মুসলমানের হিপোক্রেসি এবং মানবতা: চন্দ্রনাথ পাহাড় অধ্যায়

১৫৫৫ পঠিত ... ১১ ঘন্টা ৫৬ মিনিট আগে

লেখা: আরিফ রহমান 

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অনেকগুলো মন্দির আছে। এখানে একটা জায়গা আছে যেখানে ধারণা করা হয় মাতা সীতা স্নান করেছিলেন। সীতার স্নানের কুণ্ডটা থেকেই সীতাকুণ্ডু নামটা এসেছে।

রামায়ণটা আমাদের অনেকেরই পড়া আছে। চন্দ্রনাথে রামায়ণের চরিত্রগুলোর উপস্থিতি খুবই কৌতূহল জাগায়। এটা নিয়ে অন্য কোনোদিন আলাপ করব। আজকে আলাপ করতে চাই সেখানে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে।

এই আলাপটা যখন আমি করছি তখন আমি গরুর মাংস আর ভাত খেয়ে ফেসবুকে ঢুকেছি। শুনলাম চান্দ্রনাথে একটা মসজিদ করতেই নাকি হবে।

যারা জানেন তারা বুঝবেন চন্দ্রনাথ কেবল একটা মন্দির না, এখানে একশ মন্দির আছে, পুর এলাকাটা রামায়ণ-মহাভারতের অনেক স্টোরির সাথে কানেক্টেড।  একে বলতে পারেন পুরো পাহাড়টা একটা মন্দির কম্পাউন্ড। যেই মন্দিরগুলো আবার রিসেন্টও না। শত শত বছর পুরাতন।

এই কম্পাউন্ডে একটা মসজিদ চাওয়া মানে বাইতুল মোকারম কম্পাউন্ডে একটা মন্দিরের দাবী।

তো শত শত মন্দিরের তীর্থভূমিতে একটি মসজিদ বানানোর আগ্রহ তৈরি সংখ্যাগুরুর কেন হয়? কেন সেখানে আজান দিতে মনে চায়? কেন সেখানে একটা বিফ বারবিকিউ কইরা সংখ্যাগুরুর হেডাম জানায়া দিতে ইচ্ছা করে আমাদের?

আসেন এই প্রশ্নগুলার উত্তর খুঁজি।

এই উত্তরের ভেতরেই লুকায়া আছে সংখ্যাগুরু মুসলমানের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের চিহ্ন।

এই সংকট বুঝতে হলে আগে জানতে হবে, চন্দ্রনাথ পাহাড় আসলে কী এবং কেন এটি এতটা স্পর্শকাতর একটি বিষয়। এটি নিছক কোনো পাহাড় নয়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি জীবন্ত পুণ্যভূমি।

ঐতিহাসিকভাবে, গত ৭০০ থেকে ৮০০ বছর ধরে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শিব মন্দিরে নিরবচ্ছিন্নভাবে পূজা-অর্চনা হয়ে আসছে বলে প্রচলিত রয়েছে। এটি সনাতনীদের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম পবিত্র একটি পীঠ। বাংলাদেশে ৭টি শক্তিপীঠ রয়েছে—যেমন বরিশালের সুগন্ধা, বগুড়ার ভবানীপুর বা সিলেটের শ্রীশৈল— চন্দ্রনাথ তাদের একটি।

এর গুরুত্ব কেবল শক্তিপীঠ হিসেবেই নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে মহাকাব্য রামায়ণের বহু স্মৃতি।

 পৌরাণিক কাহিনি মতে, বনবাসকালে এখানেই এসেছিলেন রাম, সীতা ও লক্ষণ। তাঁদের আগমনের খবরে মহামুনি ভার্গব এখানে তিনটি জলাশয় বা কুণ্ড তৈরি করেন। আগেই বলেছিএর মধ্যে সীতার স্নান করার কুণ্ডটির সূত্র ধরেই পুরো অঞ্চলের নাম হয় 'সীতাকুণ্ড'। আজও সেখানে রামকুণ্ড, লক্ষণকুণ্ড ও হনুমান মন্দির সেই পৌরাণিক স্মৃতি বহন করে।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ের প্রতিটি খাঁজে, প্রতিটি ভাঁজে ছড়িয়ে আছে তীর্থস্থান। ৭টি মন্দির ও ৬টি ধর্মশালা নিয়ে এই পাহাড় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে কতটা পবিত্র, তা সহজেই অনুমেয়। প্রতি বছর শিবচতুর্দশী উপলক্ষে মাত্র তিন দিনেই প্রায় ১৫ লাখ ভক্তের সমাগম হয় এখানে, যাদের জন্য সরকারকে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হয়।

