তৌহিদি জনতার পুতুল নাচের ইতিকথা

১৫৫ পঠিত ... ১৭:১৬, নভেম্বর ২৫, ২০২৫

আমাজনে প্রদর্শিত ফ্যামিলি ম্যান তৃতীয় সিজন ফিকশনাল হলেও তা বাস্তব ঘটনা অনুসরণ করে লেখা। এরকম টেলিসিরিয়াল দর্শকদের শেখায়; কীভাবে ঘটনার পেছনের ঘটনা জানার চেষ্টা করতে হয়। ঐ টেলিফিল্মে ভারতের নাগাল্যান্ডে দুটো বিস্ফোরণ ঘটাতে, সরকারের সঙ্গে আদিবাসী নেতাদের সংলাপ ভেস্তে দিতে ও অশান্তি বজায় রাখতে ইন্টারন্যাশনাল ফিক্সাররা স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীকে ব্যবহার করে। ওপরি কাঠামোতে এরকম সংঘাত দেখে টকশোতে টকারেরা চীন-ভারত-মায়ানমারের জিওপলিটিকস নিয়ে আলোচনা শুরু করে। জনগণ তখন সেভাবেই ভাবতে শুরু করে। অথচ ভারত সরকারকে আর্মস ডিল সাইন করানোর লক্ষ্যে এ নেহাত আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের সৃষ্ট সন্ত্রাস। এই সিন্ডিকেটের ফোকাল পয়েন্ট ও ফিক্সার ভারতীয় বংশোদ্ভুত। এই টেলিসিরিয়ালে সিন্ডিকেটের উদ্দেশ্য সফল হয়। ভারত সরকার ডিলে সাইন করে।

আই এস সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি যেমন লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে অস্থিরতা তৈরি করে আন্তর্জাতিক অস্ত্র বিক্রেতা সিন্ডিকেটের বাজার সৃষ্টি করেছিল। ইন্টারন্যাশনাল ফিক্সাররা অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে আইএসের দোকান প্রতিষ্ঠা করে।  এই যে আই এস-এর মুখে ইসলামের ইজমের গপ্পো; সে আসলে নেহাত ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষের মন পাওয়ার জন্য। এতোদিন যে আই এস ইসলাম রক্ষার ঝান্ডা উড়িয়ে ঘুরছিলো; সে এখন আফগানিস্তানে আই এস খোরাসান হিসেবে সন্ত্রাসের দোকান চালু রেখেছে। যেহেতু কোন মুসলিম রাষ্ট্রে আই এস বাঁধা বুয়ার কাজ পাচ্ছে না; তাই সে এখন ভারত সরকারের ছুটা বুয়া হিসেবে কাজ করছে।  এই তথ্যটি এই জন্য আগ্রহ উদ্দীপক  যে, আই এস-এর কাছে ইসলাম টিসলাম সব নাত্থিং ফান। পয়সা পেলে সে হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের ঘর মোছা ও বাসন ধোয়ার কাজ করে দেয়।

কাজেই তৌহিদি জনতা নামে যে বাঁধা বুয়াদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ২০১৪ সালে; তারা ছিলো অতিরিক্ত হিন্দুত্ববাদী হিসেবে দুর্নাম রটে যাওয়া শেখ হাসিনাকে ইসলামপন্থীর ঘন মেক আপ করে দেয়ার লক্ষ্যে। কওমি জননী ডেকে শোকরানা মেহেফিলে হেফাজত যখন আলুথালু হলো; ওয়াজ মেহেফিলে যখন হাসিনার গুনগান শুরু হলো; হাসিনা যখন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে হাতে তসবিহ নিয়ে বের হলেন; তখন তৌহিদি জনতা পার্টি ইন পাওয়ারের দাপটেই বিরাজ করেছে। এ সমাজের সফট টার্গেট বাউলদের ওপর নিয়মিত হামলা করেছে। মসজিদের দেশ বাংলাদেশে নতুন করে ৫৬০ টি মডেল মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে হাসিনা তখন আমিরাতুল মোমেনাতুন হবার জোগাড়। যেহেতু এই তৌহিদি জনতা হাসিনার কোনমতেই অমত করেনি; তাই তারা জঙ্গি তকমা পায়নি। জঙ্গি তকমা কেবল পেয়েছে তারাই, যারা হাসিনার মতে অমত করেছে। তৌহিদি জনতা হচ্ছে ভারতের বজরঙ্গি দলের জমজ ভাই। এই সবুজ পতাকা ও গেরুয়া পতাকা একে অপরের স্বার্থে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশে হাসিনা ও মোদির ভীতির রাজত্ব কায়েমের ফুট সোলজার।

