ডাকসু ও জাকসু ইলেকশন রেজাল্ট নিয়ে সোলসার্চিং দেখছিলাম। আকাশ কুসুম সব আলোচনা।
ছাত্রজীবনে দুটো ডাকসু নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ও বিভিন্ন দলের পরিচিত প্রার্থীর লিফলেট ড্রাফট করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রথম নির্বাচনটিতে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জিতেছিল। দ্বিতীয়টিতে ছাত্রদল জিতেছিল। আমি বিতর্ক আন্দোলনে থাকায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে সখ্য ছিল। তাই দুটি ডাকসু নির্বাচনে কাকে ভোট দেব তা ঠিক করেছিলাম ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করে। ওরা নারীর জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস খুঁজছিল। ফলে ওদের অভিমত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বলাই বাহুল্য ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের অনেকেরই নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক ছিল না। বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ইতিবাচকতা ছিল।
এবার ডাকসু ইলেকশন সামনে রেখে; ছাত্রলীগ ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে পলাতক। ছাত্রদল অপ্রতিদ্বন্দ্বী নিয়ামক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ছাত্র রাজনীতির যে ইতিহাস; তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের পারফরমেন্স ভোট জাগানিয়া ছিল না।
আর শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমকালে বাম ছাত্র সংগঠন থেকে আসা প্রৌঢ়দের অনেকের অবস্থান ছিল হাসিনাঘন। ফেসবুকে ট্যাগিং-এর রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছিল বাম ছাত্রসংগঠন থেকে আসা প্রৌঢ় ও প্রৌঢ়ারা। তবু দ্রোহযাত্রার মাঝ দিয়ে বামের একটি অংশ চব্বিশের ২ অগাস্ট ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করেছিল। ফলে এবারের ডাকসু সামনে রেখে বাম প্রার্থীরা ছিল সম্ভাবনাময়।
এরই মাঝে ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগাঠনিকভাবে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। তাদের একমাত্র সমস্যা তাদের রাজনৈতিক আদর্শের ৫৪ বছর আগে একাত্তরের অপরাধ।
শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক আদর্শের ৭২-৭৫ ও ২০০৯-২৪-এ সংঘটিত অপরাধ জামায়াতের একাত্তরের অপরাধ দিয়ে ঢেকে রাখতে চেষ্টা করেছেন তার কথার কালো জাদু দিয়ে। তার কথার কালো জাদুর একটা অভিধান ছিল, যেখানে তিনি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিতে একীভুত করে রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী, পাকিস্তানপন্থী তকমা দিতেন।
অবশেষে তিনি ২০২৪ সালের জুলাই-এ জেন-জিকে 'রাজাকারের নাতিপুতি' তকমা দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। ভারতে পালালেন হাজার হাজার দোসরসহ। তার স্নেহভাজন ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম, বছরের পর বছর ভিন্নমতের ছাত্রদের পাকিস্তানপন্থী বলে তকমা দিয়ে অবশেষে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র কত বিচিত্রভাবেই না কাজ করে।
শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর তার কথার কালো জাদুতে ঠাসা অভিধানটি হাতে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে ছাত্রদল ও বাম ছাত্র সংগঠন। যে তকমা দিয়ে হাসিনা দেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছেন; সে তকমা দিতে দিতে যেন হাসিনার তোতা হয়ে পড়ে ছাত্রদল ও বাম ছাত্র সংগঠনের নেতারা।
