'ডাক্তার সুরক্ষা আইন' কোথায়?

৬৫ পঠিত ... ১৮:২৪, সেপ্টেম্বর ০১, ২০২৪

34 (10)

লেখা: মুকতাদির হাসান মাশুক

এমন অসংখ্য টাইপ সম্ভব,জাস্ট ২ টা সিনারিওর কথা বলি…

সিনারিও ১: মনে করুন,আপনি পেশেন্ট নিয়ে হসপিটালে গেছেন। রোগী স্মোকার ছিলো, এখন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। ডাক্তার সবকিছু দেখে তাকে অক্সিজেন দিলো।তবে খুবই লো ডোজে।এদিকে রোগী নিঃশ্বাস নিতে পারছে না,হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে,নীল হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। আপনি বারবার ডাক্তারকে বলছেন অক্সিজেন বাড়িয়ে দিতে। কিন্তু ডাক্তার কোনমতেই অক্সিজেন বাড়িয়ে দিচ্ছে না, সাপ্লাই থাকা সত্ত্বেও। আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার পেশেন্টের মৃত্যুকষ্ট দেখছেন। আপনার মনে হচ্ছে অক্সিজেনটা একটু বাড়িয়ে দিলেই রোগীটা বেঁচে যেতো। ডাক্তারটা ইচ্ছে করে অক্সিজেন দিচ্ছে না,টাকা খাবে সেজন্য। রাগে আপনার মাথা গরম হয়ে গেলো। হাতের কাছে যা পেলেন তা দিয়ে ডাক্তারের গায়ে দুমাদুম বসিয়ে দিলেন...

 

সিনারিও ২: আপনার রোগী হার্ট অ্যাটাক করেছে। সাথে সাথে হসপিটালে আনলেন। ডাক্তার তাকে কিছু ওষুধ খেতে দিলো। কিন্তু তীব্র ব্যাথা আর কষ্ট।কোনমতেই কমছে না।আপনি বারবার ডাক্তারকে অনুরোধ করতে লাগলেন যে, ডাক্তার সাহেব, কিছু একটা করেন। আপনার কথা শুনে ডাক্তার অপারগ হয়ে আপনার পেশেন্টকে একটা ইনজেকশন দিলো। সাথে সাথে রোগী মারা গেলো। যে লোকটা একটু আগেও সুস্থ স্বাভাবিক ছিলো, তার এমন হঠাৎ মৃত্যু আপনি মেনে নিতে পারলেন না। আপনার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। আপনার মনে হল ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার জন্যই আপনার পেশেন্টটা আজ মরে গেলো। কয়েকজন লোক ডেকে এনে হাতের কাছে যা পেলেন দুমাদুম ডাক্তারের গায়ে বসিয়ে দিলেন…

দেখেন,আমরা আপনার আবেগকে সম্মান করি। আপনার মনের অবস্থাও বুঝছি। কিন্তু স্বাভাবিক কমনসেন্স আর ডাক্তারি বিদ্যা অলওয়েজ একই পথে চলে না। এজন্যই ইন্টার্নসহ ৬ বছর কঠোর পরিশ্রমের পরে আমরা ডাক্তার হই। প্রথম সিনারিওতে পেশেন্টটা COPD-তে আক্রান্ত। তার নিঃশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার একমাত্র ড্রাইভ রক্তের কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এখন যদি আমি হাই-ফ্লো অক্সিজেন দিই,তাহলে দ্রুত রোগীর রক্তের কার্বন-ডাই-অক্সাইড মাত্রা কমে গিয়ে রোগীর নিঃশ্বাস একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। লো-ডোজ অক্সিজেনে রোগী হয়ত কষ্ট পাবে। কিন্তু হাই ফ্লো দিলে সাথে সাথে রোগী মারা যাবে। একজন ডাক্তার হিসেবে আমি এটা জানি। কিন্তু আপনি জানেন না, আপনার জানার কথাও না। কিন্তু সুযোগ বুঝে রাগ ঝাড়ার অংশ হিসেবে আপনি আমাকে মেরে দিলেন। কারণ আপনি জানেন,ডাক্তারকে মারলে তেমন কোন সমস্যা নেই।