জুলাই বিপ্লবের ক্লাইমেক্স এলে হাসিনার পতন যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে; তখন হাসিনার কালচারাল উইং-এর সংস্কৃতি মামা ও ইসলামিক উইং-এর ধর্ম মামারা মিশে যায় বিপ্লবী মিছিলে। ৫ অগাস্ট সন্ধ্যা থেকে তৌহিদি জনতা পুলিশ বাহিনীর ভঙ্গুরতার সুযোগে নৈরাজ্য শুরু করে; আর কালচারাল উইং তা নিয়ে কাঁদে; ইসলামপন্থীরা বিপ্লব হাইজ্যাক করেছে বলে। আওয়ামী লীগ ভারতে পালিয়ে গেলে বাংলাদেশে ভারতের এসেট হিসেবে রয়ে যায় এই তৌহিদি জনতা ও কালচারাল উইং। লীগ গেলেও ভারতের প্রভাব যেন অক্ষুণ্ণ থাকে; এই লক্ষ্যে তৌহিদি জনতা ও কালচারাল উইং-এর ছোট ছোট পাসে বল গোলপোস্টের দিকে নিয়ে যাবার অতীন্দ্রিয় খেলা চলতে থাকে।

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ভারতের মিডিয়ায় জুলাই বিপ্লবকে মৌলবাদিদের বিপ্লব বলে রাঙ্গিয়ে দেবার যে পূর্ব পরিকল্পনা; তাকে সাবস্ট্যানশিয়েট করে তৌহিদি জনতা সিন ক্রিয়েট করতে শুরু করেছে। আর তৌহিদি জনতা সিনক্রিয়েট করলেই কালচারাল উইং গ্লিসারিন চোখে দিয়ে "সাজানো গোছানো দেশটাকে শেষ করে দিলো" গল্পটা বলতে থাকে। এই সাজানো নাটকে সমাজের সফট টার্গেট বাউলেরা আর তাদের আখড়াগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কটুক্তি অস্ত্রটা তৌহিদি জনতা অপব্যবহার করে এসেছে ২০১৪ সাল থেকেই। অথচ কটুক্তি অস্ত্রটাকে কেবল চব্বিশের ৫ অগাস্টের পরে ব্যবহৃত হতে দেখছেন; অতীতে হাসিনার বিরুদ্ধে ও বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কটুক্তিতে কেঁপে ওঠা সংস্কৃতি মামারা।

হাসিনার পনেরো বছরে দেশের মানুষের ওপর নির্যাতন হয়েছে বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে অপেক্ষাকৃত কোমল পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন; তার সুযোগ পুরো কাজে লাগিয়েছে তৌহিদি জনতা। এই তৌহিদি জনতা ভারতের দেওবন্দ স্কুল অফ থটের লিপ সার্ভিস দেয়। এই দেওবন্দ স্কুল অফ থট উত্তর প্রদেশের হিন্দুত্ববাদী নেতা আদিত্য যোগীর নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়মিত অংশ নিয়েছে। সম্প্রতি আফগানিস্তানের তালিবান পররাষ্ট্র মন্ত্রী ভারত সফরে এসে; দেওবন্দ পরিদর্শনকালে পথে পথে হিন্দুত্ববাদীদের পুষ্পবর্ষণ ও দেওবন্দে ইসলামপন্থীদের পুষ্পবর্ষণে অভিষিক্ত হয়েছেন।

ফলে আজকের রাজনীতিকে আমরা মিডিয়া ও সংস্কৃতি মামাদের তৈরি করা নেসেসারি ইলিউশানে আর দেখি না।

