বিদায় আরেফিন স্যার

৬৪২ পঠিত ... ১৫:৩৭, মার্চ ১৫, ২০২৫

25

আরেফিন স্যার আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না; কিন্তু বিতর্কের আসরগুলোতে স্যারের সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতো। বিতার্কিক হিসেবে কোনো বিতর্কের বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে স্যারের কাছে গেলে; উনি সস্নেহে আলাপ করতেন। শিক্ষক হিসেবে উজাড় করে দিতেন তার সমস্ত জানাশোনা। উনার স্থিতধী ভঙ্গিটি শিখতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আসলে পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকে বেড়ে ওঠা মানুষের মতো সফিস্টিকেশন অর্জন হয়তো আমাদের সময়ে সম্ভব হলো না।

সিভিল সার্ভিসে ঢোকার পর একদিন স্যারের সঙ্গে দেখা হলে তিনি জোর করে শিক্ষকদের ক্লাবে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়িত করেন। জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউটে বিভাগীয় প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে পেয়ে চিন্তা বিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল। উনি সেদিন দেরিদাকে উদ্ধৃত করে সাবধান করেছিলেন, টেকনিকে অনেক এগিয়ে গেলে আর কনটেন্টে পিছিয়ে পড়লে খুব অসুবিধা হবে। সোশ্যাল মিডিয়া বিকাশের পর সে কথাটা প্রায় প্রতিদিনই মনে পড়েছে।

সরকারি গণমাধ্যম থেকে ও প্রাইভেট টিভিতে মুনলাইটিং করতে গিয়ে আরেফিন স্যারকে যখনই ফোন করেছি, সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিয়েছেন। কোনো মিটিং-এ থাকলে তা শেষ করেই কলব্যাক করেছেন। এই প্রজন্মটির কাছে এই বেসিক অ্যাটিকেটগুলো শেখার সুযোগ পেয়েছি আমরা। উনি কষ্ট করে আগারগাঁও-এ জাতীয় বেতার ভবনে এসেছেন রেডিও আলোচনায় অংশ নিতে। ছাত্রের প্রতিটি আবদার পূরণে একজন শিক্ষকের সতত আন্তরিক থাকার দৃষ্টান্ত তিনি। জার্মানির ডয়চে ভেলে থেকে ফোন করে উনার ইন্টারভিউ নেবার ছলে; একটা নিয়মিত আড্ডাও চালু ছিল। দেশে ফিরলে টিএসসিতে আবার বিতর্কের অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে গেলে; স্যার সস্নেহে আলিঙ্গন করেন। আমি তাকে বলেছিলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার ভিসি না হওয়ায় যে দুঃখ পেয়েছিলাম; আপনি ভিসি হওয়াতে তা পুষিয়ে গেল। স্যার স্মিত হেসে বলেছিলেন, ভিসি না হওয়ায় স্যারের সুনাম অক্ষুণ্ণ রয়েছে। আমি সেটা হারিয়ে ফেলব, আশঙ্কা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হবার পর স্যারের সুনাম কমতে শুরু করে। আমি তখন আবার দেশান্তরী হয়েছি। স্যারের সঙ্গে ফোনে কথা হতো। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া স্টাডিজ পড়াতে শুরু করেছি। স্যার গল্পে গল্পে আমাকে টিচিং টিপস দিতেন। ই-সাউথ এশিয়া শুরুর আগে পিপলস মিডিয়ার আঙ্গিক ও প্রকরণ নিয়ে কথা বলতেন। উনি পরিচয়ের পর থেকে প্রায়ই আমার এ-পলিটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করতেন। এই যে কোনো দলে না গিয়ে সবসময় সরকার সমালোচক হিসেবে রয়ে যাওয়া। স্যার ঠিকই খুঁজে খুঁজে আমার পলিটিক্যাল স্যাটায়ার পড়তেন। উনি কম হাসেন। কিন্তু স্যাটায়ারের প্রসঙ্গটা নিজেই তুলে হাসতেন। কারণ স্যারকে নিয়েও স্যাটায়ার লিখেছি সে সময়। উনি বরং আরও লিখতে উৎসাহিত করেছেন। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অচলায়তনে আটকে পড়া মানুষ ছিলেন তিনি। আর আওয়ামীলীগের ফ্যাসিজমের অংশ হয়ে পড়েছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতি ভিলেজ পলিটিক্স আঙ্গিকে রয়ে যাওয়ায়; ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ে। ফলে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ফক্সফোর্ডে রুপান্তরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের জীবন তিন রকম হতে পারে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো পদ পদবীর মোহে না গিয়ে শ্রেণি সংগ্রামের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতো এ-পলিটিক্যাল থেকে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখা। অথবা আরেফিন সিদ্দিকের মতো উপাচার্য হয়ে সারাজীবনের অর্জিত সুনাম ধীরে ধীরে ক্ষয় করে ফেলা।

