ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বতীকালীন সরকারের একবছর পূর্ণ হলো। জুলাই বিপ্লবের ম্যান্ডেটে এই সরকার গঠিত হলেও; বাংলাদেশের মালিকানা যেহেতু পালা করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পৈতৃক; তারা দয়া করে দেশের মানুষকে থাকতে দেয়; ফলে আওয়ামী লীগ বিতাড়িত হলে বিএনপির মধ্যে সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট এসে পড়ে; দেশটা আমাদের; কী একটা ঝামেলার অন্তর্বতীকালীন সরকার হয়ে বসে আছেন; চাচা আপনে যান; আমগো ক্ষমতা আমগো বুইঝা নিতে দেন।
ফলে ক্ষমতার পাওনাদার হিসেবে তারা সকাল-বিকাল ইউনুসকে মনে করিয়ে দিতে থাকে, ইলেকশন কবে দিতেছেন!
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইউনুসের হলেও বিশ্ববিদ্যালয় ও জনপ্রশাসনের দখল নিয়েছেন বিএনপির ক্যাডাররা। তাদের যুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দেড় দশক আওয়ামী লীগ দখল করে রাখায় আমরা বঞ্চিত হয়েছি। কাজেই এইবার আমাদের পদায়িত করুন। এটা একটা সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট বা প্রাধিকারের ধারণা। ৫ অগাস্টের সুফল খাওয়া জামায়াতও আছে কিছু এই বিএনপির সুফলখেকোর দলে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসন থেকে বাজার কমিটি, জল মহাল, বালু মহাল, স্কুল ও কলেজ কমিটি, বাংলাদেশের জল স্থল অন্তরীক্ষে বিএনপি রাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫ অগাস্ট রাত থেকেই।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন ঘটলে জনপ্রিয় জেনারেল জিয়াউর রহমানকে যেমন রাষ্ট্রক্ষমতায় অভিষিক্ত করা হয়েছিলো; ঠিক তেমনি ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত পতন ঘটলে বিএনপির জনপ্রিয় নেতাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অভিষিক্ত করা কেন হলো না; এই প্রশ্ন মনে নিয়ে বিএনপি নেতারা সংস্কার নিয়ে কৌতুক রচনা শুরু করলেন। কেউ কেউ আগামী ৩০ বছর ক্ষমতায় বিএনপি থাকবে বলে মন্তব্য করলো। ৫ অগাস্টের আগে যেসব সাংবাদিক, ফেসবুকার বাংলাদেশ প্রেমের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন; তারা ৫ অগাস্টের পর থেকে বিএনপি প্রেমের অধিনায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। কোন কোন সাংবাদিক জ্যোতিষী হয়ে গিয়ে বলতে শুরু করলেন, বিএনপি কমপক্ষে দশবছর ক্ষমতায় থাকবে।
ড ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানে, আওয়ামী লীগের প্ররোচণায় ধসে যাওয়া পুলিশ বাহিনী, চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া প্রধান হিসেবে বিএনপির কাউকে বসিয়ে ভেতরে আওয়ামী লীগের ছুঁচোর কেত্তন। জনপ্রশাসন বিএনপির জন্য বরণডালা নিয়ে উন্মুখ। ড ইউনুসের নির্দেশ মানতে তাদের বয়েই গেছে।
এরমাঝেও অর্থ উপদেষ্টা দেশের রিজার্ভ স্থিতিশীল করেছেন, আগের যে কোন সময়ের চেয়েও বেশী বিদেশী ঋণ শোধ করেছেন। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর আওয়ামী লীগের লুন্ঠনে রুগ্ন ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন। জিনিস পত্রের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। আওয়ামী লীগের কালো টাকার অর্থনীতির পতনের কারণে মানুষের উপার্জন কমেছে, তাদের লুণ্ঠক কারখানা মালিক পলাতক হওয়ায় শ্রমিকেরা কাজ হারিয়েছে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতি বসন্তে ধুলোমুঠি সোনামুঠি হওয়া আর শুয়োরের বাচ্চার অর্থনীতিকে অপেক্ষাকৃত কম দুর্নীতি বা প্রায় মানুষের বাচ্চার অর্থনীতি বানানোর ট্রাঞ্জিশনাল সময় ছিলো গত একটি বছর।
বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যখন হিটলারের নাতসি বাহিনীর মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত তখন আইন উপদেষ্টার পক্ষে অত্যন্ত দুরুহ একটি কাজ ছিলো অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। একটা দেশের প্রায় বিশ শতাংশ মানুষ যখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের অপরাধের অংশীজন; গত একবছরে ছাত্রজনতা হত্যার কোন অনুশোচনা নেই তাদের মাঝে; আইন উপদেষ্টার জন্য ন্যায় বিচার ও রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে পড়েছে সেই বাস্তবতায়। তবে বেশ কিছু আইন সংস্কার তিনি করেছেন; দেশের মানুষ যার সুফল ভবিষ্যতে পাবে।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা দেরীতে দায়িত্বে এলেও তিনি সার্বিকভাবে সফল হয়েছেন জুলাই বিপ্লবের ইতিহাস প্রামাণিকরণ ও বহুত্ববাদী স্বকীয় সংস্কৃতি চর্চার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরে।
পরিবেশ উপদেষ্টা, নৌপরিবহন উপদেষ্টা, নারী উপদেষ্টা, সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সক্রিয়তা জারি রেখেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পরের বছরে কোন দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী দোজখ থেকে বেহেশত রচনা করতে পারেননি। সুতরাং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে নিয়ে বড় কোন প্রত্যাশা থাকা অবাস্তব। শিক্ষা উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ৫৪ বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে বিনাশ ঘটানো সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্যাডাররা পালাকরে এই দুটি সেক্টরকে জিম্মি করে রেখেছে। জুলাই বিপ্লবের দুই তরুণ উপদেষ্টা বয়সের তুলনায় ভালো পারফর্ম করেছেন। বিশেষ করে যখন ৫ অগাস্ট রাত থেকেই পরাজিত আওয়ামী লীগ ও জয়ী নাগরিক সমাজ জুলাই তরুণদের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত ছিলেন।
পনেরো বছর ধরে ফ্যাসিস্টের দাবড়ানি খেয়ে কুসুম কুসুম প্রতিবাদ করা অথবা বিমূর্ত বাক্য লেখা বিশিষ্টজনেরা গত একটি বছরে ইউরোপের রেনেসাঁ থেকে এনলাইটেনমেন্টে পৌঁছে দিয়েছেন সবাইকে। একটি বিপ্লবকে সমর্থন করে; সেখান থেকে ফুটেজ খেয়ে সেলিব্রেটি হয়ে ওঠা লোকেরা বিপ্লবের ম্যান্ডেট নিয়ে তৈরি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বাক্যবাণে জর্জরিত করেছেন। এরা ইউটোপিয়ান মানুষ; এরা ছাইগাদার মধ্যে হয়তো মাত্র একবছরে ফিনিক্স পাখি উড়তে দেখতে চেয়েছিলেন। পনেরো মিনিটের খ্যাতির নেশা নিয়ে কেউ কোন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না।
গত একবছরে সবচেয়ে বিরক্ত করেছে কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁর উপজাত হিন্দুত্ববাদী কালচারাল উইং বনাম হাসিনার কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া ইসলামপন্থীরা। আমরা যখন ফ্যাসিস্টাহত একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠন নিয়ে ব্যস্ত; মোদি প্রগতিশীল ও মওদুদী ধর্মশীলেরা তখন পারস্পরিক বিদ্বেষ ও খেলনা শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই করে অনেক বিরক্ত করেছে আমাদের।
আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র; টি এস এলিয়টের ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট পড়ে; লালন ও লেননের সেতুবন্ধ তৈরির চেষ্টা করেছি মনোজগতে। হিউম্যানিটি আমার ভালোবাসার বাগান। ফলে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি ও ইসলামপন্থী সংস্কৃতির মতো ধর্মীয় চিহ্ন সম্বলিত জনগোষ্ঠী আমার ইনগ্রুপ নয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মনে হতো; এই যে যারা হিন্দুত্ববাদী ও ইসলামপন্থী সংস্কৃতি চর্চা করছে; এদের সবাইকে নিয়ে বহুবর্ণময় সংস্কৃতি বাগান আমাদের। আমার চোখে জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতো নক্সী পাঞ্জাবি পরে কুঁচি দেয়া শাড়ি পরে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া মানুষ আর দাড়ি টুপি কিংবা হিজাব পরে হামদ ও নাত গাওয়া মানুষের জীবন চর্যাকে একই রকম সুন্দর লেগেছে। কারণ উভয়েই সত্য সুন্দর ও মঙ্গলের চর্চা করছে। একটা ফুলের বাগানে নানা রঙ -এর ফুল না থাকলে তা বিবর্ণ বাগান হয়ে পড়ে।
ভারতের মিডিয়াকে ধন্যবাদ যারা হিন্দুত্ববাদের ফ্রি পাস নিয়ে বসে থেকে, ড ইউনুস ইসলামপন্থাকে ফ্রি পাস দিয়েছে বলে বহু ব্যবহারে জীর্ণ বয়ান জারি রেখেছেন। দেখেন কষ্ট মষ্ট করে পূর্ব বঙ্গের হারানো জমিদারি ফেরত পাওয়া যায় কিনা।
আওয়ামী লীগের কালচারাল উইংকে ধন্যবাদ এক বছরের মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণের ঢোল বাজানোর তাদের যে অর্ধ শতকের অভ্যাস; তা বজায় রেখে গত এক বছরে প্রাণান্ত এক ঢুলির রুপ পেয়েছে যেন। বুমারস, জেনেক্স ও সিনিয়র মিলেনিয়ালদের অভিনন্দন তারা ‘চব্বিশ দিয়ে একাত্তর মুছে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে’ এই ন্যারেটিভ একশবার বলতে বলতে একাত্তর দিয়ে জুলাইকে মুছে দিতে অনেকটা এগিয়েছেন তারা। ইতিহাস কি মোছা যায়? বাংলাদেশের মানুষ একাত্তরের সন্তান হারানোর স্মৃতির মধ্যে একাত্তরকে বাঁচিয়ে রেখেছে; জুলাইয়ে সন্তান হারানোর স্মৃতির মাঝে জুলাইকেও বাঁচিয়ে রাখবেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা কলকাতায় বিশ্রামাহত ও উত্তেজিত ছিলেন; আর জুলাইয়ে যারা শীতাতপ কক্ষে পিসির সামনে বসে উত্তেজিত ও পেন্ডুলাম ছিলেন; তাদের একাত্তর মোছার জুজু।
আমাদের জাতির ইতিহাস হচ্ছে ১৯৪৭, ১৯৭১, ১৯৯০, ২০২৪-এ প্রতিটি বাঁকে স্বদেশের জন্য লড়াই করা তরুণদের সলিম বুঝ দিয়ে ক্ষমতাহীন করে; জাঢ্য জরদগব প্রবীণ ও মাঝবয়েসীর দেশ লুন্ঠন ও রাজনীতির নামে কসাই কারবার চালানোর ইতিহাস। তারুণ্য হত্যা আমাদের নিয়তি। এলেগেরিক্যালি এটা সেই ওডিপল কনফ্লিক্ট যেখানে প্রবীণ গোষ্ঠীপিতা গোত্রের সমস্ত তরুণী সম্ভোগের মনোপলি সংরক্ষণ করেন। এখানে তরুণী শব্দটিকে ক্ষমতা পড়ুন। সেই যে আবদুল্লাহ উপন্যাসে বৃদ্ধ পীর তার পরিবারের এক বিস্ময় বালককে দেখে বলেন, এক ঘারমে দো পীর, যাও বাছা সো রাহো।
আমি ভেবেছিলাম ফ্যাসিস্টের পতন দেখে পুরোনো রুলিং এলিট ও কালচারাল এলিটের কিছু শিক্ষা হয়েছে। কিন্তু গত এক বছরে তাদের আচার আচরণ দেখে মনে হলো, ২০২৪-এর তারুণ্য যদি আওয়ামী ফ্যাসিস্টকে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে; ২০৩০-এর তারুণ্য নিশ্চয়ই সে সময়ের গাজোয়ারি নতুন ফ্যাসিস্টকে বঙ্গোপসাগরে জাহাজে তুলে দিতে পারবে। জুলাই বিপ্লব কোনোকিছুর শেষ নয়; সেটা আসলে শুরু।
পাঠকের মন্তব্য