পিতৃত্বকালীন ছুটির আবার কী দরকার!

৬৩ পঠিত ... ৪ ঘন্টা ২৫ মিনিট আগে

লেখা: ফৌজিয়া আফরোজ 

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেছেন, আমার মনে হয় না আলাদা পিতৃত্বকালীন ছুটি দরকার আছে। ছুটি যদি দিতে হয়, তাহলে বাবারও শিশুকে সময় দিতে হবে।
উনি আরও বলেন, আমি নিজেও মা। আমার মনে হয় না আলাদা পিতৃত্বকালীন ছুটি দরকার আছে। তবে যদি দেওয়া হয়, শর্ত থাকতে হবে—পিতা কতক্ষণ শিশুকে দেখেছেন, তার যত্ন নিয়েছেন, মাকে সাহায্য করেছেন—এসব লিখিতভাবে জানাতে হবে।

সোমবার (১৮ আগস্ট) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত কর্মশালায় তিনি এই মন্তব্য করেন। আসুন,  আমরা ওনার বক্তব্যটাকে বিশ্লেষণ করি। বক্তব্যের প্রথম লাইনে উনি বলছেন—আমার মনে হয় না আলাদা পিতৃত্বকালীন ছুটি দরকার আছে।
যার অর্থ দাঁড়ায় উনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে মনে করেন যে পিতৃত্বকালীন ছুটির কোনো প্রয়োজন নেই। এই মনে করার পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে?

১। উনি বিশ্বাস করেন যে সন্তান লালন-পালন শুধু মাত্র নারীদের কাজ  

২। উনি মনে করেন যে সন্তান লালন পালনে বিশেষ করে শিশুর প্রাত্যাহিক যে পরিচর্যার কাজ সেখানে বাবার কোনো ভূমিকা নেই

৩। উনি মনে করেন নারী যে মাতৃত্বকালীন ছুটি পায় তা শুধু মাত্র সন্তানের পরিচর্যার জন্য। সেখানে তার নিজের কোনো বিশ্রামের প্রয়োজন নেই

৪। জন্মের প্রথম ছয় মাসে বাবা ও শিশুর মধ্যে শারীরিক ও মানসিক বন্ধনের প্রয়োজন নেই

৫। উনি শ্রমের সমবণ্টনে বিশ্বাস করেন না। বিশেষ করে শ্রমটা যখন গৃহস্থালি বা ঘরের কাজ ও সন্তান পরিচর্যা সংক্রান্ত

৬। তিনি আরও মনে করেন, বেশিরভাগ পুরুষরা আকাইম্যা। সংসারের কোনো কাজই করে না। এরা সংসারের বোঝা।

এখন যদি আমরা ওনার বক্তব্যের দ্বিতীয় লাইনে আসি যেখানে উনি বলেছেন ছুটি যদি দিতে হয়, তাহলে বাবারও শিশুকে সময় দিতে হবে। এই কথা থেকে আমরা যা বুঝতে পারি তা হলো, উনি মনে করেন যে আমাদের দেশের পুরুষেরা যদি পিতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েও থাকে—সেটা তারা সন্তান লালন পালনের জন্য ব্যবহার করবে না। তা তার বক্তব্যের আরেকটি অংশ থেকে আর স্পষ্ট হয়। যেখানে উনি বলেন ‘আমি নিজেও মা। আমার মনে হয় না আলাদা পিতৃত্বকালীন ছুটি দরকার আছে। তবে যদি দেওয়া হয়, শর্ত থাকতে হবে—পিতা কতক্ষণ শিশুকে দেখেছেন, তার যত্ন নিয়েছেন, মাকে সাহায্য করেছেন—এসব লিখিতভাবে জানাতে হবে।’  আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় পিতা কতক্ষণ শিশুকে দেখেছেন, তার যত্ন নিয়েছেন, মাকে সাহায্য করেছেন, এসব লিখিতভাবে জানানোর বিষয়টা উনি ওনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন!
এখন আমরা যদি ওনার বক্তব্যটাকে খণ্ডন করি, বক্তব্যের প্রথম অংশে উনি বলেছেন পিতৃত্বকালীন ছুটির দরকার নাই। আমরা যদি বলি পিতৃত্বকালীন ছুটির দরকার কেন? এই প্রশ্নটি আমি চ্যাটজিপিটিকে করেছিলাম। নিচে তার উত্তর নিচে দেওয়া হলো। এআইয়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যদি এতটুকু বোঝাপড়া থাকে, আমাদের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা কেন বিষয়টা ধরতে পারছেন না  এটা একটা বিস্ময় আমার কাছে।

১. সন্তানের পরিচর্যায় অংশগ্রহণ:

শিশুর জন্মের পর মায়ের পাশে থেকে নবজাতকের পরিচর্যায় বাবার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়।

২. মানসিক সহায়তা:

নবজাতকের মাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য বাবার উপস্থিতি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

৩. পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা:

সন্তানের জন্মের সময় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো বাবা-মা এবং সন্তানের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলে।

৪. লিঙ্গ সমতা ও দায়িত্ব ভাগাভাগি:

