লেখা: মাহীন হক
একদিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপাল ভাঁড়কে হুদাই প্যারা দেওয়ার জন্য বললেন, কাল রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি, বুঝলে। দেখলাম তুমি আর আমি একসাথে হাঁটছি, এরমধ্যে হঠাৎ আমি পড়ে গেলাম একটা মধুর গর্তে আর তুমি পড়ে গেলে পায়খানার গর্তে। এইসব বিটলামির প্রতিযোগিতার জন্য তো গোপাল সদাই প্রস্তুত। সাথে-সাথেই তিনি জবাব দিলেন, মহারাজ, আপনি ঠিকই দেখেছেন, কিন্তু পুরাটুকু দেখেন নাই। স্বপ্নের বাকি অংশটুকু দেখেছি আমি। গর্ত থেকে ওঠার পর আমি আপনার শরীর চেটে পরিষ্কার করে দিয়েছিলাম আর আপনি আমার।
গল্পটা চেনা। তবে হয়তো কেউ গোপাল ভাঁড়ের বদলে বীরবল, কিংবা মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা, কিংবা তেনালি রামার নামে পড়েছি। যার নামেই পড়ি না কেন, গল্পটার কঙ্কাল একই—ক্ষমতা-সম্পর্কে রাজার বহু নিচে থাকা সত্ত্বেও কথার প্যাঁচে রাজাকে দিয়ে গু চাটিয়ে নেওয়া। ঐতিহাসিকভাবে এটাই হলো দরবারি ভাঁড়ের কাজ। পৃথিবীর সকল রাজ্যে, সকল সভ্যতায়ই তার দেখা পাবেন আপনি, শুনতে পাবেন তার কিংবদন্তী। ইতিহাসের যেখানেই পাওয়া যাবে নিজেকে সর্বশক্তিমান ঠাউরানো কোনো মহাপ্রতাপশালী সম্রাটকে, সেখানেই পাওয়া যাবে এক আপাত-গোবেচারা ভাঁড়কে, যে সদা প্রস্তুত সম্রাটকে তার বুদ্ধির সীমানা দেখিয়ে দিতে।
গ্রিক ভাষায় যাকে বলে পারহেসিয়া—অর্থাৎ ক্ষমতার মুখের ওপর সত্য বলা, সেই ভূমিকাটাই পালন করে এসেছেন এই ভাঁড়েরা। ক্ষমতাসীনরা যেই একচ্ছত্র আনুগত্য, একমুখী প্রভুত্ব দাবি করে, তারই বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। কিন্তু যেহেতু সরাসরি তাদের বিরোধিতা করলে কল্লা যাবে, তাই তারা আশ্রয় নেন এক বিকল্প ভাষার। সেই ভাষা ধাঁধার, চুটকির, হাস্যরসের। আমরা দেখতে পাই, সেই খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকেও গ্রিসের নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিস তার কমেডি নাটক 'ক্লাউডস'-এ দেখান দেবতাদের রাজাধিরাজ জিউস পাদ দিচ্ছে। কেননা হাস্যরস চিন্তার এমন একটা পরিসর, যেখানেই সবকিছুই প্রশ্নের অধীন। কোনোকিছু নিজেকে যতটাই গুরুত্বপূর্ণ দাবি করুক না কেন, এখানে সবকিছুকেই খেলো, হাল্কা করে ফেলা যায়। শেক্সপিয়রের প্রায় সকল নাটকেই এরকম একজন ভাঁড়ের দেখা আমরা পাই। কিন্তু শেক্সপিয়রের সবচেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি, হ্যামলেটে আমরা দেখি সেই ভাঁড়, ইয়োরিক, মারা গেছেন। ক্ষমতার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর কেউ নেই এইখানে, ফলে হ্যামলেটের ডেনমার্ককে দেখানো হয় অন্তর পচে যাওয়া এক রাষ্ট্র হিসেবে।
তবে দরবারি ভাঁড়েদের এই গল্পগুলোর সত্য-মিথ্যা যাচাই করা বেশ কঠিন। একই গল্প কখনও গোপাল ভাঁড়ের নামে, কখনও বীরবলের, কখনও নাসিরুদ্দিন হোজ্জার নামে আমরা পড়েছি। এর কারণটাও সহজে বোঝা যায়। এই গল্পগুলো বেশিরভাগ সময়ই ক্ষমতার বিপরীতে গিয়ে অসহায় গণমানুষের পক্ষে কথা বলে। গোপাল ভাঁড়ের নামেই প্রচলিত ওই গল্পটা তো আমরা জানি:
একজন গরিব কৃষককে রাজা পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে বলেন মাঘ মাসে ঠান্ডা পুকুরে সারারাত গলা অব্দি ডুবে থাকতে। পরে এই অজুহাতে রাজা আর পুরস্কার দিলেন না যে দূরের এক রাজমহলের মশালের আগুনে সে নিজেকে উষ্ণ রেখেছিল। এর শোধ নিলেন গোপাল ভাঁড়। পরদিন দরবারে এলেন না। রাজা লোক পাঠিয়ে দেখলেন গোপাল ভাঁড় গাছের মগডালে হাড়ি বসিয়ে একদম নিচে আগুন জ্বেলে খিচুড়ি রাঁধছেন। দূরের রাজমহলের মশাল দেখে যদি উষ্ণ থাকা যায়, তাহলে এভাবে খিচুড়ি নিশ্চয়ই রাঁধা যাবে। আবার এক প্রাচীন চীনা গল্পে পাই জিং শিনমোর কথা। এক হাকিম সম্রাটকে অনুরোধ করেন শিকার করার সময় যেন তিনি কৃষকদের ফসল নষ্ট না করেন। সম্রাট তো রাগে ফুঁসে ওঠেন, টেনেহিঁচড়ে সেই হাকিমকে নিয়ে আসেন দরবারে। তখন সেই দরবারি ভাঁড়, জিং শিনমো আরো চেতে গিয়ে বলেন, কল্লা কাটা হোক এই ব্যাটার, সেইসাথে সমস্ত চাষার ফসল নষ্ট করে ভুখা করে রাখা হোক গোটা রাজ্যকে। তাতে রাজস্ব না পেয়ে পেয়ে রাজকোষ ফাঁকা হলে হয়ে যাক, কুছ পরোয়া নেহি। জিং শিনমো কিংবা গোপাল ভাঁড়দের এইসব তেরছা কৌতুক, অতিরঞ্জন, ঠেসমারা—এগুলো যেন আয়না তুলে ধরে খোদ সম্রাটের সামনে। পদদলিত জনমানস ও তাদের আকাঙ্ক্ষা এইসব গল্পের মধ্য দিয়েই ভাষা খুঁজে পায়। তাদেরই অক্ষম প্রতিরোধের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন এই হাসিয়েরা। ক্ষমতাসীনের যদি থাকে শাণিত তলোয়ার, ভাঁড়েদের আছে ক্ষুরধার বুদ্ধি। এই বুদ্ধির জোরেই সমস্ত সাম্রাজ্যকে বিদ্রুপ করে গেছেন এই ভাঁড়েরা। জীবনানন্দের ভাষায়,
আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন;
ফসল—ধানের ফলে যাহাদের মন
ভরে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা ক’রে গেছে পৃথিবীর সব সিংহাসন…
পাঠকের মন্তব্য