মামা, ভালো আছেন? চা খাবেন?

পঠিত ... ৬ ঘন্টা ৫১ মিনিট আগে

দেখেন, আপনি যখন টোকাই, ভবঘুরে উদ্বাস্তুদের ভেতর দিয়ে হেঁটে ক্লাস করতে যান, যে সমস্যাটা আপনার হয়, ওটার নাম অহম। আপনার হ্যাডমে আঘাত লাগে। যেই হ্যাডম দেখানোর জন্য আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো লাগানো হুডি পরে ঘুরে বেড়ান। আপনার বাস যানজটে পড়লে লাফ দিয়ে বাস থেকে নেমে রিকশাওয়ালা পথচারীকে পিটানো যায়, কারণ তারাতো আর আপনার মত ‘চান্স পেয়ে দেখা’তে পারে নাই।

কিন্তু আপনি ভুলে গেছেন যে, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়টা এমন একটা শহরে যেখানে কমপক্ষে দুই কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে। স্থান সংকুলান আর রাস্তার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝখান দিয়ে মানুষকে চলাচল করতে হয়। আপনি নিজের গণ্ডি থেকে বের হয়ে দেখেন, সারা পৃথিবীতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনের নিচ দিয়ে সরকারি রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন লাখলাখ গাড়ি যাতায়াত করে। উন্নয়নশীল দেশে তো করেই, কারণ এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয় চলেই মানুষের টাকায়। বিশ্ববিদ্যালয় বানানোই হইছিল পড়ালেখা-উন্নততর গবেষণা করে সেই দেশের মানুষের ভাগ্য পাল্টানোর জন্য!

আপনার এটাও মনে রাখা দরকার, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যে রিকশা চালায়, যে ক্যান্টিন চালায়, হলের যে দোকানদার, যে ক্লিনার, আপনার মেসের বুয়া, এদের সবার বাচ্চাকাচ্চা-স্বামী-স্ত্রীরাই রাস্তায় বাদাম বেচে, পিঠা বেচে, হকারি করে। মেসে বুয়া ছাড়া, হলের ক্যান্টিনে রান্না ছাড়া, রাস্তায় রিকশা ছাড়া আপনি একবেলা চলতে পারবেন? না পারলে রাস্তার হকারকে আপনার মেনে নিতে হবে! শুনতে রূঢ় লাগলেও এটাই বাস্তবতা!

ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারি মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্তত ৬০/৭০ হাজার মানুষের পরিবার। এই পৌনে এক লাখ মানুষকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে আরো কয়েকলাখ মানুষ। এর মধ্যে হকার আছে, উদ্বাস্তু আছে, পাগল আছে, ভবঘুরে আছে, কুকুর বেড়াল আছে। এটা একটা ইকো সিস্টেম। দুনিয়া এভাবেই চলে। এসব মানুষ, এসব কুকুর-বেড়াল-কাঠবিড়ালি জানে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা তার জন্য নিরাপদ। এখানে কেউ তাকে ডিস্টার্ব করবেনা। কেউ তার দিকে ঢিল ছুঁড়বে না। সেই জন্য পল্টনের কুকুর আর টিএসসির কুকুরের শরীরের ভাষা আলাদা!

আমাদের আম্মারা উঠানে ধান শুকাতে দিলে হাঁস-মুরগী তাড়ানোর জন্য লাঠি নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু পাশের বাড়ির কবুতর, গাছের অজানা পাখি তাড়ায় না। আমরা যদি তাড়াতে যেতাম, উল্টা বলতো, আহারে! খাক না। পাখিরও হক্ব আছে। গাছের উপরের দিকের কাঁঠালটা পাড়ে না। ওইটা কাঠবিড়ালি খাবে। ধান কাটার সিজনে আপনার আশেপাশের পশুপাখি প্রাণীদের দিকে খেয়াল করে দেখেছেন কখনও? গ্রামের কৃষাণীর মুখে পান। স্যান্ডু গেঞ্জি পরা কৃষকের তেলতেলে শরীর, ঠেসে বেরিয়ে আসা শিশুর পেট, পরিপুষ্ট পাখি, কাঁচা খড় খেতে খেতে মুখ মরে আসা ক্লান্ত গরু। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষকের ফলানো ধান খেয়ে সবাই খুশি। এই হলো ইকো-সিস্টেম! আমাদের মত একটা দেশ এভাবেই চলে! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এমন।

কিন্তু আপনিতো আবার এখন নতুন বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর। জুলাই যোদ্ধা! আপনার সিলেবাসে তো আবার কুকুর হারাম, বিড়াল হারাম, লম্বা চুল হারাম, হিজাব না থাকলে নারী হারাম, রাস্তার পাশের ভবঘুরে হারাম কারণ সে গাঞ্জা খায়, ফলে এদেরকে লাঠি-ওষ্ঠা মারাও হালাল। কথায় আছে, ‘ছাগল স্বাধীনতা পেলে প্রথমেই আশেপাশের চারাগাছ খেয়ে ফেলে!’

