সাংবাদিকদের আমরা দেখেছি; এরা মধ্যস্বত্বভোগী কিংবা ফড়িয়া গোত্রের লোক। ফলে বিভুরঞ্জন সরকারের পাণ্ডিত্য তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। তাই বিভুরঞ্জনকে কী করে মিডিয়ার স্পট লাইট থেকে দূরে রাখা যায়; সেই চেষ্টায় তাকে সবসময় মাঠের সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি কানকথা প্রিয় শেখ হাসিনার কানে কী বিষ যে ঢেলেছে তারা; বিভুদা হাসিনার কাছে আবেদন করার পরেও কোন সাহায্য সহযোগিতা কিংবা একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পাননি। ফাটকাবাজির টকশোতে হাসিনার প্রশস্তি করে অর্ধশিক্ষিত ফাঁপা টকারেরা পদ-পদক-প্লট জিতে নিয়েছে হাসিনার রাজভাণ্ডার থেকে। আর বিভুদা যেন টকশোতে আসতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে ফড়িয়া হেড অফ দ্য নিউজ লীগ।
মুজিব শতবর্ষে কারও বাড়ির ঘাটে বঙ্গবন্ধু কোনোকালে নৌকা থেকে নামলেই সে কল্পকাহিনীভিত্তিক স্মৃতিকথা আর স্তুতি দিয়ে বই লিখে কোটিপতি হয়েছে হালিছালি লেখকেরা; অথচ বিভুরঞ্জন শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটা তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ লিখে; দুই টাকা রয়ালটি পাননি; হাসিনা সরকারের ক্রয় করা তেলাঞ্জলি নির্ভর ট্র্যাশ গ্রন্থের তালিকায় বিভুদার সুলিখিত গ্রন্থখানি ঠাঁই পায়নি।
সবশেষে তিনি যে পত্রিকায় ছিলেন, সেখানে তিনি বিভাগীয় সম্পাদকও নন; কোত্থেকে এমন অভিজ্ঞ বিভাগীয় সম্পাদক এল; যার পেশাগত অভিজ্ঞতা বিভুদার পাঁচ দশকের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার চেয়েও বেশি। এ থেকে বোঝা যায় বিভুরঞ্জনের অভিজ্ঞতাকে বিন্দুমাত্র মূল্য দেয়নি এমনকি আওয়ামী লীগের পত্রিকাও। যে আওয়ামী লীগের জন্য বিভুদা জীবন দিয়ে দিলেন।
বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের নব্বই ভাগ সাংবাদিকই বিভুদার মতো দুর্ভাগ্যের জীবন বরণ করেছেন। দশ শতাংশ ফড়িয়া ও মিডলম্যান সাংবাদিক; হাসিনার রাজনৈতিক পাণ্ডাদের সঙ্গে ভাইফোঁটা দিয়ে দাবড়ে বেড়ায় মিডিয়া জগত। আবার ওরা জানে হাসিনার পাণ্ডা না থাকলে কীভাবে রাতারাতি তারেকের পাণ্ডাদের মাথায় ছাতা ধরা যাবে। এই ফড়িয়া সাংবাদিকেরা জানে কী করে খুশিজলের আসরে ভাঁড়ামি করে ভাইদের হাসাতে হয়; অথবা গাজীপুরের নন্দনগৃহে পৌঁছে দিয়ে আসতে হয় ললিতলোভনকান্তি মাংসপিণ্ড। ফলে এদের আর সাংবাদিকতা করতে হয় না। গাড়ি হাঁকিয়ে অফিসে এসে পাছা দুলিয়ে শার্টের হাতার কাফলিং ঝাঁকিয়ে ধমকা ধমকি করে আর মিডিয়া মালিকের মানব সম্পদ বলয়ে তেলাঞ্জলি দিয়ে হাইড্রোসিল সৃষ্টি করে সফল সাংবাদিক হিসেবে সাঁঝের ভাইয়ের মায়ার অপেক্ষা করে। আর মিডিয়ার ডেস্ক জুড়ে কয়লাখনির ময়লা শ্রমিকের মতো নিঃগৃহীত জীবন সত্যিকার সাংবাদিকদের। যাদের বেতন বাকী রেখে ব্যাংককে হেলথ ট্যুরিজমে গিয়ে চেক ইন দেয়; অথবা কর্নেলিয়া ইউনিভার্সিটিতে মেয়ের গ্র্যাজুয়েশনের ক্যাপ ওড়ায় ফড়িয়া বসেরা।
বিভুরঞ্জন সরকার এই ফোর টোয়েন্টির যুগে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছে; শুধু এইটুকু স্বপ্নপূরণ নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেছেন। যখন শেষ আশার বাতি নিভে গেছে চব্বিশের ৫ অগাস্টে; সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তার। সামান্যই তো চেয়েছিলেন তিনি; শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা। তিনি তার এই চাওয়া আশা ও স্বপ্নের প্রতি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অটল ছিলেন।
ভারতীয় মিডিয়া প্রচারণা আর আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের বয়ানকে তিনি বিশ্বাস করেছেন। দাড়ি টুপিওয়ালা মানুষের জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকে জঙ্গি কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সততার সঙ্গে সে কথা লিখে গেছেন। তার বিশ্বাসই তো তার কাছে সত্য। কারণ তার বিশ্বাসে কোন খাদ ছিল না। কিন্তু এই বিশ্বাসের পক্ষে লড়াই করার শক্তি অবশিষ্ট ছিল না বিভুদার। দেশ লুণ্ঠনের ডাকাতেরা কখনও খোঁজ নেয়নি তার, কেমন আছেন বিভুদা? এখন অবশ্য বিভুদা ডাকাত দলের শোকসভার সাদাকালো ছবি। সেখানে গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে বিলাপ করবে দেশলুণ্ঠক প্রতারক ও মানবতাবিরোধী অপরাধীরা।