শুধু মা নন, বাবা-ও সন্তানের দায়িত্ব ভাগ করে নিচ্ছেন — এই বার্তাটি কর্মস্থলে ও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৫. সুস্থ কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনের ভারসাম্য: পিতৃত্বকালীন ছুটি কর্মীদের মধ্যে কাজ ও পরিবারের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে, যা দীর্ঘমেয়াদে প্রোডাক্টিভিটি বাড়ায়।

বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০২৪ সালে নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৪৪.২% এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে এটি ৮০.৯%। অর্থাৎ এই ৪৪.২% নারী মাতৃত্বকালীন ছুটির পরে আবার কাজে ফেরত যাবে। যদি জন্মের প্রথম ৬ মাসে বাবা যদি শিশুর প্রাত্যাহিক দায়িত্বগুলো পালনে দক্ষতা বৃদ্ধি না করে—এই নারী যখন কাজে ফিরবে, তার কর্মস্থলের দায়িত্বের পাশাপাশি শিশুকে লালনপালনের দায়িত্বও একা পালন করতে হবে। যা তার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে চাপের সৃষ্টি করবে। যেখানে আমরা প্রতিনিয়ত গৃহস্থালি বা ঘরের কাজে সম শ্রমবণ্টনের কথা বলে আসছি।
এবার আসি  ৮০.৯% পুরুষের কাছে। যারা পিতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার যোগ্য না বলে আমাদের উপদেষ্টা মহোদয় মনে করেন। উনি জেনে খুশি হবেন যে ওনার সাথে বাংলাদেশ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরাও একমত। তারাও মনে করে সন্তান পালন শুধু মায়ের কাজ। এই ৮০ শতাংশ পুরুষকে তাদের সন্তানের ও  স্ত্রীর প্রয়োজনে তার বার্ষিক ছুটি থেকে ছুটি নিতে হয় এবং এই ছুটি নিতে তাকে বিভিন্ন সময় বেগ পেতে হয়। এই ৮০ শতাংশ পুরুষ তাদের সন্তানের শিশুর জন্মের পরে তার পরিচর্যায় অংশ গ্রহণ করতে পারে না। এই ৮০ শতাংশ দায়িত্ব পালনে দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ হারায়। একইসাথে এই ৮০ শতাংশের মধ্যে যারা নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে আছে, তারা নারীবান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে তখন নেতিবাচক দিকে প্রভাবিত হয়। আরেকটু রসাত্মকভাবে বলতে চাইলে, এই ৮০ শতাংশের যদি স্ত্রী মারা যায় সন্তান পালনের জন্য তাদের আরেকটা বিয়ে করতে হয়।
আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা ভালো, সন্তান পালন কোনো জন্মগত দক্ষতা নয়। যে কেউ চাইলে যে কোনো সময় এই দক্ষতা অর্জন করতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১০০টির বেশি দেশে কোনো না কোনো ধরনের পিতৃত্বকালীন ছুটি রয়েছে। এর মধ্যে নরওয়ে, সুইডেন, আইসল্যান্ড, জাপানের মতন দেশগুলোও রয়েছে। শুধুমাত্র রাস্তাঘাট বানানোর জন্য উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ না করে,  চাইলে আমরা অধিকার ও মূল্যবোধের জায়গাগুলোতেও অনুসরণ করতে পারি।

বাংলাদেশর দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করতে নির্দেশিকা বা নীতিমালা বা যথাযথ আইনি বিধান প্রণয়নের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ০৯ জুলাই ২০২৪-এ রুল দেন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিতে নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে ছয় মাস বয়সী শিশু নুবাইদ বিন সাদী ও তার মা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান আবেদনকারী হয়ে ৩ জুলাই, ২০২৪ রিটটি করেন। রিট আবেদনের ভাষ্য, বিশ্বের প্রায় ৭৮টি দেশে পিতৃত্বকালীন ছুটির বিধান রয়েছে বলে আইএলের ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদন এসেছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার দেশে অনেক বেশি। তাই জন্ম নেওয়ার পর নবজাতক ও তার মা অনেকটা নাজুক অবস্থায় থাকে। এ পর্যায়ে ন্যূনতম অবেহলায় তাঁদের অবস্থা সংকটাপন্ন হতে পারে। এ সময়ে নবজাতক ও তার মায়ের দেখাশোনার জন্য বাবা সর্বোত্তম বিকল্প। কর্মজীবী বাবার ক্ষেত্রে পিতৃত্বকালীন ছুটির বিধান না থাকায় নবজাতক ও তার মায়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা তাঁদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পিতৃত্বকালীন ছুটির অনুমতি দেয় না, যা বৈষম্যমূলক।

প্রিয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের উপদেষ্টা আপনি খলিফা ওমর (রা.)-এর মতো রাতের আঁধারে তিনি জনগণের সুখ-দুঃখ খুঁজে বেড়াবেন —সেটা আমরা আশা করছি না। একটু কষ্ট করে আপনার বক্তব্য নিয়ে বের হওয়া সংবাদের নিচে ফেইসবুক কমেন্টগুলো পড়লেই জনগণের প্রয়োজন কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন বলে আশা রাখি।  

যাই হোক, লেখাটা একটা হাদিস দিয়ে শেষ করি । রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে সে যেন অবশ্যই ভাল কথা বলে, না হলে চুপ থাকে।

 

 

 

 

৬৩ পঠিত ... ৪ ঘন্টা ২৫ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top