লটারি পেয়ে হঠাৎ বড়লোক হয়ে মেগালোম্যানিয়ায় ভুগে অন্যদের ছোটোলোক বলে নিজেকে বড়লোক হিসেবে দাবি করার ব্যাপারটা আসলে একটা মেন্টাল ডিজ-অর্ডার। ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের সময় চালাক চতুর লোকেরা ফড়িয়া থেকে রাতারাতি ধনাঢ্য হয়ে নিজেকে অভিজাত প্রমাণে অন্যদের ছোটোলোক বলত। লেখক টমাস হার্ডি এদের ফিলিস্টাইন্স বলে অভিহিত করেছিলেন। ইউরোপের লেখকেরা এই নতুন বড়লোক শ্রেণিটিকে উপহাস করে; তার শেকড়টি দেখিয়ে দিয়ে ইনফেরিয়রের এই সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স বেশ খানিকটা কমিয়ে এনেছিলেন। ফলে সম্পদের সুষম বণ্টন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলেও; মানসিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে। এই একবিংশ শতকে ইউরোপের নতুন প্রজন্মের কেউ আর যাই হোক কাউকে ছোটোলোক বলে না।
বৃটিশ আমলে ইংরেজের হরিপদ কেরানি বা সেরেস্তাদার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারি পেয়ে নতুন ধনী হয়ে উঠলে তাদের ছেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে পূর্ববঙ্গের মানুষকে ছোটোলোক বলে ডাকতে শুরু করে। অথচ পূর্ববঙ্গের একজন সম্পন্ন কৃষক ও কারিগরের যে স্বচ্ছন্দ জীবন, তার চেয়ে কলকাতার হরিপদ কেরানির জীবন ছিল অনেক চিপেচুপে চলা। সেই ইনফেরিয়রিটি ঢাকতে সে ও তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটি ছোটোলোক গালিটিকে সম্বল করে।
বৃটিশ আমলে ইংরেজের ভাট্টি কেরানি বা সেরেস্তাদার পাঞ্জাবে জমিদারি পেয়ে নতুন ধনী হলে তার ছেলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে পূর্ববঙ্গ, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষকে ছোটোলোক বলে ডাকতে শুরু করে। অথচ এসব অঞ্চলের সম্পন্ন কৃষক ও কারিগরদের তুলনায় ভাট্টি কেরানির জীবন ছিল অনেক টেনেকষে চলা। সেই ইনফেরিয়রিটি ঢাকতে সে ও তার নব্য শিক্ষিত ছেলে ছোটোলোক গালিটিকে সম্বল করে।
পূর্ববঙ্গেও জোতদার ধলা মিয়া ও গেদু মিয়া ফড়িয়া হিসেবে কৃষক ও কারিগর ঠকিয়ে সম্পদশালী হলে; বৃটিশ ও পাকিস্তানি ম্যাজিস্ট্রেটকে দাওয়াত করে খাওয়ালে; তারা যাওয়ার কালে মির্জা, শেখ, চৌধুরী টাইটেল দিয়ে যায়। অমনি তারা লাখো বাতি জ্বেলে মেজবান করে তার অভিজাত লাখপতি হওয়ার জানান দেয়। তখন তার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ছোটোলোক বলে গালি দিতে শেখে।
হরিপদ, ভাট্টি, ধলা মির্জার শিক্ষিত ছেলেরা বৃটিশ ও পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসে ঢুকলে; দেখেশুনে বৃটিশের নেটিভ দারোগার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। সেখান থেকে জন্ম নেয় সব ডেডলি কম্বিনেশন। এদের নাতি-নাতনি কার্ল মার্কসের বই নিয়ে ঘুরে, উচ্চাঙ্গ সংগীত শোনে, পিয়ানো বাজানো শেখে; মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে; কিন্তু ঐ যে জেনেটিক আশ্লেষ; মাথার মধ্যে ম্যাগালোম্যানিয়ার গজফিতা নিয়ে ঘুরে মানুষকে মাপামাপি করতে থাকে, রেগে গেলে কর্কশ হরিপদ-ভাট্টি-ধলা মিয়া বেরিয়ে এসে 'ছোটোলোক' বলে গালি দেয়।
একটা লোক রেগে গেলে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়; সেখান থেকেই বোঝা যায় তার ডিএনএ কতটা অ্যাভলভ করেছে। শিক্ষাকে সার্টিফিকেট থেকে কতটা যাপিত জীবনে অনুবাদ করেছে। অনেক পুরনো ঐতিহ্য যেসব পরিবারে রয়েছে, সেখানে ব্রেকফার্স্ট টেবিলে শেখানো হয়, কক্ষণও সম্পদ দিয়ে মানুষকে না মাপতে, গাত্রবর্ণ বা চেহারা নিয়ে কাউকে কটাক্ষ না করতে, বিনয়ী ও কার্টিয়াস হতে। গৃহকর্মীর অভিভাবক, নিজেদের জমিতে কর্মরত কৃষক, নিজেদের কারখানায় কর্মরত শ্রমিক বেড়াতে এলে বাড়ির ছেলে-মেয়েদের দায়িত্ব দেয়া হয় তাদের সঙ্গে কথা বলতে ও আতিথেয়তা করতে। রিক্সাচালককে ও গাড়িচালককে আপনি বলতে শেখানো হয়। এরিস্টোক্রেসি বা আভিজাত্য বলে যদি কিছু থাকে; তবে তা প্রতিটি মানুষকে সমান সম্মান জানানোর শিক্ষা।
ফেসবুকে ছোট লোক, ছাপড়ি, বাঙ্গি, ইঁদুর বা ডাকাতের মতো চেহারা বলে গালি দেবার যে স্রোত দৃশ্যমান; এটা ইনফেরিয়রের রাতারাতি সুপিরিয়র সাজার চেষ্টা। এটাকে স্মার্টনেস হিসেবে শেখা হবে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
এই যে দক্ষিণ এশিয়া; এখানে বৃটিশেরা আসার আগে সম্পন্ন কৃষক ও কারিগরের বসবাস ছিলো। পথে ভিক্ষুক ছিলো না। নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো। এখানে সংস্কৃত ও ফারসি পণ্ডিত ছিল; কবি-গায়ক-চিত্রকর ও দার্শনিক ছিল। ১৭৫৬ থেকে সম্পদ লুণ্ঠন করে বিলেতে পাঠাতে পাঠাতে এই জনপদকে রিক্ত করে ১৭৭০-৭৬-এর দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষ হত্যা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও এর স্থানীয় কোলাবরেটর সিন্ডিকেট। কৃষকের ভূমি কেড়ে নিয়ে; কারিগরের আড়ং উচ্ছেদ করে সম্পন্ন মানুষকে দুঃস্থ বানিয়ে এরপর তাদের থাগস অফ বেঙ্গল নাম দেওয়া হয়। অথচ মুঘল ও নবাবী আমলে বিশ্বের ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতো এই জনপদ থেকে। পৃথিবীর ইকোনোমিক পাওয়ার হাউজ ছিল এ অঞ্চল।
এখানে কাকে ছোটোলোক বলে ডাকছেন; যে ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪-এ জীবন দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করেছে। যে দেশের জন্য যুদ্ধ থেকে ফিরে অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর যুদ্ধে ফিরে গেছে বারবার। বরং ছোটোলোক বলে কিছু থাকে সে তো তারাই; যারা বৃটিশ, পাকিস্তান ও ভারতের দালালি করে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে!
পাঠকের মন্তব্য