একটা বং শট ও দুঃসহ স্মৃতি

পঠিত ... ২ ঘন্টা ৩৫ মিনিট আগে

পড়াশোনার ফাঁকে হটাৎ করে বইয়ের লাইনগুলো কোনো অর্থ তৈরি করছিল না। চা বানিয়ে আবারও কয়েকবার পড়তে গিয়ে যখন কিছুই বুঝছিলাম না তখনই ফোনে আনিসার মেসেজ আসলো। আমার নামের অক্ষরগুলো এলোমেলো ছড়িয়ে আছে এমন একটা ছবি দেখেই রিপ্লাই দিলাম, চলে আসছি, ওখানেই থাকো। 

হয়তো একটু বিরতিই দরকার ছিল। কেবল রাত ১০:৩০ বাজে। আমার জন্য খুব বেশি রাতও হয়নি তখনও। ভাবছিলাম আনিসার মুড যদি ভালো থাকে, আর আমিও যদি একটু ভালো করে জানতে চাই তাহলে রুমে ফিরে আনিসার কাছ থেকে পড়াটা বুঝে নিতে পারব। বইটা ডেস্কে রেখে কোট হাতে নিয়ে বের হয়ে আসলাম।  

বাইরে চাঁদের আলোর নিচে ড্যাফোডিল খেলছিল আর আমার গন্তব্য ছিলো লেডি মার্গারেট হলের এক কোনায় সামারহাউজ বলে একটা জায়গা। এখানের ছাত্র-ছাত্রীরা একে শ্যাক বলেও ডাকে। তিন দেয়ালে ঘেরা এই জায়গাটায় মিস্ত্রিরা চার নাম্বার দেয়াল বানানোর আগেই কাজ ছেড়ে চলে যায়। ক্যাম্পাসে এই জায়গাটা আমার অনেক প্রিয় একটা জায়গা। অনেক দিন এখানে একা বসে থেকেছি, বাইরের ঝড়তে থাকা বৃষ্টি ছাপিয়ে চোখ চলে যেত নদীরে ধারে, একদম গল্পের বইয়ের মতো একটা জায়গা।

আনিসা দুইটা ছেলের সাথে বসে ছিলো, ওদের সাথে বিজনেস কোর্স করেছিলাম বলে চিনি বলে মনে হলো। ওদের মাঝখানে গোল একটা অপরিচিত বস্তুর দিকে চোখ চলে যায়। স্বচ্ছ কাচের একটা কন্টেইনার যেটা থেকে একটা নল বের হয়ে এসেছে, অনেকটা ক্যামিস্ট্রি ল্যাবে দেখা কাচের বোতলগুলার মতো। 

কী অবস্থা সবার? ঢুকতে ঢুকতে দেখি একটা ছেলে ঐ বস্তুটা হাতে তুলে নিয়ে লাইটারের আগুন ছোট নলের চারপাশে ঘুড়াচ্ছে। ভেতরে পানির বুদবুদ শব্দ শুনতে শুনতে দেখতে পাই ছেলেটা সাদা ধোঁয়ার ঐ পাশে গায়েব হয়ে গেল। গন্ধে বুঝে গেলাম আসলে কি ছিল ঐটা। 

আমি এই অনুভূতিটা জানি, নিজের শরীরের মধ্যে বন্দি হয়ে যাওয়ার ভয়। এর আগেও দেখেছি। আমার চারপাশের মানুষ গাঁজা খাচ্ছে, এটা আমার জন্য প্রথম কোনো অভিজ্ঞতা না। এমনকি আমিও একবার চেষ্টা করেছিলাম। চারপাশে বন্ধুরা চিৎকার করছিল, ভেতরে নিতে হবে, গিলতে হবে এবং বাইরে বের করে ফেলতে হবে। না না, মুখ দিয়ে শ্বাস নাও, নাক দিয়ে না। আমার যতটুকু মনে আছে আমাকে কখনও নেশায় ধরে নি। কিন্তু বিষয়টা অনেক কুল লেগেছিল, ধোঁয়া নিয়ে আবার অলস ভাবে অন্যকে পাস করার মতো বড়ও ছিলাম। 

ছেলেটা বলল, তোমার পালা। 

আমি বললাম, নাহ, আমি আগেও করেছিলাম, এটা আমার ওপর কাজ করে না।

আনিসা বলল, আরে এটা জয়েন্টের মতো না, এটায় অনেক ধরে। 

ঠিক আছে! কেনো না। বাইরে এসেছি, কলেজের একটা নতুন এক্সপেরিয়েন্স না হয় নিলাম। ডানে থাকা ছেলেটা লাইটার জ্বালালো, আমি বং হাতে নিয়ে মুখের সামনে নিয়ে আসলাম। এরপর আমার মুখ ধোঁয়ায় ভরে গেল, অস্বস্থি লাগছিল, কাশলামও। আনিসা হাসছিল। সবাই একে একে নিল এরপর ছুটিতে ঘোরাঘুরির আলাপ করল।