নামাজ পড়ার জন্য তো জায়গার অভাব নেই। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থস্থানগুলোর একটিতে অন্য ধর্মের উপাসনালয় তৈরির চিন্তা কেবল উসকানিই নয়, এটি সহমর্মিতার সম্পূর্ণ বিপরীত একটি কাজ।

কেন এখানে উপাসনালয় বানানোর ভেতর হেডম আর আইডেন্টিটি ক্রাইসিস দেখতেসি জানেন?

ঠিক যেই কারণে কাউকে 'মেরি ক্রিসমাস' বললে পনেরশ বছর পুরাতন ধর্মের অনুসারীদের ভেতরের অত্যন্ত সামান্য একটা দল 'অক্ষরবাদী'রা ট্রু ইসলাম শেখানোর প্রবল প্রয়োজন ফিল করেন, নিজের ট্রু রিলিজিয়নটা 'ভুলভাবে প্রচারিত হচ্ছে' এমন ভাইব পান, ক্রাইসিস ফিল করেন৷ কিন্তু ক্রিসমাসের স্পেশাল অর্ডারে গারমেন্টসের কাপড় বিক্রি করে টাকা কামাইয়ের ডায়নামিক্সের আলাপ দিতে একই 'অক্ষরবাদী'র যে প্রবল অনীহা, এই জায়গায় না ঢুকলে আজকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আজান দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা কিংবা সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষার ডায়নামিক্স বোঝা যাবে না।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারা মুসলমান মানুষ যেই ন্যাশনাল, রিলিজিয়াস এবং লিঙ্গুইস্টিকাল স্বাধীনতা উপভোগ করেন এমন স্বাধীনতা গোটা দুনিয়ায় উপভোগ করতে পারে খুব অল্প জাতি।

অনেকে হয়তো আমার কথাটা বুঝতে পারেননি। আরেকবার বলি। 'বাঙালি মুসলমান গণ'টি বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রে যেই 'যথেচ্ছ স্বাধীনতা' উপভোগ করে, সেটা এমনকি একজন ইংরেজিভাষী খ্রিষ্টান ব্রিটিশ নাগরিকও আজকের দিনে উপভোগ করতে পারেন না। একজন আরবি ভাষাভাষী আরব মুসলিমও পারেন না।

এজন্যই জাতি রাষ্ট্রের ক্লাসিক্যাল উদাহরণ টানতে গেলে বাংলাদেশের উদাহরণ সবার আগে দিতে হয়। আসেন বিষয়টাকে ভেঙে ভেঙে বুঝি।

আপনারা যারা বিদেশে থাকেন। ভাষায় একটু দুর্বল। মনে মনে ক্রমাগত অনুবাদ করতে থাকা যে কি কষ্টদায়ক একটা বিষয় সেটা আপনারা ভালো জানেন। আপনারা কি বোঝেন এই দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে প্রথম শহরে আসে তাদের মাথায় ক্রমাগত তাদের ভাষা আর বাংলা ভাষা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আমার হাত ধরে একবার একটা আদিবাসী ছেলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলো। বলছিল, ‘ভাই আপনি-তুমি ভুল করে ফেলি চার বছর পরেও। কথা বলতে ইচ্ছা করলেও বলি না, কারণ ভুল মিনিং হয় যদি!’ আছে কি বাংলাদেশের ৯৫% মানুষের এই অনুভূতি?

আমাদের কোন ধারণাই নেই, আইডিয়াই নেই এই ক্রমাগত অনুবাদের কষ্ট কেমন সেটা নিয়ে।

এই যে অধিকাংশ মানুষের এই প্যারাটা নাই, এটা খুব খুব কম দেশের ভাগ্যবান মানুষ পেয়েছেন। নিজের মায়ের ভাষাকেই রাষ্ট্রের অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে পেয়েছেন। ভূপেন হাজারিকার মতো মানুষকে অসমীয় "বুড়া লুইত বোয়া কিয়" কে অনুবাদ করে "গঙ্গা বইছো কেন" গাইতে হয়েছে।

