একজন পুরুষ মানুষ কি করে নারী পোশাক নিয়ে চিন্তিত থাকতে পারে; এর কোন যৌক্তিক কারণ আজও খুঁজে পাইনি। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন নারী একজন পুরুষকে জিজ্ঞেস না করছে, এই পোশাকে আমাকে মানিয়েছে কিনা; ততক্ষণ পর্যন্ত একজন পুরুষের নারী পোশাক নিয়ে ভালো কিংবা মন্দ কোনোটা বলারই অধিকার নেই। এটা কমনসেন্স। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষা এই কমনসেন্স শেখাতে ব্যর্থ হয় বলেই ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার ছাত্রীর পোশাক নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছেন। আজ হতে কয়েকবছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার ছাত্রীকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেছিলেন। ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক 'হিজাব পরে নাই কেন' আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক 'হিজাব পরছে কেন' এই দুই অনধিকার মন্তব্য ঘরানার লোক হলেও; দুজনেই একই গোয়ালের গরু। একটা এসেছে ইসলামপন্থী গোয়াল থেকে; আরেকটা এসেছে হিন্দুত্ববাদী গোয়াল থেকে।
এই যে দুটি ট্রাইবাল চিন্তাপদ্ধতি এর একটা শাহজাদির কালো নেকাব দেখতে চায়; আরেকটা চিন্তা পদ্ধতি রম্ভার নাচে ধ্যান ভাঙাতে চায়। তুমি এসেছো বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করতে; সেইখানে ছাত্রীর পোশাকের স্বাধীনতাতে নাক গলানোর তুমি কে? একজন ছাত্রীর ফ্রিডম অফ চয়েস হচ্ছে তার পোশাক।
ইসলামপন্থী যে চিন্তার গোয়াল, তার ধারণা হচ্ছে নারী হিজাব না পরা মানেই উলঙ্গ হয়ে থাকা বা বিকিনি পরা। ফেসবুকে অহরহো দেখবেন হিজাব না পরা মেয়ের ছবির নীচে হাজির হয়ে লিখে দিচ্ছে, এতো নেংটা হওয়ার শখ ক্যান? কোন পুরুষ গিয়ে তাকে এরকম অশালীন মন্তব্য করতে নিষেধ করলে তাকে গালি দিয়ে বলে, নিজের বউরে গিয়া বিকিনি পরাও গিয়া। তার মানে এই অবদমিত মন সারাক্ষণ নারীদেহ নিয়ে চিন্তা করে। এই নারীদেহ নিয়ে চিন্তার কারণে সমাজ-রাষ্ট্র বা নিজের পেশাগত জীবনের প্রয়োজনীয় চিন্তা করতে ব্যর্থ হয় তারা। পাগলা মসজিদের দানবাক্স থেকে জীবন নির্বাহ করে আর পাগলামি করে বেড়ায়।
হিন্দুত্ববাদী যে চিন্তার গোয়াল, তার ধারণা হচ্ছে নারী হিজাব পরা মানে জঙ্গি বা ছাগু হয়ে যাওয়া। তার কাছে নারী মানে ফিল্মের নায়িকা স্বস্তিকা মুখার্জি কিংবা পাওলি দাম সেজে থাকতে হবে। আরে বাবা ওটা চলচ্চিত্রের ইলিউশনের জগত। কলকাতার নন্দনে গিয়ে দেখো, জাদব পুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখো মেয়েরা স্বাভাবিক পোশাক পরে ঘুরছে। ইসকন মন্দিরের খিঁচুড়ি খেয়ে এই যে অনন্ত জীবন এইসব লিবিডো তাড়িত মনের লোকেরা বুঝি হিন্দুত্ববাদীদের রোমিও ব্রিগেডের লোকেদের চেনেনা; যারা পার্কে প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল ধরে বেড়ায়; প্রেমের শত্রু এরা। মেয়ের কপালে ২০১৪ পরবর্তী কপালের চেয়ে বড় সাইজের টিপ আর তার আশেপাশে সিঁদুরে ছটা না থাকলেই আঙ্গুল তুলে বলে, ঐ মেয়ে সংস্কারি নয়।