এরপর ঘুরে ঘুরে আবার আমার কাছে এল। আচ্ছা, আরেক বার, এটাই কিন্তু শেষ। এইবার আমি নিজেই লাইটার নিয়ে জ্বালালাম আর মুখের কাছে নিয়ে এসে টানলাম, এবার কাশি আসলো না। আমি চেয়ারে বসে নিজের ভেতরে হারিয়ে গেলাম আর ওরা গল্প করতে থাকল। 

এক পর্যায়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখি ১টার বেশি বেজে গেছে। কীভাবে সম্ভব? এখানে আসলাম কয়েক মিনিট হলো। মাথা কাজ করছিল না, হিসাব মিলাতে গেলে সব সাদা-কালো ঝাপসা হয়ে আসছিল। নিজের অজান্তে কীভাবে দুই ঘণ্টা মুছে গেল জীবন থেকে? 

আমাকে যেতে হবে বলার পর আনিসা বলল, চলো তোমার সাথে যাই। ডর্মে যাওয়ার ছোট পথটা মনে হচ্ছিল মাইল খানেকের পথ। পা দুটো অঙ্কে ভারি লাগছিল যেন জমিন কামড়ে ধরে আছে। আমার সাথে কী হচ্ছে? অনেক সচেতন ভাবে হাটতে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল এক কদম ফেলতে যেন ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। আনিসাকে বললাম, দুঃখিত, আমার কেমন যেন লাগছে। 

এরপর পায়ের মাসলগুলো কেমন যেন সংকুচিত হয়ে যায়, আর হাটুতে যেন তালা পরে যায়। আমি নড়তেই পারছিলাম না। দরজার খুব কাছেই চলে এসেছি। আর একটা কদম, খুব জোর করে হাটতে চাইলেও আগাতে পারছি না। আমার ব্রেইন যেন মহাশূণ্যে সিগনাল পাঠাচ্ছিল। কোনোভাবেই হাটতে পারছি না। হাতের মুষ্টি শক্ত করে, খুব জোর করে হাটতে চাইলাম,কিন্ত সবকিছু কেমন যেন শূন্য হয়ে আসলো। ধীরে ধীরে হারাতে থাকতে থাকতে বুঝতে পারছিলাম এই অনুভূতিটা আমার পরিচিত, নিজের শরীরে আটকে যাওয়ার অনুভূতি, এটার ভয়। আমার সাথে এটা আগেও হয়েছে।  

সাথে সাথে আমি যেন ১৫ বছরে মালালা হয়ে গেছি। একটা সাদা কাপড়ের নিচে শুয়ে আছি। আমার গলার ভেতর দিয়ে একটা নল ঢুকানো, চোখ বন্ধ করা। টানা ৭ দিন আমি গভীর এক ঘুমে, কোমায় ছিলাম, ডাক্তাররা আমার ক্ষত নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু নিজের ভেতরে, নিজের মাথায় আমি জেগে আছি। সমসাময়িক ঘটনাগুলো স্লাইড শো-এর মতো ঘুরছে। 

আমার স্কুল বাস

বন্দুক হাতে একটা লোক

চারদিকে রক্ত

রাস্তার ভীড়ের মধ্য দিয়ে আমার দেহটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, মানুষজন জড়ো হচ্ছে, কিসব বলছে কিছুই বুজছি না

আমার বাবা স্ট্রেচারের দিকে ছুটছেন আমার হাত ধরার জন্য।

এই ছবিগুলো একই ধারায় বার বার আসছিল। আমি সড়ানোর অনেক চেষ্টা করলাম। এসব সত্য না। আসল মালালা একটা দুঃস্বপ্নের ভেতরে আটকে আছে। শুধু চোখ খুললেই হবে, সব থেমে যাবে। আমি জোর করে চোখ খুলে এই ভয়ংকর দৃশ্যের বাইরে কিছু একটা দেখতে চাচ্ছিলাম। আমি ভেতরে অনেক চিৎকার করলেও আমার ঠোট একটুও নড়েনি, একদম নিথর। আমি যেন নিজের দেহের কফিনের ভেতরে জিন্দা লাসের মতো আটকে ছিলাম।

আর এখন অক্সফোর্ডে নিজের রুমের পথে, ওগুলা যেন আবার হচ্ছিল। মাথাটা দেহকে নড়তে বললেও দেহটা যেন পাথর হয়ে ছিল। আমি হাটতে পারছিনা, শেষ পর্যন্ত আনিসাকে কথাটা বলতে পেরেছিলাম। প্লিজ আমাকে সাহায্য করো।  