এই যে পূজার সময় আসলেই দেশের মণ্ডপে মণ্ডপে ভাঙচুর হয় সেটাতে আপনার হিন্দু বন্ধুর মনে যেই কাঁপন ওঠায় সেটা আপনি যতোই বুঝি বুঝি বলেন, আপনি বোঝেন না ভাই।

যতোই ফিলিস্তিনি বা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য আপনার কান্না পায় বলে আপনি দাবী করেন, আপনি আসলেই 'জয় শ্রীরাম' না বলার কারণে মারতে মারতে রক্তাক্ত করে ফেলা মুসলিম বৃদ্ধের বেদনাটা টের পান না। টের পেলে গদাধারী ইকবাল আপনার মনে সমান কাঁপন ধরানোর কথা। শত মন্দিরের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আজানের ধ্বনি আপনাকে বাবরি মসজিদের লাগোয়া এলাকার মুসলমানদের আহাজারির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার কথা।

জেলে রসরাজ কিংবা ঝুমন দাসের চেহারা ভালো করে দেখলেই আপনি বুঝতেন তাদের চোখে তারা মৃত্যু দেখেছেন। আপনি আমি সেটা দেখতে পাই না কারণ আমাদের ভেতর এম্পেথি নাই।

এই যে আদিবাসীদের বাঙালি হয়ে যেতে বলা আর হিন্দুদের প্রতিমা নিয়ে মশকরা করা এগুলা হচ্ছে টেরিটরিয়াল মাস্তানি। স্রেফ হিংসাত্মক মাস্তানি। এই মাস্তানি আপনার আমার সাথে ব্রিটিশরা করেছিলো। তারা ভারতের মানুষকে ‘কালো’ আর ‘অশিক্ষিত’ বলতো। বিভিন্ন স্থানে কুকুর আর ইন্ডিয়ানদের প্রবেশাধিকার ছিলো সীমিত।

একশ বছর আগে আমাদের ওপর যেই নিপীড়ন চলতো, এখন এই সময়ে এসেও আপনি আমি যখন নির্লজ্জের মত বলে ফেলি, ‘তোদের ধর্ম তো মিথ্যা আমাদেরটাই একমাত্র সত্য’ যখন বলি ‘তোমরা উপজাতি আমরা বড়জাতি’ তখন আসলে ব্রিটিশদের সাথে আমাদের আর কোন পার্থক্য থাকলো না।

ওরাও ভেবেছে ওদের জাতিই সেরা, বাকিরা নিচুজাতি, উপজাতি।

তো বাহাইজম নামের একটা ধর্ম আছে দুনিয়ার বুকে। এটা আঠারো শতকের একটা মতবাদ। এনারা কিন্তু নিজেদের কাদিয়ানি বা আহমদিদের মতো মুসলমান দাবী করেন না। এনারা একটা স্বতন্ত্র নন-মুসলিম গোষ্ঠী।

তাদের কয়েক কোটি অনুসারী আছে সারা দুনিয়ায়। ঢাকার মগবাজারে একটা বাহাই সেন্টারে বাংলাদেশি বাহাই কমিউনিটির লোকজন তাদের প্রার্থনা করে থাকেন।

মজার বিষয় হচ্ছে গিয়ে, বাহাইজম একটা সেমেটিক রিলিজিয়ন। এই ধর্ম আদম, ইদ্রিস, নূহ, ইব্রাহিম, মূসা, ইয়াহিয়া, ঈসা সব নবীর ওপর ঈমান আনাকে বাধ্যতামূলক করে, এমনকি তাদের ধর্মমতে নবী মোহাম্মদের ওপরেও ঈমান আনাটা ফরজ, বাধ্যতামূলক।

মানে নবী মোহাম্মদকে নবী না মানলে একজন মানুষ বাহাই হতে পারবেন না। শুধু পার্থক্য হচ্ছে যে, তারা মনে করে নবী মোহাম্মদের পরেও আরও নবী এসেছে। এবং নবী বাহাউল্লাহ সর্বশেষ নবী।

তাদের দাবী কি সত্য দাবী নাকি মিথ্যা দাবী সেটা নিয়ে পরে আলাপ হবে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই তাদের ধর্ম মিথ্যা কিন্তু তারা যেহেতু আদমের সমস্ত নবীদের স্বীকার করেছেন, ফলে তারা সেমেটিক। ঠিক যেই যুক্তিতে মুসলমানদের মতে খ্রিষ্টধর্ম মিথ্যা হলেও তারা সেমেটিক এটা মুসলমান মেনে নেয়।

বাহাইজমের একটা সুন্দর দিক হচ্ছে আদম, ইব্রাহীম, ঈসা নবী এবং মোহাম্মদ নবীকে স্বীকার করার পাশাপাশি তারা বুদ্ধ, রাম, গুরু নানক, জরাথ্রুষ্টকেও ঈশ্বরের অবতার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

যেমন করে অনেক ইসলাম ধর্ম প্রচারক যেমন বাইবেল থেকে নবী মোহাম্মদের আসার ইঙ্গিতকে খুঁজে পেয়েছেন, যেমন করে খ্রিষ্টানেরা তাওরাতে মসীহ যীশুর আগমণের ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছেন, বাহাইজমের অনুসারীরা তেমনভাবে কোরআন থেকে আরও নবী আসার ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছে।

আবারও বলছি এখানে সত্য-অসত্যের তর্ক হচ্ছে না, বলছি যে আপনার পরিচিত এই পৃথিবীতে কেবল আপনার কিতাবেই শুধু উল্লেখ করা হয়নি আপনার নবীই শেষ নবী, আরও অনেক কিতাবে লেখা আছে যে আপনার নবীর পরে নবী এসেছে এবং তাদের মতে তিনিই শেষ নবী।

মুসলমান ধর্ম প্রচারকরা বাইবেলে মহানবীর ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়ার পরেও পৃথিবীর অধিকাংশ খ্রিষ্টধর্মে অনুসারী মানুষ এখনো ইসলামে দিক্ষিত হয়নি। সংখ্যাগুরু খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী রাষ্ট্রগুলো এই সময়ে এসে মোর অর লেস 'যার যার ব্যক্তিগত ধর্ম পালনের স্বাধীনতা'য় বিশ্বাস করে থাকে।

যেকোন এক্স, ওয়াই, জেড নিজের ধর্ম প্রচারের অধিকার এই দুনিয়ায় রাখে।

এতো আলাপের কারণ একটাই। বাহাউল্লাহ যেমন আপনার কাছে ভণ্ড নবিয়ুতের দাবীদার, দুঃখজনক হলেও ইহুদি-খ্রিষ্টানদের কাছে আপনাদের নবীও তেমনই একজন। এখন অধিকাংশ মানুষ না মানলেই নবী মোহাম্মদের নব্যুয়তের দাবী যেমন খারিজ হয়ে যায় না, ঠিক একই যুক্তি বাহাউল্লাহর ক্ষেত্রেও খাটে।

এতো কথা বলার কারণ হচ্ছে জাস্ট বিকজ আপনি সংখ্যাগুরু- আপনি রাস্তাঘাটে, আড্ডায়, ক্লাসে, মসজিদে, মন্দিরে কোন যায়গায় অন্য ধর্মের মানুষকে বলবেন না- ওনার ধর্মটা মিথ্যা আর আপনার ধর্মটাই একমাত্র সত্য। আপনি অন্য মানুষদের আগ বাড়ায়া বলবেন না যে আপনার নবীই শেষ নবী।

অন্য ধর্মের মানুষেরা যদি আপনার সামনে এসে বলা শুরু করে আপনার নবীর পরেও তো অমুক নবী এসেছেন যার কোটি কোটি অনুসারী আছে, তখন আপনার কেমন লাগবে?

একটু ফিল করেন তো কেমন লাগে! রাগ হচ্ছে না?

আচ্ছা এখন ভাবেন তো এই দেশের খ্রিষ্টানদের রাগ হয় না?

তাদের সামনে সারাদিন বলতে থাকেন আপনার ইসলাম ধর্মই সেরা তখন তাদের কেমন লাগে? ঠিক একই অনুভূতি হয় না?

আপনার ভেতর এই এম্পেথির অনুভূতিটা জাগিয়ে তুলতেই এই একেবারে পার্সোনাল বিষয় নিয়ে আলাপ করা।

একটা প্রাইমারি ক্লাসের দুধের বাচ্চাকে যখন ক্লাসের টিচারদের কাছ থেকে, ক্লাসমেটদের কাছ থেকে দিনের পর দিন শুনতে হয় তার ধর্ম ভুল, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করা হতে থাকে সংখ্যাগুরু কমিউনিটি থেকে, তখন সেই বাচ্চাটার কেমন লাগে? তার তো কিতাবে কি লেখা আছে সেটার সত্য মিথ্যা বোঝার মত বুঝও আসে নাই।

আবার সেই একই মানুষেরাই সিরিয়ার ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্য, ফিলিস্তিনির এতিম শিশুদের জন্য কান্নাকাটি করে।

আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন ফিলিস্তিনির এতিম শিশুর জন্য তার আসলেই দুঃখ আছে?