আমাদের সমাজে ইসলামপন্থী ও হিন্দুত্ববাদী গোয়ালের ট্রাইবাল লোকেরা যুগপত একটি আদিম দ্বন্দ্ব তৈরি করে রাখে। একে অপরকে উস্কানি দেয়; ফলে সমাজ সংস্কার করে উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটি ঐ উপমানব শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যে বক্তৃতা দিয়েছে; তা একটি সমৃদ্ধ বক্তব্য। সে স্পষ্ট করে বলেছে, নারীর পোশাক তার স্বাধীনতা, এতে হস্তক্ষেপের অধিকার কারো নেই। শত বছর ধরে আমাদের নারী সমাজ যে শাড়ি ও সালোয়ার কামিজ পরছে তা অত্যন্ত শালীন পোশাক। সুতরাং সালোয়ার কামিজ পরা একজন ছাত্রীকে ‘ন্যাংটা’ বলার গর্হিত অপরাধে শিক্ষকটির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবার জন্য ঐ প্রতিবাদী ছাত্রীর স্বব্যাখ্যাত বক্তব্যই যথেষ্ট। সে বলেছে, আমার মৃত ভাইকে নিয়ে ‘কোথাকার কোন ছেলে...’ বলে হেয় মন্তব্য করা, আমার বোনদেরকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করার অধিকার কারোর নেই। শালীনতা বজায় রেখে প্রত্যেক শিক্ষার্থী নিজের ইচ্ছামতো পোশাক পরার অধিকার রাখে।
আর আমি কোন অন্যায়ের বিচার প্রতিবাদ করতে যাবো কোনটার যাবো না তা একান্ত আমার ব্যাক্তিগত বিষয়। তার জন্য আমার কোনো স্পেসিফিক বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ার প্রয়োজন নেই।"
কিন্তু এইখানে সুষুপ্ত হিন্দুত্ববাদী আর ফার লেফট ও নতুন নারীবাদ শেখা ললিতাদি, কল্পনা, আলপনা এসে পড়ে ঘুটা দিতে। তারা তাদের ট্রাইবাল প্রগতিশীলতার ফার্স্ট জেনারেশন জ্ঞান জাহির করে; ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ ছাত্রীর যৌক্তিক বক্তব্যকে পিছে ফেলে এগিয়ে যায় হাসিনার ফ্যাসিজমকে লঘুকরণ মন্ত্রে ইসলামোফ্যাসিস্ট শব্দ ব্যবহারের গেরুয়া সংকল্পে।
ইসলামপন্থী ট্রাইবালেরা এই তো চায়; হিন্দুত্ববাদী ট্রাইবালদের সঙ্গে একসঙ্গে মিলে ভারতের সেই গোমাতাপুর গ্রামের গোবর ছোঁড়ার উতসব করে কোন বানেগা গোবরপতি হবার আনন্দে হুটোপুটি খায় তারা। এইভাবে প্রতিটি জরুরি প্রসঙ্গ গোমাতাপুরে গিয়ে বিলীন হয়।
তাই আবারো ফোকাস করতে হবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন জি প্রজন্মের প্রতিবাদী তরুণীর বক্তব্যে। তার এই বক্তব্য পোশাক বিতর্কের চির অবসান ঘটাতে পারে। এই মেয়েটি নতুন বাংলাদেশের স্পষ্টবক্তা। সে একজন সাহসী বাবার মেয়ে; যে বাবা বিপ্লবে বিদ্রোহে মেয়ের পাশে দাঁড়ান। সে একজন পরিমিতবোধ সম্পন্ন বাংলাদেশ ঐতিহ্যের মায়ের মেয়ে। সে নয়া ইসলামির কাছে ইসলাম কিংবা নয়া প্রগতিশীলের কাছে প্রগতিশীলতা শিখবে কেন! সে নতুন বাংলাদেশের বিপ্লবী সন্তান।
নারীর পোশাক তার ফ্রিডম অফ চয়েস বা ইচ্ছার স্বাধীনতা; এই বাক্যের স্পষ্ট বিবৃতি ঐ তরুণীর বক্তব্য। এত সহজ করে বলা প্রতিবাদের ভাষা যারা বুঝতে ব্যর্থ হবে; তারা বিস্মৃতির পলিথিন কিংবা ডাবের খোসা হয়ে ভাসবে মৃত পুকুরে। এমন কোন বিতার্কিক নেই যে ঐ তরুণীর এই বিতর্কের একটি যুক্তিও খণ্ডন করতে পারবে। নতুন বাংলাদেশের সংস্কার বিতর্কের শ্রেষ্ঠ বক্তা সে।

 
																		
									 
																		
									 
																		
									 
																		
									 
																		
									 
																		
									 
																		
									 
																		
									
 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
 
		
পাঠকের মন্তব্য