লেখা: প্রদীব দেব
পাকিস্তানে এ পর্যন্ত দুইজন মানুষ নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৭৯ সালে প্রফেসর আবদুস সালাম (পদার্থ বিজ্ঞান), ২০১৪ সালে মালালা ইউসাফজাই (শান্তি)।
বহুদিন ধরেই নোবেল পুরস্কারকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার কথা বলা হয়ে আসছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কূট-রাজনীতি কাজ করে শান্তি ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার দেওয়া নিয়ে। তবে বিজ্ঞান চর্চায় এরকম দেখা যায় না।
প্রফেসর সালাম ছিলেন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁর বড় চাচা চৌধুরি গোলাম হোসেইন সর্বপ্রথম আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী হন। ১৯১৪ সালে আবদুস সালামের বাবা চৌধুরী মোহাম্মদ হোসেইন যখন লাহোরের ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন–তখন ক্লাসের বন্ধুরা তাকে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য বলেন। নিজের বড় ভাই আহমদিয়া হলেও মোহাম্মদ হোসেইন তখনও আহমদিয়াদের অনুসারী হননি। তাই বলে ব্যক্তিগত ভাবে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে কোনো মতামতও তার ছিল না। কিন্তু একটা আন্দোলন হচ্ছে দেখে তার কৌতূহল হলো আহমদিয়াদের সম্পর্কে জানার। নিজের চোখে সব দেখার জন্য তিনি চলে গেলেন কাদিয়ান–যেখান থেকে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উৎপত্তি।
তিনি যখন কাদিয়ানে পৌঁছলেন তখন মসজিদে ধর্ম-বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আহমদিয়াদের খলিফা মির্জা নুরুদ্দিন। চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন আহমদিয়াদের ‘নিজের মনের শয়তানের বিরুদ্ধে মানসিক জিহাদ-ই আসল জিহাদ’ জাতীয় আদর্শে মুগ্ধ হয়ে আহমদিয়াদের অনুসারী হয়ে গেলেন। প্রফেসর আবদুস সালাম চৌধুরী মোহাম্মদ হোসেইনের ছেলে হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রেই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর অক্সফোর্ডের বাড়িতে মারা যান আবদুস সালাম। মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ নিজের দেশের মাটিতে দাফন করার জন্য পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়। কারণ তিনি নিজেই তা চেয়েছিলেন। তিনি অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। করলে পাকিস্তানি নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হত। তাকে দাফন করা হয় রাবওয়াতে। আহমদিয়াদের নিজেদের শহর রাবওয়া। কিন্তু রাবওয়া নামটাও গ্রহণযোগ্য নয় সেখানে। রাবওয়া নাম বদলে রাষ্ট্রীয় হুকুমে নাম রাখা হয়েছে চেনাব নগর। ঝাং–নিজের গ্রাম, সেখানে কবর দেওয়া যায়নি তাকে। কাছেই রাবওয়া। তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখানো হয়নি পাকিস্তানের একমাত্র নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীকে। তার নিজের গ্রামের মানুষ, যাদের স্কুল ও কলেজের জন্য আবদুস সালাম তার নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকাই দিয়ে দিয়েছেন, সেই আইন মেনে চলা মানুষ, ধর্ম মেনে চলা মানুষ দেখতে যান দাফনের সবকিছু আইনমত হয়েছে কিনা ধর্ম মতো হয়েছে কিনা। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা রাষ্ট্রীয় আইন আছে পাকিস্তানে। কী আইন? পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে, আহমদিয়ারা মুসলমান নন। তারা কোনো অবস্থাতেই নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করতে পারবেন না, কলিমা পড়তে পারবেন না। ইসলামের কোনো চিহ্নই তারা ব্যবহার করতে পারবেন না। মসজিদে নামাজ পড়তে পারবেন না। সংবিধানের এই সংশোধনী পাস করেছিলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো, যিনি লিবারেল সোশ্যাল ডেমোক্রেট বলে খ্যাত, যিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডেকে এনেছিলেন প্রফেসর আবদুস সালামকে ভারতের সাথে পাল্লা দিয়ে পারমাণবিক প্রকল্প তৈরির কাজে। ভুট্টোর পরে জেনারেল জিয়াউল হক আরও সব কঠিন আইন পাস করেন আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে।
চেনাব নগরে আবদুস সালামের সমাধি-ফলকে লেখা ছিল: ‘Abdus Salam the First Muslim Nobel Laureate’। সমাধি-ফলক স্থাপনের পর পুলিশ সাথে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এসে মুসলিম শব্দটা মুছে দেন। তাতে লাইনটি দাঁড়াল ‘Abdus Salam the First Nobel Laureate’। এই শব্দ সমষ্টির যে কোনো অর্থ হয় না তাতে কিছু আসে যায় না আইনের ও ধর্মের অনুসারীদের।



পাঠকের মন্তব্য