বাংলাদেশের কুসংস্কারাছন্ন ও অন্ধবিশ্বাস নির্ভর সমাজে ডান-বাম, আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিশ্বাসগুলো ধর্মীয় আঙ্গিকে প্রতিপালিত। এই বিশ্বাস স্ব স্ব রাজনৈতিক ধর্মকে নির্ভুল বলে ভাবতে শেখায়। ফলে স্বীয় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস এখানে নিত্য সত্য হিসেবে কল্পিত।
এই অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর বিজন জনপদে সাংবাদিকতা দলীয় সত্যের ওপর নির্মিত। ফলে এখানে নৈর্ব্যক্তিক সাংবাদিকতা সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। দলীয় সেবাদাস দলের মন্দিরে ফুল দিয়ে এসে রিপোর্ট ও কলাম লেখে। সেটা সাংবাদিকতা তো নয়; দলীয় প্রোপাগান্ডা মাত্র।
সুইডিশ চলচ্চিত্রকার ইমগুর বার্গম্যানের উইন্টার লাইট চলচ্চিত্রে এক জেলে হঠাৎ কোত্থেকে গুজব শোনে যে, চীন এমন এক ক্ষেপনাস্ত্র বানাচ্ছে; যা ছুঁড়ে মারলে পুরো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চল ছারখার হয়ে যাবে। এই গুজব বিশ্বাস করে জেলেটি দিনমান তা নিয়ে ভাবতে থাকে। এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে সে ধর্মযাজকের কাছে যায়। যাজক তাকে অনেক বোঝান, এটা গুজব মাত্র। এর সঙ্গে বাস্তবতার কোন সংযোগ নেই। কিন্তু চীনের কল্পিত ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মারা যাবার ভয় লালন করতে করতে জেলে আত্মহত্যা করে; নদীতে তার ভাসমান লাশ পাওয়া যায়।
আমাদের সমাজে ‘হাসিনা ফিরে আসবে' এই আশা নিয়ে অনেক মানুষ নানান গুজব বিশ্বাস করে। আর তা সারাক্ষণ তাদের মস্তিষ্কে ঘোরাঘুরি করছে। কিছুক্ষণ পর তা গুজব প্রমাণিত হয়। এটা অনেককে নৈরাশ্যে নিমজ্জিত করছে। হাসিনা ফিরে আসবে এই আশাটিই অনেক মানুষের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। এদের অনেকের সাইকো সোমাটিক ডিজ অর্ডার তৈরি হয়েছে। তাই যারা সরাসরি লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়, কেবল ফেসবুকে ও মিডিয়ায় উস্কানি দিয়েছে; তাদেরকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। নেলসন ম্যান্ডেলা যেভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ট্রুথ অ্যাণ্ড রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে সামাজিক স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনেছিলেন; সেটা অনুসরণ করে বাঁচাতে হবে আশাভঙ্গের বেদনায় মুষড়ে পড়া আওয়ামী লীগ সমর্থকদের। তারা আমাদের পশ্চাদপদ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের ভিক্টিম। আওয়ামী ধর্মে অন্ধ বিশ্বাস রেখে এথনিক ক্লিনসিং-এর মাধ্যমে ভিন্নমত নির্মূল করে আওয়ামী সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলো। অবাস্তব এক ধর্মবিশ্বাস তাদের আজ আশাভঙ্গের বেদনায় লীন করেছে। ফেসবুকে, পত্রিকার কলামে, টকশোতে যে ম্যাড ম্যান স্পিকিং দেখতে পাই আমরা; তাদের ওপর বিক্ষুব্ধ হওয়া অনুচিত। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে পোস্ট ট্রমাটিক ট্রেস অর্ডারে মানুষ এরকম অসংলগ্ন বয়ান দেয়। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের কথায় ছদ্ম উত্তেজনা তৈরি করে ফেসবুকে লাইক ও হাহা ইমো খাওয়া বন্ধ করতে হবে। উই শুড গেট আ লাইফ।
যদি সম্ভব হয়; বিভুরঞ্জন সরকারের শেষ চিঠি থেকে শিক্ষা নিয়ে সাংবাদিক জীবনের অবর্ণনীয় কষ্টের ইতি ঘটাতে ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করতে হবে। বিভুদার মতো অন্তর্মুখী,পণ্ডিত মানুষদের অবহেলা করে; ফড়িয়া সাংবাদিক নিয়ে জংলি নৃত্য বন্ধ করতে হবে। বিভুদা জীবন দিয়ে মিডিয়া জগতের আকালের সন্ধানের ধূসর পাণ্ডুলিপি লিখে গেছেন; উনি পরের প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্য মেনিফেস্টো লিখে গেছেন; বাঁচতে হলে মিডিয়া শোষণের ইতি ঘটাতে হবে। বিদায় বিভুদা।
পাঠকের মন্তব্য