গোলেমালে যাক না কটা দিন

৭৩৬ পঠিত ... ১৮:২০, নভেম্বর ১৮, ২০২৫

লেখা: রিসাদ সৌরভ
একজন ব্যস্ত নাপিত। অবশ্য তখন সব নাপিতই
ব্যস্ত। নাম পরিমল চন্দ্র শীল। বয়স্ক বলা যায়, মাঝামাঝি আকৃতির, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। চুল, দাড়ি কাটে গ্রামে গ্রামে। অতিরিক্ত পেশা হিসেবে ফোড়া কাটা ডাক্তার। কারোর হাতে, পায়ে, শরীরে ফোড়া হলে ডাক পড়ে নাপিতের। নাপিত আয়োজন করে যায় রোগীর বাড়ি। নগ্ন পা, ঘাড়ে ঝোলানো মলিন হয়ে যাওয়া পুটলি। সেখানে চুল কাটার সরঞ্জাম আর পথিমধ্যে খাওয়ার জন্য মোটা মুড়ি, গুড়। মাঝেমধ্যে হেঁটে দূরে যেতে হয় যে।

অলস পা পৌঁছে যায় রোগীর বাড়ি। সমাদর খুব একটা পায় না। পাওয়ার কথাও না।

বাড়ির কর্তা ফোড়ার ব্যথায় অস্থির। সো, নো হাই হ্যালো। 

ফোড়াটা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে, মুছে নেয় প্রথমে। ক্ষুর ধার করা হয় নিত্য বহন করা চারকোণা পাথরে ঘষে। তারপর আর কি, ধারালো ক্ষুর দিয়ে চিরে ফেলে ফোড়া। ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে বাড়ির কর্তা।
ফোড়া থেকে বের হয়ে যায় পুঁজ, মরে যাওয়া রক্ত। মুছে ফেলে পুটলিতে রাখা পুরান মলিন হয়ে যাওয়া কাপড় দিয়ে। এবার হলুদের গুড়া ঢেলে পট্টি করে দেয় ত্যানা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া কাপড়ের অংশ দিয়ে। স্বস্তি পায় রোগী। বিনিময়ে চাল, উঠানের গাছের লাউ, ঘরে জমানো খুচরা পয়সা এসবই পায় নিয়মিত। প্রক্রিয়া আনহাইজেনিক হলেও কার্যকর। এবং লাভও দুই পক্ষের। নাপিতের অতিরিক্ত কামাই আর রোগীর কম অর্থে চিকিৎসা।

এতে ক্ষতিও হয় একজনের। সে এলাকার একমাত্র ভুয়া ডাক্তার। রোগী আসে না তেমন তার কাচারি ঘরে। আসবে কীভাবে! ভিজিট যে পাঁচ টাকা। যদিও রোগী না পেয়ে কমিয়ে তা তিন করা হয়েছে। তবুও ফাঁকা। কাঠের তাকে পড়ে থাকে, ধুলা পড়ে যাওয়া হোমিওপ্যাথিকের নানা কাঁচের শিশি। অলস সময় পার করে বয়স পঞ্চাশ হয়ে যাওয়া হারাধন। আর ভাবে কীভাবে এই নাপিতকে শায়েস্তা করা যায়। চেষ্টা করেছে অনেক, কিন্তু কাজ হয়নি।

ডাক এসেছে আবার দূর গ্রাম থেকে। রোগীর পেটে ফোড়া। এবার হলো বিপত্তি। উনিশ/বিশ হয়ে গেল কাটার সময়। দ্রুত সেই ডাক্তার কে ডাকা হলো। অনেক অনর্থক চেষ্টা হলো, কিন্তু বাঁচানো গেলো না বারোতে পা দেওয়া নান্টুকে। সুযোগ পেল ডাক্তার। গ্রামবাসীকে বুঝিয়ে, বের করে দেওয়া হল পরিমলকে।