আমরা বরং আরও তলিয়ে দেখি, তৌহিদি জনতাকে প্রতিরোধের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হলেও  ৭২ ঘন্টা ধরে কেন সংস্কৃতি উপদেষ্টাকে গালাগাল করেছে সংস্কৃতি মামারা। পহেলা বৈশাখকে আনন্দবাজারের ভাষায় অষ্টমীর ডালিয়া হিসেবে সাজানো কালচারাল হেজিমনির বিপরীতে সব ধর্ম, জাতি পরিচয়ের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উতসব আয়োজন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। ঈদ, পুজো, দোল পূর্ণিমা, বড় দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে তারা। ফলে কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁর কালচারাল নায়েব, গোমস্তা, কোটালপুত্রদের ভীষণ গোস্বা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বকীয় সংস্কৃতির একটা শেকড় সংলগ্ন কাঠামো তৈরিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা দেখে রেগে কাঁই হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গোষ্ঠী; যারা বেঙ্গল রেনেসাঁর সংজ্ঞায়নে প্রগতিশীলতাকে জেনে এসেছে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জুলাই ম্যাসাকার নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানানোতে; যারা কিছুকাল পর আবার রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে আনার দিবাস্বপ্ন দেখেছিলো; তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছে। যে জুলাই বিপ্লবকে নানারকম ষড়যন্ত্রসূত্রের মালা গেথে ও ইন্ডিয়ান মিডিয়ার গুজব দিয়ে মুছে দিতে চেয়েছিলো তারা; সেটা কঠিন হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের পনেরো বছরের গুম, খুন, ক্রসফায়ার, আয়নাঘরে নিপীড়ন আর সব শেষে জুলাই ম্যাসাকার নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করাতে। এ কারণে বাউল নির্যাতনের প্রতিবাদের সময় সংস্কৃতি উপদেষ্টাকে খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরতে চারুকলার কলাকৈবল্য দৃশ্যমান।

শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসনকালের শেষ এক-দুই বছরে তাকে ফ্যাসিস্ট ডাকা হয়েছে। সেই ফ্যাসিস্ট শব্দটি লঘু করণে চব্বিশের ৫ অগাস্ট সন্ধ্যা থেকেই ইসলামোফ্যাসিস্ট শব্দটি চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের মতো বাঁচতে হবে; এই আবদার পূরণের লক্ষ্যে হাসিনার আমলে মুসলমান মানেই জঙ্গি আর গত একবছরে মুসলমান মানেই ইসলামোফ্যাসিস্ট বলে রাঙ্গিয়ে দেবার এই ন্যারেটিভ।

বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানেরা প্রত্যেকে এই মাজার ভাঙ্গা, বাউল নির্যাতনের বিরুদ্ধে। সেখানে তৌহিদি জনতা নামের গ্যাং-টিকে মুসলমানের প্রতিশব্দীকরণ আর হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ ইসলামোফ্যাসিজম বলে দাগিয়ে দেবার এসব ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভের বহুব্যবহারে জীর্ণ পদ্ধতি নতুন প্রজন্মের মাঝে কোন আবেদন তৈরি করে না। আশি ও নব্বুই দশকে ভারত সমর্থিত আওয়ামী লীগের কালচারাল মামাদের কাছ থেকে আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার সংজ্ঞা শিখে যে সাধারণ পরিবারের ছেলে-মেয়ে অসাধারণ সাজতে শিখেছে; আমরা বনাম ওরার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে; কালের পরিক্রমায় তারা আজ প্রৌঢ় ও প্রাক বৃদ্ধ। এরা যে কোন সামাজিক ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক বেঙ্গল রেনেসাঁর নট নটী সেজে উদ্দেশ্যমূলক সিলেক্টিভ প্রতিবাদ ও প্রচারণা করে বলেই; সমাজে যে কোন অন্যায় কেবল অন্যায় বলে শাস্তি পায়না। অন্যায়-অবিচারকে সোজা সাপটা আইনের লংঘন, সুতরাং শাস্তিযোগ্য এই চিরন্তন চোখে বিচার করতে না শিখলে; অন্যায় ও অবিচারের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।

তৌহিদি জনতা বেশিরভাগ অপরাধ করেছে অন ক্যামেরা। সুতরাং ভিডিও দেখে চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার। এদের দ্রুত বিচারে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। গত এক বছরে অপরাধে জড়িত তৌহিদি জনতার সদস্যদের বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে; এদের বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি জানাচ্ছি।

১৫৫ পঠিত ... ১৭:১৬, নভেম্বর ২৫, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top