ইহুদিদের তথাকথিত 'সত্য ধর্ম' রক্ষার জন্য তাদের দৃষ্টিতে 'মিথ্যা মুসলমান'দের কষ্ট দেয়ার যে আকাঙ্ক্ষা- তার সাথে দুর্গা পূজা শুরু হবার আগেই সত্য ধর্মের মুসলিমদের একত্রিশ মণ্ডপের 'মিথ্যা প্রতিমা'র মুণ্ডু নাই করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষার কোন গুনগত পার্থক্য আছে কি? কোন পার্থক্য আছে লোক-কথায় প্রচলিত রামের স্মৃতিবিজড়িত পাহাড়ে আজান দিতে চাওয়া মানুষের?

সেদিন এক বন্ধুর কাছে গল্প শুনলাম। ঘটনাটা সত্য। দুই মুসলমান বান্ধবী কলেজে পড়তেন। তাদের একজনের বিশেষ কোনো কারণে খ্রিষ্টান ধর্ম খুব পছন্দ হয়ে গেলো। এতোই পছন্দ হল যে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ধর্মান্তরিত হবেন।

দু'জন মিলে একদিন গেলেন কাকরাইল চার্চে।

তারা দু'জন কাকরাইল চার্চের ফাদারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফাদারকে তারা বললেন, তাদের একজন খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে চান।

এই কথা শুনে ফাদার হেসে ফেললেন, বললেন, কেন? আপনার ধর্মে কি সমস্যা? আপনার ধর্মে এমন কি নেই যা এই ধর্মে আছে?

আপনার ধর্ম কি কোনো অন্যায় কাজ করার অনুমতি দেয়? মিথ্যা বলা, চুরি করা, অন্যর ক্ষতি করার কথা নিষেধ করে না? আপনার ধর্মে কি রোগীকে সেবা করতে, দরিদ্র ব্যক্তিকে সহায়তা করতে, বাবা-মায়ের সেবা করতে, সৎ পথে চলতে বলে না?

মেয়েটা হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে ফাদার বললেন, তাহলে কেন আপনি নিজ ধর্ম ছেড়ে আরেক ধর্ম গ্রহণ করবেন?

সবার ধর্মের লক্ষই সৃষ্টির সেবা করা। আমি উপাসনা করি, কেউ পূজা করে আর আপনি ইবাদত করেন। কেউ চার্চে করেন, কেউ মন্দিরে করেন কেউ মসজিদে করেন।

সেই বন্ধুরা সেদিন কাকরাইল চার্চ থেকে ফিরে আসলেন। ধর্ম তাদের পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু মন আলোকিত হয়েছিলো।

এই গল্প বলে আমি বলছি না মিশনারিগুলো কোথাও জোর করে ধর্মান্তর করে না, আমি অস্বীকার করছি না ক্রুসেডকে। আমি কেবল বলতে চাইছি সব ধর্মের অন্তরে ধ্বনিত বাণী একই। সেটা হচ্ছে এম্পেথি। ভূপেন হাজারিকা তাই সেই সাদা মানুষের গানে গেয়েছেন-

"এই দুনিয়া হয়নি সৃষ্টি, স্রষ্টা ছাড়া

একই সুর্যের আলোয় সবার দৃষ্টি ভরা

একই মেঘ আর বৃষ্টিতে আল্লাতালার সৃষ্টিতে

সকল মানুষ বেঁচে আছি যদি ধরো

তবে কেনো গরব করো!"