কিন্তু এসব টোকাইয়ের পেটে লাথি মারার আগে, রাস্তার পাশে স্যান্ডেল বেচা কারো দিকে জুতা ছুঁড়ে মারার আগে মনে রাইখেন, যেই জুলাই আপনাদেরকে ছাত্রলীগের লুঙ্গির তলার গুপ্ত অবস্থা থেকে বের করে শিবিরের নেতা বানাইছে, সেই জুলাইয়ে পথশিশু মারা গেছে ১৬৮জন, যার পেটে এখন লাথি মারতেছেন, সেই শ্রমিক মারা গেছে ২৮৪ জন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মারা গেছে ১২০ জন। এদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আপনি এখন শিবির... সেই অভ্যুত্থানে আপনাদের ঢাবির একজনও মারা যায় নাই। বরং ওইসব মানুষের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আপনারা ভবঘুরে তোফাজ্জলকে দুইটা ভাত ভিক্ষা দিয়ে নৃশংসভাবে মেরেছেন।

ঢাবির বাইরের পৃথিবী আপনি দেখেননি বলে আপনাকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার যে, শুধু বাংলাদেশ না; পৃথিবীর যেকোনো বড় শহরের ইউনিভার্সিটিতে গেলে দেখবেন, সারা শহরের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভবঘুরের সংখ্যা বেশি, উদ্বাস্তুর সংখ্যা অনেক! এর কারণ আমার জানা নাই, সম্ভবত এরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপদ বোধ করে? সম্ভবত খুব সহজে সামান্য খাবার জুটে যায়?

করোনার সময় আমি উদ্বাস্তু মানুষদের জন্য একটা ফান্ড গঠন করছিলাম। প্রায় ১৫ লাখ টাকা সেই ফান্ডে জমা হলো। তার সাথে আলাদা আরেকটা ফান্ড গঠন করে জাহাঙ্গীরনগরের কুকর বিড়ালদের জন্য খাবারের বন্দোবস্ত করেছিলাম। হল বন্ধ, ছেলেমেয়েরা সব বাড়ি চলে গেছে। এখন এসব কুকুর-বিড়াল খাবার পাবে কোথা থেকে? জাবির একটা সংগঠন একদিন অন্তর অন্তর খিচুরি রান্না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে দিয়ে আসত!

নাহ্। সবাইকে এসব ভাবতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আপনিতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই আসছেন নিজেকে গাঁজাখোর, টোকাই, ভবঘুরে থেকে আলাদা করতে, নিজেকে জাতে তুলতে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে  বেড়ানো উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করাও আপনার দায়িত্ব না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েরও দায়িত্ব না। এই দাবিও আমি মানি! কিন্তু এসব মানুষের যে পুনর্বাসনের দরকার আছে, এদের প্রতি যে মানবিক হওয়ার দরকার আছে, এইটা আপনি যতক্ষণ না বুঝবেন, মনে রাইখেন আপনার ইউনিভার্সিটি আপনাকে কিছুই শেখায় নাই...

আপনি তো ডাকসুর দায়িত্ব এক বছরের জন্য পাইছেন। দেখতে দেখতে সেই এক বছর শেষও হয়ে যাবে। একদিন এই আপনার হ্যাডম দেখানো ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরও হয়ে যাবেন। বছর কয়েক বাদে যখন সেই একই ইউনিভার্সিটিতে ঘুরতে যাবেন, দেখবেন, সেই উদ্বাস্তু লোকটা বস্তা মুড়ে চারুকলার সামনের রাস্তার একপাশে ঘুমাচ্ছে। বাদাম বিক্রি করা ছো্ট্ট আল-আমিন এখন রাস্তার পাশে পাকুড়া বেচে, অন্য আরেক তোফাজ্জল লুঙ্গি পরে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যখন দেখবেন আপনার সেই হ্যাডম দেখানো ক্যাম্পাসে আপনাকে কোনো বালডাও চিনেনা এখন, নিজেকে তখন এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু মনে হবে। আপনার সেই উদ্বাস্তু মনকে যদি কেউ সামান্য আন্দোলিত করতে পারে, সেটা হল ওই চা দোকানদার আল-আমিন, যখন আপনারে ডেকে জিজ্ঞেস করবে, আরে সর্বমিত্র মামা না? ভাল আছেন? চা খাবেন?

পঠিত ... ৬ ঘন্টা ৫১ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top