যেভাবে এলো প্রবাদ ‘মাছি মারা কেরানি’

২৬৩৯ পঠিত ... ১৫:৪০, জানুয়ারি ০৫, ২০১৯

একটি সরকারি অফিস। সিলিং এ ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ আওয়াজ তুলে মন্থর গতিতে ঘুরছে একটি বৈদ্যুতিক পাখা। প্রায় অন্ধকার রুমটিতে ছোট একটি টেবিলে একরাশ ফাইলপত্র। তার পিছনে আধবোজা চোখে চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে একজন গোবেচারা গোছের মানুষ। চেহারায় ক্লান্ত ভাব, কলারে দাগ পড়া মলিন শার্ট গায়ে লোকটিকে একবার দেখলেই নির্দ্বিধায় আন্দাজ করা যায়, তিনি একজন ছা পোষা কেরানি। যেখানে আঠারো মাসে বছর ঘোরে, সেখানে খুব বেশি কর্মতৎপরতা দেখানো যে বৃথা- দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি এই পরম সত্যটি উপলব্ধি করে ফেলেছেন।

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

হঠাৎ দৃশ্যপটে এলো অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন। ঘরের অন্ধকারে আত্মগোপন করে থাকা একজনের উপস্থিতি টের পেলেন কেরানি সাহেব। তন্দ্রা ভেঙে তিনি এখন পুরোপুরি সজাগ, স্নায়বিক উত্তেজনায় একদম টান টান হয়ে বসলেন। চাপা, গম্ভীর একটি আওয়াজকে তার ইন্দ্রিয় অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে। স্থির হয়ে বসে থাকলেও তার চোখ দুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই আগন্তুককে। ঘাড় না ফিরিয়েই ডানদিকে আড়দৃষ্টিতে দেখে নিলেন সেটির অবস্থান। টেবিলের রহিম সাহেবের ৪ মাস আগে রেখে যাওয়া লাল ফাইলের উপর অবস্থান নিয়েছে সেই অজানা রহস্যময় আগন্তুক। নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে বসে আছে সে, যেন পৃথিবীর কোন কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। গোবেচারা ছা পোষা কেরানি সাহেব, হয়তো এ বিশাল পৃথিবীতে তিনি অতটা গুরুত্বপূর্ণ নন, তার কর্তৃত্বের পরিধিও হয়তো খুবই সীমিত। কিন্তু এই ধুলো পড়া টেবিলে তিনিই সব ক্ষমতার অধিকারী, তিনিই নৃপতি। তার রাজত্বে তিনি এমন অবজ্ঞা মেনে নেয়ার পাত্র নন। দৈনিক পত্রিকাটি পড়া শেষে হাতছাড়া করেননি, হাতে রেখেই একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলেন। নিঃশব্দে ভাজ করে প্রায় ইঞ্চিখানেক পুরু করে ফেলেন পত্রিকাটি। একটু একটু করে উপরে উঠে আসছে তার হাতে ধরে রাখা কাগজের অস্ত্রটি। চোখের পলকে সশব্দে নেমে এলো সেটি, ফাইলে বসে থাকা সেই আগন্তুকের উপর। মুহূর্তেই সেটি তার ত্রিমাত্রিক রুপ থেকে রুপান্তরিত হয়ে গেলো এক দ্বিমাত্রিক আধা তরল, আধা কঠিন রুপে। আপাতদৃষ্টিতে এ থেকে হয়তো মনে হবে, সামান্য এই এক মাছি মারতে এত কিছু করা অনেকটা বাড়াবাড়ি। কিন্তু কেরানি সাহেবের আজকের দিনে হয়তো এটিই একমাত্র উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার গতানুগতিক জীবনে হয়তো এমন কিছুর জন্যই তিনি অবচেতন মনে অপেক্ষা করেন। বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেতে খেতে হয়তো তার এই বীরত্বগাঁথাই তিনি পরিবারের সাথে আলোচনা করবেন।

‘মাছি মারা কেরানি’ কথাটি শুনলে আমাদের চোখে এমন একজন মানুষের কথাই চলে আসে। যার কোন কাজ নেই, মাছি মারা ছাড়া কিছু করার নেই। কিন্তু আসল অর্থটা কিন্তু মোটেই এমন নয়। প্রবাদটি শুনে যাই মনে হোক, এর অর্থ কিন্তু একদম আলাদা। তাহলে জেনে নেয়া যাক, কোথা থেকে এল এই প্রবাদটি, আর আসল গল্পটি কী ছিলো।

ঘটনাটি এ উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনামলের। এটি সে সময়ের কথা, যখন কার্বন পেপার, ফটোকপি, স্ক্যানার ইত্যাদি প্রযুক্তির আগমন ঘটেনি। হাতে লিখেই দলিল, নথির নকল করা হতো। সে সময়ে এক কেরানিকে দায়িত্ব দেয়া হলো একটি দলিল কপি করার। উপরের কাল্পনিক ঘটনায় যেমন নির্লিপ্ত কেরানির কথা আমরা বলেছি, এই কেরানি সাহেব কিন্তু ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত। দলিল কপি করার দায়িত্বটি তিনি চরম নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করার দায়িত্ব নেন। লাইনের পর লাইন, মাত্রার পর মাত্রা, এমনকি কাটাছেঁড়াও তিনি নিখুঁতভাবে কপি করে যাচ্ছিলেন। শেষ পৃষ্ঠার শেষ লাইন যখন তিনি লেখা শেষ করে হাঁপ ছাড়লেন, তার চোখ আটকে গেলো কাগজের একটি কোণায়। একটি মাছির মৃতদেহ চ্যাপ্টা হয়ে লেগে আছে কাগজের সাথে। এই পরিস্থিতিতে তার কান্ডজ্ঞানকে দমিত করে জয়ী হলো তার কর্তব্যের প্রতি তীব্র নিষ্ঠা। বহু প্রতীক্ষা আর প্রচেষ্টার সমন্বয়ে তিনি বেশ কিছু মাছি শিকার করলেন। কিন্তু পাচ্ছিলেন না সঠিক মাপের মাছিটি। শেষপর্যন্ত খুঁজে পেলেন যুতসই আকারের একটি মাছি। সেটিকে মেরে চ্যাপ্টা করে সেঁটে দিলেন দলিলটির নতুন কপিতে। তার দায়িত্ব তিনি শতভাগ নির্ভুলতার সাথে পালন করলেন!

সেখান থেকেই প্রচলন হয় এই ‘মাছি মারা কেরানি’ প্রবাদটির। এর সঠিক প্রয়োগ হবে অন্ধভাবে অনুসরণ করা বোঝাতে।

২৬৩৯ পঠিত ... ১৫:৪০, জানুয়ারি ০৫, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top