ইসলামের ভেতরের এম্পেথির উপাদানগুলোকে খুব ভালো করে ধরতে পেরেছিলেন এই অঞ্চলের যেই মানুষটি তাঁর নাম গুরু নানক।

গুরু নানকের প্রবর্তিত শিখধর্মটা অনুপ্রাণিত হয়েছে কোরআনের অসংখ্য আয়াত দ্বারা। শিখদের সর্বোচ্চ ধর্মগ্রন্থ 'গুরু গ্রন্থ সাহেব'-এ একটা উপাধ্যায় আছে ‘সত্যিকারের মুসলমান হওয়া’।

গুরু নানকের সাথে তাঁর ঈশ্বরের কথাবার্তায় ইসলাম নিয়ে অনেক আলাপ উঠে এসেছে। মুসলমানদের বিষয়ে অনেক অবজারভেশন উঠে এসেছে। কিভাবে একজন ভালো মুসলমান হতে হবে সেই বিষয়ে পরামর্শ গ্রন্থ সাহেবে আছে। নবী মোহাম্মদের সম্পর্কে দারুণ সব আলাপ আছে। এবং একজন শিখকে সেই গ্রন্থটা আবশ্যিকভাবে পাঠ করতে হয়।

ফলে আমাদের ভেতরে অনেকেই যারা আউটরাইটলি ধর্মের মহৎশিক্ষাগুলোকে ছোট করতে চান তারা যদি একটু উদার হয়ে দেখতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন প্রতিটা শিখ আসলে নবী মোহাম্মদের শিক্ষাকেই আপলিফট করছেন। আপনি বুঝতে পারতেন শিখ লোকটিও আপনার ধর্ম ভাই-ই।

আপনাকে বুঝতে হবে, মানতে পারতে হবে যে- একজন শিখের নিজের ধর্ম পালনের খাতিরেই ইসলাম নিয়ে কথা বলার অধিকার আছে। কারণ ওর কিতাবেই এর উল্লেখ আছে। এটাতে আপনার ব্যাজার হবার কিছু নাই। আপনি হইতে পারেন না ব্যাজার।

আপনি যেমন জায়নামাজে কোরআন পড়তে পড়তে অশ্রুপাত করেন, একজন শিখও গ্রন্থ সাহেব পড়ে কাঁদেন। সেই কিতাবে যখন আপনার নবীর কথা উল্লেখ থাকে, বলা থাকে নবীর শুভশিক্ষার কথা- তখন আপনার চোখও আর্দ্র হয়ে আসার কথা নয় কি?

আসুন গুরু গ্রন্থ সাহেবের সুন্দর একটা অনুচ্ছেদ দেখে নেয়া যাক-

‘নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করা সহজ কাজ নয় হে নানক। যদি কেউ সত্যিকার অর্থেই নিজেকে সমর্পণ করতে পারে কেবল তখনই তাকে মুসলমান বলা যেতে পারে। একজন সত্যিকারে মুসলমান হতে হলে প্রথমত নবীর সুন্দরতম দ্বীনকে আস্বাদন করতে পারতে হবে মিষ্টির মতো করে। তারপর নিজের ব্যক্তিগত সমস্ত গৌরব আর সমস্ত অহংকারকে মুছে ফেলতে হবে অন্তর থেকে।

হযরত মুহাম্মদের একজন সত্যিকারের অনুসারি হতে হলে তোমাকে মৃত্যু ও জীবনের মোহকে ত্যাগ করে তাঁকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতে পারতে হবে। যদি কেউ নিজেকে পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করতে পারে এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে রিক্ত এবং শূন্য অবস্থায় আত্মসমর্পণ করতে পারে কেবল তখনই সে স্বার্থপরতা এবং অহংকার থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারবে।

এবং হে নানক, কেউ যখন সমস্ত প্রাণের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারবে, কেবল তখনই তাকে মুসলমান বলা যাবে।‘

(শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহেব / আন্তর্জাতিক সংস্করণ)

দেখেন এতো সুমধুর শব্দ পাঠ করার পর কি আপনার বুঝতে কোন সমস্যা হচ্ছে গুরু গ্রন্থ সাহেব ইসলাম থেকে এম্পেথিটাকেই বেছে নিয়েছে।

কেবল এম্পেথি দিয়ে দেখলে পরেই বোঝা যাবে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মসজিদ নির্মাণ কেন বিপদজনক, কেন এই উদ্যোগটি নেওয়া অনুচিত।

সহমর্মিতা না থাকলে কোনভাবে কোন যুক্তি দিয়ে আপনাকে এই বিপদটা বোঝানো সম্ভব না।

কারণ ধর্ম বিষয়টা যুক্তির না, সম্মানের, শ্রদ্ধাবোধের।

১৫৫৫ পঠিত ... ১১ ঘন্টা ৫৬ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top