ছাত্রশিবির একটি অযৌক্তিক আচরণ করে এরই মাঝে। তারা জুডিশিয়াল কিলিং-এর অজুহাতে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ছবি টাঙ্গিয়েছিল ঢাবি ক্যাম্পাসে তাদের একটি অনুষ্ঠানে। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো গিয়ে প্রতিবাদ করে ছবিগুলো নামাতে বাধ্য করে। এ পর্যন্ত ব্যাপারটা প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর ক্যাম্পাসে ২০০৯-২৪-এর মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ছবি টাঙ্গানো হলে কেউ না কেউ গিয়ে প্রতিবাদ জানাবে। ছবি নামাতে বাধ্য করবে।
কিন্তু ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি। বাম ছাত্র সংগঠনের একজন নেতা বাগছাসের এক নেতাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে জেন-জি এক ছাত্র শিবির নেতাকে পাকিস্তানি বলে। এই শ্লোগান দেওয়ার সময় তার অভিব্যক্তি ও মুখাবয়বে শেখ হাসিনা কালো জাদুর শব্দমালার অভিধান হয়ে হাসতে থাকতে। সেটাই ছিল ডাকসু নির্বাচনের ডিসাইসিভ মোমেন্ট। ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণাতে ঐ বাম ছাত্রনেতা হাসিনার অভিধান আউড়ে গেছে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। ঐ ট্রেন্ড ফলো করে ছাত্রদল নেতা হাসিনার তোতার মতো করে তকমা দিয়ে গেছে।
ভারতীয় মিডিয়া এনসিপিকে ইসলামি মৌলবাদী তকমা দেওয়ায়, এরপর বিএনপি, বাম প্রৌঢ়, ইন্ডিয়ান কালচারাল ফ্যাসিস্টদের ঢাকাস্থ লোকজন এনসিপিকে জোর করে ইসলামি জঙ্গি বানাতে চেষ্টা করেছে। এনসিপির সঙ্গে সম্পর্কিত বাগছাস নেতা পিয়ার প্রেশারের কারণে বাম ছাত্রনেতার সমভিব্যহারে গিয়ে শিবিরের একবিংশ শতকে জন্ম নেওয়া নেতাকে পাকিস্তানি বলার শ্লোগানে সুর মিলিয়েছে। ঐখানে বাগছাসের মধ্যে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের নায়েব হিসেবে বাগছাসকে দেখতে চায়নি কেউই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর কান পচে গেছে ছাত্রলীগের মুখে এসব অযৌক্তিক তকমা শুনে শুনে। বাম ছাত্রনেতার মুখে একই তকমা শুনে তাদের তীব্র বিবমিষা জন্মেছে। এভাবে নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকতে চায় কে; যেখানে জেন-জি প্রজন্মে এসেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারি কালচারের প্রচ্ছায়া দেখা যাবে।
ডাকসু নির্বাচনে তাই ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে একমাত্র অপশন ছিল ছাত্রশিবির। চারুকলায় ছাত্রশিবিরের প্রার্থীর হিজাব পরা ছবিতে শিং এঁকে দেওয়ার মধ্যে শিবসেনার প্রচ্ছায়া দেখে ভয় পেয়েছে মেয়েরা। তাইতো ঐ প্রার্থী জয়ী হলে সবাই, হিজাব হিজাব বলে চিৎকার করেছে। হিজাব পরা মেয়েদের অপরায়নের রাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আজ এই মোড়ে নিয়ে এসেছে।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনাই প্রথম মাথায় কালো পট্টি বেঁধে মহিলা হাজি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশে নারী নিগ্রহের ব্যাপারটা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত। যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে; তখন সেই দল নারী নিগ্রহ করেছে। এসব হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে বাঁচতে মেয়েরা হিজাব পরে চলাফেরা করতে শুরু করে। ২০০১-এর টুইন টাওয়ার হামলার পর ইসলামোফোবিয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী মেয়েদের হিজাব বা স্কার্ফ পরার চল ঘন হয়। এখন সেটা ফ্যাশনে রুপান্তরিত হয়েছে।
পরাজয় মেনে নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের সমাজে বেশ কম। তাই পরাজিতরা নতুন থিওরি নিয়ে হাজির হয়েছে, হাসিনার পতনের পর ছাত্রলীগের ছেলেরা ছাত্রশিবিরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। শিবির ছাত্রলীগে গুপ্ত ছিল বলে বিভিন্ন রকমের দাঁত বের করে হেসেছে আমাদের গ্রামের স্বঘোষিত প্রগতিশীল অথচ রক্ষণশীল অংশ। গুপ্ত রাজনীতির কৌশল বামপন্থীরা চর্চা করেছে নানা সময়ে; মানুষ নিজে যেটা করে, সেটা অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চায়। হাসিনা যেমন নিজে প্রমাণিত ভারতপন্থী হওয়ায়, ভিন্নমতের মানুষকে নির্লজ্জের মতো পাকিস্তানপন্থী বলেন।
