কোভিডকালীন আমি ঢাকার এক বিখ্যাত কর্পোরেট হাসপাতালের আইসিইউ স্পেশালিস্ট ছিলাম ।
কোভিড আক্রান্ত একজন ভদ্রলোক ভর্তি হলেন আইসিইউতে, ভদ্রলোক মারাত্নক চোটপাট করলেন, টাকা পয়সা অর্থ ক্ষমতা ওনার কাছে কোনো ইস্যুই না তখন। আমি যেদিন ওনাকে রোগী হিসেবে রিসিভ করলাম সেদিন ওনার আচরণ আমাকে মারাত্নক ব্যথিত করেছিল।
বড় জায়গা, কোটিপতিদের হিসাব নিকাশ, অনেক সময়ই চুপ থাকতে হয়! বড়লোকদের টুকটাক চিৎকার, গালমন্দ হজম করে ম্যানেজ করতে না পারাটাও কর্পোরেটে ডিসক্রেডিট হিসেবে গণ্য হয়।
দিনের পর দিন উনি আস্তে আস্তে অক্সিজেন ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেলেন, পোস্ট কোভিড লাংস ফাইব্রোসিস ওনার। হাই ফ্লো একটু খুললেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, দাপাতে থাকেন, ওনার জোড়া ফুসফুস তছনছ করে দিয়েছে কোভিড। দিনে দিনে ভদ্রলোক খুব চুপচাপ হয়ে যেতে লাগলেন।
একদিন রাত দশটায় আইসিইউ রাউন্ডের সময় উনি ইশারায় আমাকে ডাকলেন, আমি বুঝলাম কিছু বলতে চান। কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন—আসিফ! আমার গার্মেন্টসগুলোর পেছনে লোন বাড়তে বাড়তে প্রায় শতকোটি টাকা এখন, ছেলে কানাডা থেকে ফেরত চলে এসেছে, লেখাপড়াই করে না, আমার তিন স্ত্রীর কেউই তেমন যোগাযোগ রাখে না আর আমার সাথে, জীবনে বহু ভুল করেছি, উত্তরায় কিছু জায়গা দখল করেছিলাম, এরমধ্যে একজন মূল জায়গার মালিক মারা গেছেন, উনি আজীবন আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন। আমি একের পর এক থ্রেট দিয়ে গিয়েছি ওনাকে। আহারে, কী করলাম! কী করলাম!
ভদ্রলোকের শ্বাসকষ্ট বাড়ছেই, আমি বিড়বিড়িয়ে বললাম, আপনি চুপ থাকুন, রেস্ট নিন, সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!
উনি আবারও বলা শুরু করলেন, আমি সুযোগ পাব না আর, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না, আল্লাহ সুযোগ দিয়েছিলেন, কাজে লাগাইনি। তুমি বাবা রাগ রেখ না, ভর্তির দিন খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম আমি।
আমি বিড়বিড়িয়ে বললাম, আপনি অসুস্থ ছিলেন, এমন ব্যবহার হয়তো ইচ্ছা করে করেননি!
উনি আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, না, আমি জেনেশুনে বুঝেই চোটপাট করেছি, বুঝাতে চেয়েছি আমার ক্ষমতা! এখন আর চোটপাটের শক্তিও নেই রে বাবা! মিনমিনিয়ে কথা বলি দেখো না, আল্লাহ ইঁদুর বানিয়ে দিয়েছেন, চিঁচিঁ শব্দ তুলি, গলা দিয়ে আওয়াজই বের হয় না!
ভদ্রলোক মারা গিয়েছিলেন কিছুদিন পরই, ঘটনাটা আমার হৃদয়ে দাগ কেটে দিয়েছে।
প্রতিটা জিনিসের হিসেব হবে, যে হিসাবে অন্যের হক জড়িয়ে যায়, আল্লাহ খুব রুষ্ট হয়ে যান হয়তো,
আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না।
আল্লাহ সেই ভদ্রলোকের আযাব কমিয়ে দিন, শেষ সময়ে উনি আমাকে কিছু আমল বাতলে দিয়েছেন, আমি ওনার জন্য দোয়া করি, আমিন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন