লেখা: আহমেদ মোস্তফা কামাল
মরমি শিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেফতার করা হয়েছে মানিকগঞ্জে একটা বিচার গানের আসরে উত্থাপিত যুক্তিতর্কের প্রেক্ষিতে। এই ধারার গান সম্বন্ধে যারা জানেন তারা খুব সহজেই বুঝতে পারছেন, কী হাস্যকর অভিযোগ তোলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে! প্রায় দেড়শ বছর ধরে এই ধরনের গান গাওয়া হচ্ছে, কোনোদিনই কোনো শ্রোতা-দর্শকরা অভিযোগ করেননি যে, এসব শুনে তাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে।
২০২০ সালে টাঙ্গাইলের একই ঘরানার বাউলশিল্পী রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে মামলা করা হয় উগ্র-মৌলবাদী গোষ্ঠীর তরফ থেকে। কওমী মাতা শেখ হাসিনার নির্দেশে তাকে গ্রেফতারও করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এবার মামলা হলো শিল্পী আবুল সরকারের বিরুদ্ধে। নব্য ফ্যাসিবাদী সরকার অতিদ্রুত গ্রেফতার করল তাকে এবং 'স্বাধীন' আদালত কারাগারে প্রেরণ করলেন কিছু না বুঝেই।
বিচার গান কোথাও কোথাও অন্য নামেও পরিচিত, যেমন পালা গান, কবি গান ইত্যাদি। কবি গান বা কবির লড়াই হিসেবে এই ধারার জন্ম প্রায় আড়াইশ বছর আগে। তারই একটা বিশেষ বিকশিত রূপ হলো বিচার গান। ফর্ম মোটামুটি একই, বিষয়ের দিক থেকে ভিন্ন। কবিগানের বিষয়বস্তু প্রধানত দৈনন্দিন জীবনের লঘু-গুরু নানা কিছু। কিন্তু বিচার গানের বিষয়বস্তু প্রধানত মরমি বা Mystic চিন্তাসংশ্লিষ্ট।
এই ধারার গানে দুজন স্বভাবকবি/শিল্পী দুটো পক্ষে ভাগ হয়ে যুক্তিতর্ক হাজির করেন। যেহেতু এটা এক ধরনের 'লড়াই' তাই এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন যুক্তিতর্ক, গল্পগাঁথা, কথার মারপ্যাঁচ এবং গানের সুরে সুরে। বিচার গানের ইতিহাসে অত্যন্ত জনপ্রিয় কিছু পালা হলো শরিয়ত-মারেফত, জীবাত্মা-পরমাত্মা, স্রষ্টা-সৃষ্টি ইত্যাদি। অর্থাৎ একজন যদি শরিয়তের পক্ষে বলেন, আরেকজন বলবেন মারেফতের পক্ষে। একজন পরমের পক্ষে বললে অন্যজন বলবেন জীবের পক্ষে। কথাগুলো বলা হয় সাধারণত আঞ্চলিক ভাষায়, কথা শেষে গানের মাধ্যমে অপর পক্ষকে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয় ; অন্যপক্ষও একইভাবে গল্পসল্প-যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে। প্রায় সারারাত ধরে চলে এই কবির লড়াই বা কথার যুদ্ধ। শেষ হয় দু'পক্ষের এক ধরনের মীমাংসার মধ্যে দিয়ে।
মানিকগঞ্জের যে পালাটি নিয়ে এত কিছু, তার বিষয় ছিল জীব ও পরম। দুজন শিল্পী (দুজনের নামই আবুল সরকার, একজন ফরিদপুর নিবাসী, ছিলেন পরমের পক্ষ ; অন্যজন মানিকগঞ্জ নিবাসী– যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে–ছোট আবুল সরকার মহারাজ নামে পরিচিত, ছিলেন জীবের পক্ষে) যথারীতি যুক্তিতর্কের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন প্রচলিত পদ্ধতিতে। শ্রোতাদের কাছে এই ভঙ্গি, কথাবার্তার এই ধরন খুবই পরিচিত এবং উপভোগ্য। আজ পর্যন্ত শুনিনি, এসব শুনে কোনো শ্রোতার অনুভূতি আহত হয়েছে। বরং ঘটে উল্টোটাই। গভীর মরমি চিন্তা, গল্প, কথা আর গান শুনে শ্রোতারা আবেগে আকুল হয়ে কাঁদেন। তাদের হৃদয় হয়ে ওঠে কোমল, শুদ্ধ, প্রেমময়।
বাংলাদেশের মানুষ যে শেষ পর্যন্ত উগ্রবাদী হয়ে ওঠে না তার কারণ এই ধরনের মরমি শিল্পচর্চা। এই শিল্প মানুষকে তো বটেই, সকল সৃষ্টিজগৎকে ভালোবাসতে শেখায়; শেখায় সহমর্মিতা, সহনশীলতা, সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতি। আর এটাই উগ্র ডানপন্থীদের মাথাব্যথার প্রধান কারণ। দেশে হাজার হাজার মসজিদ এবং মাদ্রাসার বেশিরভাগই উগ্রপন্থী ওয়াহাবি-সালাফিদের দখলে। ওয়াজ মাহফিলেও তাদেরই আধিক্য। কী পরিমাণ ঘৃণাচর্চা করেন এসব লোকেরা তা তো জানেনই। তা সত্ত্বেও গণমানুষকে তারা নিজেদের পক্ষে নিতে পারেন না। কারণ এদেশের মানুষ উগ্রতা পছন্দ করে না, ভালোবাসে মরমি ভাববাদ।