আমাদের সমাজে প্রগতিশীলতা ব্যাপারটি অন্যান্য সমাজের মতো নয়। কৃষক, কারিগর, নিম্নবর্গের মানুষের ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা শিখলে; নিজের বাবা-মাকে তাদের আনস্মার্ট মনে হয়। তাদের কথাবার্তার আঞ্চলিক উচ্চারণ নতুন শিক্ষিত সন্তানদের কুঞ্চিত করে। এরা তখন নদীয়ার আঞ্চলিক টানে বাংলা বলা শেখে কন্ঠশীলনে গিয়ে। একান্ত সম্ভব না হলে বাড্ডা-কুড়িলের বাংলাটা বলসেন, খাইসন, গেসেন দিয়ে বলে। সু-অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার মতো চোখে কাজল দিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে জমিদার দুহিতার মতো কথা বলা প্র্যাকটিস করে। এরা ওয়েবার, টার্নার, মিশেল ফুঁকো, জিজেক, দেরিদা, অরুন্ধতী রায় নামগুলোর রঙ্গিন পাথরের , মাটির গয়না কিংবা রুদ্রাক্ষের মালা পরে নতুন সাংস্কৃতিক জমিদার হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে। অন্য ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব হা করে তাদের কথা শোনার আর মাথা নাড়ার। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনজিও আপা ও ভাইয়া সেজে ঘুরে; যেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী চরাঞ্চলের বাসিন্দা; এনজিও জমিদারের কাছ থেকে আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল শিখবে।
এইসব নাটক বিংশ শতকে বেশ চলেছে। কিন্তু একবিংশের ২৫ বছর কেটে যাবার পর এসব রেস্টোরেশন যুগের ওয়াই চার্লির নাটক আর মুসোলিনির ইতালির হোয়াইট টেলিফোন মুভির মতো দেখাচ্ছে। ইন্টারনেটে গোটা পৃথিবীর দৃশ্যকল্প তরুণ-তরুণীদের সামনে উন্মুক্ত। লিবেরেল বিশ্বে সাম্যচিন্তার উদ্ভাস দেখে; এসব সাংস্কৃতিক শ্রেণী প্রথার জোড়াসাঁকোর পোশাক পরা রক্ষণশীল চিন্তাভাবনাকে তারা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে একযোগে।
ডাকসু ও জাকসুতে ছাত্রশিবিরের কৃতিত্ব একটাই, শত অপমানের মুখে শান্ত থাকা। স্বাভাবিক আচার আচরণ করা। প্রথম আলোসহ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারেরা যখন ডাকসুতে তাদের নন্দন ও নন্দিতা নিয়ে আদিখ্যেতা করছে; তখন সেই ভাঙ্গা চৌধুরী বাড়ির অনেক কষ্টে জমিদার তনয় তনয়া সাজানো প্রার্থীদের অজস্র ভিউ আর ফুরিয়ে যাওয়া প্রৌঢ় প্রৌঢ়াদের প্রগলভ প্রশংসার ঢেউ দেখে; মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলীর সঙ্গে ভোটের নীলপদ্ম সংগ্রহ করতে গেছে। ভোটাররা কথা রেখেছে, তেত্রিশ বছর পর সবাই কথাই রেখেছে। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পতন ঘটেছে।
একটা ভোটে হেরে কিংবা জিতে যাওয়াই পৃথিবীর শেষ কথা নয়। এখান থেকে পাওয়া শিক্ষা হচ্ছে অহংকারীর পতন হয়। অতীতে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, বাম ছাত্র সংগঠনের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে ছাত্রশিবিরকে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণার জায়গা। স্বকীয় সংস্কৃতি চর্চার জায়গা। নামাজ ও পূজার নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে আল আকসা মসজিদ কিংবা রামমন্দির বানানো বিশ্বের বিদ্যাকে লয় বা বিনাশ সাধন করে।
গত বছর জুলাই বিপ্লবের ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর ছিল নারীসমাজ। তারা যখন পথে নেমেছে, তখন ফ্যাসিস্ট এর পতন কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
এ বছর ডাকসু ও জাকসুর ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর ছাত্রীরাই। তারা যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসান ঘটেছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নারীশক্তির ওপর। তাদের এগিয়ে যাবার পথে ভুল করেও কেউ যদি বাধা তৈরি করতে আসে, তারা উচ্ছেদ হয়ে যাবে।
পাঠকের মন্তব্য