পরিমলের অবশ্য অপরাধবোধ নেই এইটা নিয়ে। যেদিক চোখ যায় হাঁটে সে। পিপাসা পেলে পুকুর থেকে পানি গিলে নেয় আর পুটলিতে তো শুকনা খাবার আছেই। রাতে আশ্রয় নেয় কারোর গোয়াল ঘর বা কাছারি ঘরে। কয়েকদিন হাঁটল এভাবে। এরপর এক গ্রামে পৌঁছাল। সন্ধ্যা তখন। নতুন মানুষ দেখে নজরে আসলো এক জেলের। জানতে চাইল উদ্দেশ্য। নাপিত এবার পরিচয় গোপন করল। বলল যে,

সে শিক্ষক। অবাক হলো জেলে। অবাক হওয়ার কারণ আছে। ওই গ্রামে কেও জানে না শিক্ষক কী অথবা শিক্ষা কী।

নাপিতের মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে ভাবল এবং শিক্ষার উপকারিতা নিয়ে অনেক কিছু বলল। জেলে তখন নাপিতকে নিয়ে গেল তার মহাজনের কাছে। মহাজন সব শুনল, ভাবল। মুখে দেখে কিছু বুঝার উপায় নেই, কিন্তু তিনি আগ্রহী। এরপর একটা সভা করা হলো। গ্রামের সবাই উচ্ছ্বসিত। বানানো হলো বিদ্যালয় এবং শিক্ষকের জন্য ঘর। সব শেষ হলে শুরু হবে পাঠদান। কিন্তু নাপিত শেখাবে কি?

সে তো এর আগে বিদ্যালয়ের উঠানে পা রাখেনি কখনও। রাতে ভাবল, পরদিন গেল শ্রেণীকক্ষে।

উৎসাহী সব গ্রামবাসী এসেছে শিক্ষার জন্য। এরপর পুটলিতে রাখা একটা পোকার আধা খাওয়া পুরান  বই বের করল, একটু ভাবুক মুখভঙ্গিতে সবার সাথে কুশল বিনিময় করল। এবার তার সাথে সবাইকে বলতে বলল ‘গোলেমালে যাক না কটা দিন’। এরপর সবাই চিৎকার করে বলতে থাকল, ‘গোলেমালে যাক না কটা দিন…গোলেমালে যাক না কটা দিন…’
এভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকদিন। সবাই স্কুলে আসে এবং এই একটা বাক্য আওড়াতে থাকে।

বিনিময়ে নাপিত পরিমল পেল অর্থ, যাদের সামর্থ্য নেই তারা মাছ, লাউ, আলু, চাল দিয়ে যেত। নাপিতের জীবন সুন্দর চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এই সুখ বেশিদিন থাকল না। একদিন এক পথিক ওই গ্রামের পথ ধরে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে নাপিতের স্কুল। পথিক শুনতে পেল একদল মানুষ চিৎকার করে আওড়াচ্ছে  ‘গোলেমালে যাক না কটা দিন।

তখনও নাপিত স্কুলে আসেনি। উৎসাহী হয়ে পথিক সেখানে গেল, এবং গ্রামবাসীর থেকে সব শুনল। পথিক কিছু বলল না। তখন নিজেকে সে শিক্ষক বলে পরিচয় দিল। গ্রামবাসীকে নতুন পড়া দিবে বলে সে তাদের শিখিয়ে দিল ‘এই করে খাবি কয়দিন’। তখন গ্রামের সব ছাত্র-ছাত্রী চিৎকার করে বলতে থাকল ‘এই করে খাবি কয়দিন’ । এরপর পথিক তার গন্তব্যে রওনা দিল।

নাপিত বাড়ীর কিছু কাজ সেরে স্কুলের দিকে যাচ্ছিল তখন শুনতে পেল ‘এই করে খাবি কয়দিন’
নাপিত ভাবল গ্রামবাসী হয়তো তার প্রতারণা ধরে ফেলেছে। তখন ভয়ে নাপিত পালিয়ে গেল নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে

৭৩৬ পঠিত ... ১৮:২০, নভেম্বর ১৮, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top