এদেশের কোনো সরকার কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলই দেশের গণমানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না, এখনও নেই। তারা বোঝেই না যে, শত শত বছর ধরে আমাদের লোকশিল্পীরা তাদের সহজিয়া প্রেমময় লোকায়ত দর্শন, গল্প, কবিতা এবং গান দিয়ে এদেশের মানুষকে উগ্রপন্থা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন।
ওয়াহাবি-সালাফি-জামাতি-হেফাজতি-খেলাফতিদের দখলে আছে মসজিদ, মাদ্রাসা, ওয়াজ মাহফিল, এমনকি মিডিয়াও। তারা সার্বক্ষণিকভাবে তাদের মতবাদ প্রচার করে যাচ্ছে, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। পাচ্ছে না ওই লোকায়ত শিল্প ও দর্শনচর্চার প্রভাবেই।
উগ্র ডানপন্থীরা তাদের শত্রু চেনে। কিন্তু উদারপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বন্ধু চেনে না। সরকার তো সবসময়ই মুর্খদের দখলে। এরা দেশের মানুষের শিল্প-সংস্কৃতি কিছু জানেই না। সেজন্যই আবুল সরকারের মতো একজন সর্বজনপ্রিয় শিল্পীকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু থেকেই জামায়াত-হেফাজত-খেলাফত-চরমোনাইদের তোয়াজ করে এসেছে এবং তাদের ইচ্ছে মতো রাষ্ট্র পরিচালনা করে এসেছে। তাদের আড়ালে কার্যত ক্ষমতায় আছে ওয়াহাবী-সালাফি-মওদুদীবাদী উগ্রপন্থীরা। শত শত মাজার ভাঙা হয়েছে, গানের আসর পণ্ড করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের শত শত ম্যুরাল এবং ভাস্কর্য ধ্বংস করা হয়েছে, পথেঘাটে নারীদের অপমান-অপদস্ত করা হয়েছে, এমনকি শরিয়ত রক্ষার নামে কবর থেকে লাশ উঠিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ করে ড. ইউনুসের সরকার আমাদেরকে উপহার দিয়েছে এই প্রচণ্ড অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা এবং জঙ্গিপনা। এগুলোই তাদের মহাঅর্জন। ইতিহাসে এসব কথা অবশ্যই লেখা থাকবে।
এই গণবিরোধী সরকারের কাছে আমি কোনো দাবি-দাওয়া পেশ করব না, এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়েছি। তাদের অপশাসনের অবসান হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রতিটি অপকর্মের জবাব তাদেরকে দিতে হবে, তাদের কাছ থেকে জবাব আদায় করা হবে। আজ হোক কাল হোক, শিল্পী আবুল সরকারকে মুক্তি দিতেই হবে। কিন্তু আমরা সরকারের এইসব অপকর্মের কথা ভুলব না।
এক অসাধারণ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইতিহাসের ভয়ংকরতম এক ফ্যাসিস্টকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলাম আমরা, সেই অসামান্য গণজাগরণকে এই সরকার ইসলামোফ্যাসিস্টদের হাতে তুলে দিয়েছে। এই দায় শতভাগ তাদের। ইতিহাসের এই দায় তাদের বহন করে যেতে হবে অনন্তকাল ধরে।
আমি বরং সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের অনুরোধ করব, আপনারা দ্বিধাহীনভাবে শান্তিপ্রিয় গণমানুষের পক্ষে দাঁড়ান। উদার গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক সহনশীল সম্প্রীতির রাষ্ট্র নির্মাণের পক্ষে দাঁড়ান। বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে। একদিকে উগ্র ডানপন্থা, অন্যদিকে উদার গণতান্ত্রিক পন্থা। পথ বেছে নিতে ভুল করবেন না। একবার ভুল পথে গেলে ফের সঠিক পথে ফিরে আসতে বহু বছর লেগে যাবে।



পাঠকের মন্তব্য