আওয়ামী লীগ ও বিজেপি কাপলটির বড্ড জায়নিস্ট হবার বড্ড শখ

১১৪ পঠিত ... ১৭:৩৫, আগস্ট ০৭, ২০২৫

আওয়ামী লীগের ৭২-৭৫-এর দেশলুণ্ঠন, দখলবাজি, কমপক্ষে দশ হাজার তরুণ হত্যা, দুর্ভিক্ষে অগণন মৃত্যু, হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন, পররাষ্ট্র নীতিতে নাক গলানো, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী দিয়ে রচিত সংবিধান, অবশেষে বাকশাল গঠনের মাধ্যমে নিরংকুশ স্বৈরাচারের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ; এরকম একটি ব্যর্থ ও ভয়ংকর শাসনকালের ইতিহাস মুছে দিতে লেখক, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক নিয়ে আশির দশকে গড়ে ওঠে আওয়ামী কালচারাল উইং। কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁ যেভাবে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতিকে বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে বিনির্মাণ করে ছিলো; তারই ধোলাই খাল সংস্করণ গড়ে ওঠে ঢাকায়।

অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাক গ্রাউন্ডের তরুণ-তরুণীরা এসময় শেখে, বাঙালি হতে গেলে কলকাতার মতো হিন্দু সাজগোজ করে ঘুরলে তা আধুনিক; অন্যদিকে মুসলমান সাজগোজ করে ঘুরলে তা বড্ড অনাধুনিক। এইভাবে ঢাকা ঠিক কলকাতার মতো অষ্টাদশ শতকের বাবু কালচারের এক শহর হয়ে ওঠে। 

এই বাবু কালচার একটা মিথ্যা একশবার বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে, আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সাধু ও সোনার বাংলার মালিক। মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক বলয় ব্যবহার করে; আর ভারতীয় মিডিয়া প্রোপাগান্ডা সম্বল করে কম্বল চুরির সত্যকে শ্রী কৃষ্ণের মাখন চুরির রোমান্টিকতা দেয়।

সুলতানী-মুঘল ও নবাবী আমলে হিন্দু-মুসলমান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিলো পূর্ববঙ্গে। কিন্তু বৃটিশ আমলে হিন্দুদের জমিদারি দিয়ে তাদের দিয়ে মুসলমানদের নিষ্পেষণ করে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি ঘটানো হয়। বৃটিশের সামান্য মুন্সী, সেরেস্তাদার, কেরানিরা অভিজাত সমাজ হিসেবে আবির্ভুত হয়। আরবি-ফারসি শিক্ষাকে বাতিল করে ইংরেজি শিক্ষা চালু করে হিন্দুদের নতুন একটি শিক্ষিত শ্রেণী তৈরি করা হয়। তখন থেকেই হিন্দু জনগোষ্ঠীর মনে ফাঁপা অহম গড়ে তোলা হয়, তারা সবার চেয়ে শিক্ষিত। আর অখণ্ড ভারতের মালিক কেবল হিন্দুরাই।

একই ভূখণ্ডের মানুষ; একই রকম শরীরের গঠন ও মুখমণ্ডল। কিন্তু কল্পনায় নিজেদের বড় ভাবতে ভাবতে একসময় আর্য ভাবতে শুরু করে। এই যে হিন্দু ব্র্যান্ডিং; এই যে উচ্চ-নীচ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সংস্কৃতবান-অসংস্কৃতবান মাপামাপির একটা স্বপ্রণোদিত ম্যানেজারি; এটিই বেঙ্গল রেনেসাঁর উপজাত। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর মুসলমানের ছেলেরা হিন্দুদের কাছ থেকে উচ্চ-শিক্ষিত-সংস্কৃতবানের সার্টিফিকেট পেতে কলকাতার ভাষা ও সংস্কৃতি রপ্ত করতে শুরু করে। কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁর লোকেদের অবসর বিনোদন ছিলো, মুঘল ও নবাবী আমলের শাসকদের নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা; এরপর ক্রমান্বয়ে পূর্ববঙ্গের মুসলমানকে নিম্নবর্গের বলে তকমা দেয়া। অথচ মুঘল ও নবাবী আমলে বিশ্ববানিজ্য কেন্দ্র ছিলো পূর্ববঙ্গ। বঙ্গোপসাগর ছিলো পৃথিবীর নানা দেশের সওদাগরি জাহাজের কাংক্ষিত গন্তব্য। বৃটিশ এসে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে প্রায় এক কোটি মানুষ হত্যা করে; ও বাকিদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে, ব্যবসার আড়ং উচ্ছেদ করে; তাদের হতদরিদ্র বানালে; পূর্ব বঙ্গের কৃষক কারিগরের রক্ত শুষে তৈরি করা কলকাতা তখন পূর্ববঙ্গের মানুষকে নিম্নবর্গের বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য শুরু করে।

এদের অনুকরণে দেখবেন, ঢাকার তরুণ তরুণীরা একটু ফর্সা কাপড় পরে কফি খেতে শিখলে আর দু চারটি ইংরেজি বই পড়লে; দেশের মানুষকে বাঙ্গি, ফইন্নি, গরিব ইত্যাদি বলে; এগুলো এরা শিখেছে বেঙ্গল রেনেসাঁর বংকিমচন্দ্র ও শরতচন্দ্রের কাছে।

