সাল, একাত্তর। কুষ্টিয়া জেলার জীবন নগর থানার সানহুদা অথবা সেনেরহুদা গ্রাম। দুইজন বিবাহিত যুবতী, যাদের বয়স আঠার পার হলো সদ্য। এক দুপুরে দেখা গেল দুইজন যুবতীই নগ্ন ছুটে বেড়াচ্ছে গ্রামের এদিক-ওদিক আর তাদের পেছন পেছন রাইফেল হাতে ছুটছে মিলিটারির দল। বন্দুক সামনে রেখে তারা এই দুই যুবতীকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে সারা গ্রাম ঘুরালো, ধর্ষণ করল, তারপর অচেতন অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে রাখলো সন্ধ্যার দিকে।
এই বীভৎস ঘটনা ছাপা হয়েছিল তৎকালীন ভারত থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকায় 'পাকিস্তানে নারীত্বের চরম লাঞ্ছনা' শিরোনামের একটা প্রতিবেদনে, মে মাসের একুশ তারিখ। আর অক্টোবরের চৌদ্দ তারিখ নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছিল, ঢাকার একটি সামরিক ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখা হয়েছে পাঁচশো তেষট্টিজন নারী। যাদের প্রত্যেকেই প্রেগন্যান্ট৷ গর্ভপাত করানো সম্ভব না। যুদ্ধের পর এইসব অন্তঃসত্ত্বা নারী নিয়ে কাজ করতে আসা ডাক্তার জিওফ্রে ডেভিস জানিয়েছিলেন, দেশে অবস্থানকালীন দিনপ্রতি একশ নারীর গর্ভপাত করিয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশকে আমি ডাকি, আমার জনমদুঃখী দেশ। জন্মলগ্নে এই দেশ হারিয়েছে তার অগুণিত বীর সন্তান। যে ট্রমা কাটাতে একশো বছরও কম পড়ত, মাত্র দুই-তিন প্রজন্ম ওই ট্রমা কাটিয়ে উঠেছে। ট্রমা ওরা এমন ভয়াবহ উপায়ে সারিয়েছে যে- ওদের কাছে এখন মনে হয়, একাত্তর একটা বড়োসড়ো আফসোস! তা পাকিস্তানের কাপড়-চোপড় নিয়েই হোক অথবা নারী।
স্বাধীনতার অর্ধশত বৎসরে এই একাত্তর কারোর কাছে হয়েছে ফ্যাসিবাদ কায়েম করার অস্ত্র, কারোর কাছে নিছক ঘৃণামাখা থুথু। বাংলাদেশ একটা জনমদুঃখী দেশ কারণ একাত্তর তার কোনো সন্তানের কাছেই জননীর 'কখনো না সারা ক্ষত' হয়ে থাকে নাই আর। আপাতত মনে হয়, এটাই বোধহয় ভালো। কারোর বাঁচিয়ে রাখার দায় নাই। একাত্তর বেঁচে থাকবে নিজের মতো করে, নীরবেই। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত এই শ্মশানের ভেজা মাটি আর বিষণ্ন জোছনাই বাঁচিয়ে রাখবে একাত্তর, আজীবন।



পাঠকের মন্তব্য