শশশ! আমি আছি এখানে। তুমি ঠিক আছ? আনিসার কন্ঠে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল। অনেক দিনের খেলোয়াড় জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আনিসা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ওর ড্রইং রুমে নিয়ে যায়। আমি ফ্লোরে বসে পরলাম, শ্বাস নিতেও যেন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। 

এক মুহূর্তের জন্য যেন সব থেমে গেল। ভেতরে আসাতে স্বস্থি পেলাম। এরপর হটাৎ করেই ঐ ভয়ংকর ছবিতগুলো বারবার আসতে থাকল। বাস, লোকটা, বন্দুক, রক্ত। বার বার চোখের সামনে দেখতে পাই। একদম তাজা স্মৃতির মতো ভাসছিল চোখের সামনে। এর থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই, নিজের মাথা থেকে লুকানোর কোনো পথ নেই। 

শ্বাস আটকে বললাম, আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। আনিসা আমার পাশে বসে বলল, তোমার একটা খারাপ রিয়্যাকশন হচ্ছে, এটা ঠিক হয়ে যাবে। ৩০ মিনিট, বেশি হলে ১ ঘণ্টা, সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তারের কাছে গেলে টেস্ট দিতে পারে, এটা রক্তে থেকে যায়। 

কিছুক্ষন পর মনে হলো গলায় কী যেন আটকে গেছে, বাতাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। আমার গলায় ঢোকানো সেই নলের কথা মনে আসলো, বার বার শ্বাস আটকে যাবার অনুভূতি, কিছু বলতে গেলে কিংবা ঢোক গিলতে গেলেই এমন হচ্ছিল। আমি কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে আনিসার ওয়াশ রুমে গিয়ে বমি করলাম। 

আনিসার ফ্লোরে কতক্ষন যে বসে ছিলাম, হিসাব ছিল না। এক সময় সব কিছু ঠাণ্ডা হলো। কিছুক্ষণ ফ্লোরে শুয়ে থাকার পর আয়নার তাকিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার সাথে কি হচ্ছে? আনিসা জিজ্ঞেস করল? কিছুটা আরাম হয়েছে? এখানে এসে বসো, একটু পানি খাও। 

আমি গভীর শ্বাস নিয়ে শান্ত হতে চাইলাম। যেন চোখ বন্ধ করলাম, ছবিগুলো আবার ভাসতে শুরু করল। এখন যেন আরও দ্রুত গতিতে আসছে। নিরলস ভাবে আমাকে আক্রমণ করে যাচ্ছিল। আমার মাথা আমার দেহের ভেতরে যেন ডুবতে শুরু করেছিল। আমি চোখ খুলে চিৎকার করে উঠি। 

মালালা, এটা থেকে বের হয়ে আসো, আমার হাত ঝাকিয়ে বলল। সে হলে গিয়ে আরেক বন্ধুকে ডেকে নিয়ে এসেছে। ওরা আমার পাশে বসে আছে। আনিসা আমাকে একটা বালিশ দিল, একটা কাপড় দিয়ে মুখ মুছে দিল। যতক্ষন কাপুনি না থামছে , আমরা ফ্লোরেই ছিলাম। এক সময় আনিসা বলল ঘুমানো উচিত। তুমি বিছানায় যাও, আমি এখানেই আছি। দেখবে সকালে সব ঠিক লাগছে। 

বিছানায় গেলেও আমি ঘুমাতে পারিনি। আমি চারপাশে পরিচিত দুনিয়া দেখতে পাচ্ছিলাম। আনিসার টেবিলের বইগুলো, ওর পলো ম্যালেট, বাইরের চাঁদ সব দেখছিলাম। যদি চোখ বন্ধ করি তাহলে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাব। দুঃস্বপ্নগুলো আমাকে কাবু করে আজীবনের জন্য আটকে ফেলবে। ভেতরে যেতে থাকলে আমি জোর করে নিজেকে জাগিয়ে তুলি, মালালা, ঘুমিয়ে পরলেই মারা যাবে তুমি। 

সকালেও জেগে ছিলাম। আনিসা ফ্লোর থেকে উঠে আমার পাশে এসে বসে। তুমি ঠিক আছ দেখে অনেক স্বস্তি পাচ্ছি। আমার চুলে হাত বুলিয়ে কথা বলছিল। এরপরও ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিল আর আমি বাইরে বের হয়ে আসলাম, কারও সাথে যেন দেখা না হয় সেই আশা করছিলাম।

পঠিত ... ২ ঘন্টা ৩৫ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top