পূর্ব বঙ্গের কৃষক প্রজা আন্দোলনের ফলে জমিদারি ব্যবস্থার অবসান ঘটলে কলকাতা জমিদারি হারানোর বেদনা ভুলতে পারে না। ভারতের একদা বাম এরপর কংগ্রেস হয়ে বিজেপির ভক্ত প্রণব মুখার্জি দিল্লিতে শেখ হাসিনাকে ব্যাপ্টিজম করে বাংলাদেশে পাঠান হারানো জমিদারি পুনরুদ্ধারে। হাসিনা ১৯৯৬-২০০১-এ ঠিকমতো সেটা না পারলেও ২০০৯-২৪-এ সেটা ঠিকই পেরেছিলেন। ফলে অখণ্ড ভারত হয়েই গেছে এমন একটি আত্মতৃপ্তি ছিলো সুজাতা সিং-নরেন্দ্র মোদিদের চেহারায়।

কলকাতার হিন্দুত্ববাদী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ১৯৪৭ সালে অখণ্ড বাংলা স্বাধীনতা উদ্যোগে সমর্থন না করায়; ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে আপ্রাণ হওয়ায়; অনেকটা বাধ্য হয়ে পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তানের সঙ্গে যেতে হয়।

এই পাকিস্তানের লাহোরে ছিলো কলকাতার অনুরুপ বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদার। ঐ মুন্সী, সেরেস্তাদার, কেরানি থেকে অভিজাত হওয়া আর্য কল্পনার মুসলমান। এদের এতো চর্বি এতো জমেছিলো যে, পূর্ব বঙ্গের মানুষকে বেঁটে কালো ঠিকঠাক মুসলমান নয় বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিলো। এটা নতুন বড় লোক বা ফিলিস্টাইন্সের বৈশিষ্ট্য। বৃটিশের দালালি করে ফর্সা কাপড় পরলে আর দালান তুললে; তখন অন্যদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে অভিজাত সাজতে হয়।

নেহাত বৃটিশের পরাধীনতা থেকে মুক্ত হতে পূর্ববঙ্গকে এদের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়েছিলো।  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে  পাকিস্তানকে বিতাড়িত করে এই ভূখণ্ড থেকে। পাকিস্তানের পরাধীনতা থেকে মুক্ত হতে প্রতিবেশী ভারতের সাহায্য নিতে হয়েছিলো। কিন্তু ভারত ছিলো ১৯৪৭ সালে হারানো জমিদারি ফেরত পাওয়ার তালে। কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁর ব্যাপ্টিজমে তৈরি হওয়া কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক-সাংবাদিকদের দিয়ে ঢাকায় সে বাঙালি সংস্কৃতির মোড়কে হিন্দুত্ববাদ প্রচারের কাজটি জোরেশোরে শুরু করে।

সেই কলকাতা প্রভাবিত কালচারাল উইং মনে করে; তাদের এতো মেধা ও ন্যারেটিভ বানানোর ক্ষমতা যে; তারা ৭২-৭৫-এর বাকশালের দুঃশাসনকে গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে যেভাবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়েছিলো; বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের তকমা দিয়ে ভারতের সহযোগিতায় যেভাবে ২০০৯ সালে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে স্থাপন করেছিলো; একইভাবে শেখ হাসিনার পনেরো বছরের ফ্যাসিজমের হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার, আয়নাঘর, দেশলুন্ঠন, ভারতীয় আধিপত্য, ভিন্নমতের মানুষকে ‘রাজাকার’ ও ‘পাকিস্তানপন্থী’ তকমা দিয়ে কলংক দেওয়া, সমালোচককে কারাগারে নিক্ষেপ, ইন্টেরোগেশন সেলে হিন্দিতে প্রশ্ন করা, মুসলমান মানেই জঙ্গী অতএব সে হত্যাযোগ্য এই অভিমত স্বাভাবিক করা; পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এই ফ্যাসিজমকে গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ হাজির করতে মরিয়া ভারত ও হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির ন্যারেটিভ মামা ও খালারা।

চেহারা সুরতে না কুলালেও আওয়ামী লীগ ও বিজেপি কাপলটির বড্ড জায়নিস্ট হবার বড্ড শখ। বাংলাদেশকে তারা প্যালেস্টাইন হিসেবে দেখতে চায়। এই রক্ততৃষ্ণাকে পরাজিত করেছে জুলাই বিপ্লবীরা। তাইতো জুলাই বিপ্লবের পর গত বছর ৫ অগাস্ট থেকে জুলাই বিপ্লবীদের ছিদ্রান্বেষণে ব্যস্ত, কাঁচামাল মিডিয়া ও পরাজিত ভারত আর এর প্রমোদ বালক বালিকারা। সেই যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রং-এর মেলায় দেখেছিলো বায়েস্কোপ; বায়েস্কোপের নেশা তাদের ছাড়ে না।

১১৪ পঠিত ... ১৭:৩৫, আগস্ট ০৭, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top