জনপ্রিয় ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস পথের পাঁচালী ও অপরাজিত। অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, ইছামতী ও অশনি সংকেত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসের পাশাপাশি বিভূতিভূষণ প্রায় ২০টি গল্পগ্রন্থ, কয়েকটি কিশোরপাঠ্য উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনি এবং দিনলিপিও রচনা করেন। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ১৯৫১ সালে ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।
চলুন বিভূতিভূষণ সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য জেনে নেয়া যাক।
তিনটি অদ্ভুত ঘটনা
১.
একদিন মিত্র এন্ড ঘোষ-এ বসে দুপুরবেলায় অনেক সাহিত্যিক আড্ডা দিচ্ছেন। এমন সময় সম্ভবত উত্তরবঙ্গের কোনো একটি সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য দুটি ছেলে এসে একজন প্রখ্যাত সাহত্যিকের সঙ্গে যাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছে। এর আগেও তারা ওই সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা করে গেছিলো। তিনি ছেলে দুটির সঙ্গে নানারকম বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়লেন পড়লেন। তারা নানান বায়না যাওয়া এবং আসার ব্যাপারে, থাকার ব্যাপারে নানারকম চুক্তি প্রয়োগ করতে লাগলেন। ছেলে দুটি অনেক কাচুমাচু হয়ে তাকে অনেক উপরোধ কর্যে লাগলো এবনহ উনি না গেলে তাদের যে সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে যাবে তাও বললো, কিন্তু এএই সাহিত্যিক অনড়। ব্যাথিত মনে ছেলেদুটি বেরিয়ে গেলে বিভূতিভূষণ পেছন পেছন গেলেন এবং ওদের ডেকে বললেন, 'শোনো, একটা কথা বলি। আমি গেলে কি তোমাদের কাজ হবে?'
ছেলে দুটি অবাক হয়ে শুনলো, 'আমাকে তোমাদের কিছুই দিতে হবে না। দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট দিয়ে নিয়ে গেলেও হবে।'
ছেলে দুটি ভেবে পাচ্ছে না এই সাধারণ চেহারার এবং অত্যন্ত সাধারণ জামাকাপড় পরা মানুষটি কে? তাদের একটু সংকোচ হলো এবং সেটা বুঝে বিভূতিভূষণ বললেন, তোমরা আমাকে চেন না, তবে হয়তো আমার একটু বই আছে যার নাম শুনে থাকবে-পথের পাঁচালি।'
এ কথা শুনে ছেলে দুটি শিহরিত হয়ে বললো,' আপনি বিভুতিভূষণ? এতো আমাদের মহাসৌভাগ্য!
২.
বিভূতিভুষণের ভীষণ নেশা ছিলো। বেশিরভাগই পায়ে হেটে। এটা বোধহয় পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া। তার পিতামহ মহানন্দ একবার হেটে হেটে পেশোয়ার পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। একদিন সকালে ঘাটশীলার বাড়ি থেকে স্ত্রীকে নিয়ে পাহাড়ের দিকে হাটতে বেরুলেন এবং যাওয়ার সময় পুত্রবধু যমুনাকে বলে গেলেন, 'বউমা, চা বসাও, আমরা একটু পড়েই ফিরে আসবো।'
বেড়াতে বেড়াতে বহুদূর পাহাড়ের দিকে চলে গেলেন। ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে গেল। বিভূতির স্ত্রীর তখন প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। এদিকে তখন নতুন বিয়ে হয়েছে, স্বামীকে বলতেও লজ্জা করছে। বিভুতিভূষণের নিজেরও বোধহয় খিদে পেয়েছিলো৷ উনি বললেন, ' তোমার খিদে পেয়েছ তো? চলো, গাছ থেকে আমলকী পেড়ে খাই।' তিন-চারটি আমলকী খেয়ে যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন প্রায় সন্ধ্যা। এসেই বললেন, বৌমা, চা করে রেখেছো তো?'
৩.
বিভূতিভূষণ তার লেখার প্রতি কতটা সনিষ্ঠ ছিলেন তা একটা ঘটনা শেয়ার করলেই বোঝা যাবে৷ খুব সম্ভব বইটি ছিল অনুবর্তন। এই বইয়ের পান্ডুলিপি গজেন্দ্রকুমারের হাতে দিয়েছেন প্রকাশের জন্য। এক সপ্তাহ পরে যখন মিত্র এন্ড ঘোষ-এ গেছেন, গজেনবাবু বললেন, বড়দা, আপনি যে বইটি দিয়েছেন তাতে তিন-চারটি শব্দ বদলে দিয়েছি। দেখুন তো ধরতে পারেন কিনা।' বইটির কয়েক পাতা উল্টিয়ে বিভূতিভুষণ বললেন, এই যে এই শব্দগুলি কিন্তু আমার নয়, আমি এই জায়গাতে কখনই এইরকম শব্দ ব্যবহার করি না৷' গজেনবাবু তাকে প্রণাম করে বললেন, বড়দা, আপনি সত্যিই ধন্য।'
[তথ্যসূত্র: মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'আমার শ্বশুরমহাশয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়' থেকে। রচনাটি বিভূতিভূষণ স্মারকগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে]
বিভূতির যা কিছু প্রিয়
প্রিয় ফল: আম আর কাঁঠাল।
প্রিয় ফুল: ভালবাসতেন চাঁপা, বকুল, শেফালি ফুল। বন্য ফুলের মধ্যে পছন্দ ছিল ঘেঁটু আর ছোট এড়াঞ্চি। ঋজু বনস্পতিতেও আকর্ষণ ছিল তাঁর।
পড়াশোনা: গাছ আর মেঘমুক্ত রোদের দিনে দিগন্ত— এ সব নিয়েই চলত তাঁর পড়াশোনার নেশা। সাহিত্য পড়তেন। সঙ্গে পড়তেন জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান আর উদ্ভিদবিদ্যা। শেষ জীবনে নাকি পরলোকতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন। তাই সারা বাড়িতে বইপত্র ছড়ানো থাকত। আলমারিতে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন না।
বিভূতিভূষণের দৈনন্দিন রুটিন
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। প্রবল গরম হোক বা প্রবল শীত, স্নান করতে যেতেন ইছামতীতে। ফিরে লিখতে বসতেন। প্রথমে দিনলিপি। তার পর চিঠিপত্রের উত্তর। ৭টা নাগাদ প্রাতরাশ। ৯টা নাগাদ স্কুলের পথে যাত্রা। শোনা যায়, গোপালনগর উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে যাওয়ার সময় সদ্য-ভাঙা গাছের ডাল বা বাঁশের কঞ্চি জাতীয় কিছু একটা নিয়ে যেতেন বিভূতিভূষণ। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে জলযোগ। ইছামতী অথবা বাওড়ের ধারে শক্তপোক্ত গাছের ডালের উপরে গিয়ে বসতেন। খানিক বাদে আবার পড়ানো। প্রতিবেশীদের ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আসত তাঁর কাছে। পড়াতেন, গল্প বলতেন। রাতের খাওয়ার পরে কোনও কোনও দিন আড্ডা দিতে বাইরে যেতেন। বাড়ি ফিরতে হয়তো একটা বেজে যেত। আর এই পুরো সময়টাই প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করতেন। বিশেষত, বিকেল আর বেশি রাতে। গাছের ডালে বসে আকাশের বদলাতে থাকা রং দেখতেন। গভীর রাতে দেখতেন গভীর কালো আকাশ।
পাঠকের মন্তব্য