স্বাধীন বাংলাদেশ এমন এক জায়গা যেখানে দ্বিদলীয় রাজনীতি তার খড়্গ নিয়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গোপালগঞ্জ গ্রাম ও বগুড়া গ্রাম প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আধুনিক মেট্রোপলিটান মন ধরে রাখা কঠিন। এমনকি প্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকলেও পলিটিক্সের ফুট সোলজাররা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করা মাত্র ঐ ব্যক্তিকে কলতলার কাদায় নামিয়ে আনে টেনে হিঁচড়ে।

এই যে বিজন গ্রামের কালচারের নামে আনকালচার্ড জোট, এরা কিংবদন্তীর কবি আল মাহমুদ মারা গেলে তার মৃতদেহ শহীদ মিনারে আনতে দেয় না, আরেফিন সিদ্দিকীর মৃতদেহ বিপ্রতীপ প্রতিশোধপ্রবণ জোটের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার সাহস পান না তার পরিবার। এ এমন সমাজ যেখানে শত্রুর ফাঁসিতে বিরিয়ানি খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়েছে; ফলে মৃত আরেফিন সিদ্দিকীর স্বাস্থ্যপান নতুন বাংলাদেশে চলবে এতে অবাক হবার কিছু নেই।

এই ক্যানিবাল দলাদলিটা ধরে রাখতে হয় রাষ্ট্রটাকে টাকা বানানোর যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কুঁড়ে ঘর থেকে রাজপ্রাসাদে উঠে আসতে, টেম্পু থেকে হেলিকপ্টারে চড়তে, বঙ্গবাজারের টি-শার্ট খুলে ডিজাইনার টি-শার্ট পরতে। এই যে ক্ষমতার আকালের সন্ধান, এখানে চোখের বদলে চোখ হচ্ছে ৫৪ বছরে অন্ধ হয়ে যাওয়া একটি রাষ্ট্রের ট্র্যাজেডি।

প্রাচীনকালের যুদ্ধেরও কিছু নিয়ম-কানন ছিল। শত্রুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশের ও তার শেষকৃত্যে সামষ্টিক অংশ গ্রহণের একটা আচরণ বিধি ছিল। কিন্তু ভারত সমর্থিত আওয়ামী ফ্যাসিজমকালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বর্বর যুগে। এখন আওয়ামীলীগ ক্যানিবাল হয়েছে বলে, ৫ আগস্টের পরের নতুন বাংলাদেশেও সেই ক্যানিবালিজমের প্রতিশোধ নিতে হবে, এই যদি সংকল্প হয়; তাহলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ানোর সামর্থ্য হারাবে। রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই করতে করতে রাক্ষস হয়ে যাওয়া; নিজের অসামান্য ক্ষতি।

মোদি ও হাসিনার মতো আদিম মানুষের কাছ থেকে কিছুই যে শেখার নেই। ওদের শিষ্যরা কবি আল মাহমুদের মৃতদেহকে অপমান করবে; সেটাই তাদের কালচারাল স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু ৫ আগস্টের পরের বাংলাদেশে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের মৃতদেহের অমর্যাদা হবে না; সেটাই সভ্যতার শিক্ষা। বাংলাদেশ সমাজে কাউকে হয় মহামানব কিংবা মহাদানব হিসেবে চিত্রিত করার ভাটিয়ালি চর্চাটা বাস্তবতা বিবর্জিত।

যে আমারে দেখিবারে পায়

অসীম ক্ষমায়

ভালো-মন্দ মিলায়ে সকলি

 

৬৪২ পঠিত ... ১৫:৩৭, মার্চ ১৫, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top