২য় সিনারিওতে আপনার অনুরোধে আমি একটা ইনজেকশন দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো রোগীর যে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে সেটা কমানো। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক এমন একটা বিষয় যে ১৫ মিনিট আগে হাসিমুখে কথা বলা রোগীও হঠাৎ করে মারা যেতে পারে। স্যাডলি রোগীটা হয়ত এমনিই মারা যেতো। কিন্তু যেহেতু আমি ইনজেকশন দেয়ার পরপরই রোগীটা মারা গেছে, তাই আপনার মনে হল আমি ভুল ইনজেকশন দিয়ে রোগী মেরে ফেলেছি। এদিকে আপনি এলাকার হ্যাডা,তাই আপনার চ্যালাচামুণ্ডা নিয়ে এসে আপনি মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিলেন। কারণ আপনি জানেন,হসপিটালের বাইরে এসে এই ডাক্তার আপনার চুলটাও ছিঁড়তে পারবে না।

এবার আসেন টপিকে ফিরি,আজ থেকে ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তাররা কর্মবিরতিতে গেছে, ইমার্জেন্সিও বন্ধ করা হয়েছে। হয়ত পরবর্তীতে আরো অনেক মেডিকেল আমাদের সাথে যোগ দিবে। কারণ গত একরাতেই ঢাকা মেডিকেলে ৩ বার পেশেন্ট পার্টি কর্তৃক ডাক্তারদের উপর অ্যাটাক হয়েছে। অনেক ডাক্তার আহত হয়েছে,ইমার্জেন্সি ভাঙচুর হয়েছে। যদ্দুর শুনছি,এই গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে একজন নিরীহ রোগী মারাও গেছে। আমাদের দাবি কী?ডাক্তার সুরক্ষা আইন।আমরা কোনো টাকা চাই না, চাকরি স্থায়ীকরণ চাই না। আমাদের দাবিতে সরকারকে বিপদে ফেলা বা অর্থনৈতিকভাবে চাপ দেয়ার কোনো ইলিমেন্টও নেই। আমরা জাস্ট চাই উপরের ২ টা সিনারিও, বা এর মতো আরও হাজার হাজার সিনারিওতে যেন কেউ তদন্ত ছাড়া ইচ্ছামত ডাক্তারদের গায়ে হাত না তোলে। আর হাত তুললে তার শাস্তি সম্পর্কে যেন সুনির্দিষ্ট আইন কাঠামো থাকে।আপনার মনে হতে পারে,হাস্যকর দাবি।এমন আইন কি নেই?জ্বী ভাই,আসলেই নেই। নিরাপদে কর্মস্থলে সেবা দেয়ার জন্য এই নূন্যতম নিরাপত্তা আইনটুকুও বাংলাদেশের ডাক্তারদের জন্য নেই।

যদি কোনো ডাক্তার ভুল করে, নেগলিজেন্সি হয় এবং তার কারণে রোগীর মৃত্যু দূরের কথা, ন্যূনতম ক্ষতিও হয়, সেই ডাক্তারের বিচার হোক। কিন্তু সেটা হতে হবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তদন্ত সাপেক্ষে। আপনার মনে হল ভুল চিকিৎসা,মেরে দিলেন। আপনার মনে হল নেগলিজেন্সি, গায়ে হাত তুললেন… এমন মামা বাড়ির আবদার আর মেনে নেয়া হবে না। অনেকে বলে ডাক্তার কেন গ্রামে যায় না, বিশেষ করে ফিমেইল ডাক্তার।যেদেশে ডাক্তারদের নিরাপত্তার জন্য নূন্যতম একটা আইন নাই,সেদেশে ডাক্তাররা উপজেলায় বা গ্রামে যাবে কিসের নিরাপত্তায়? আমার চোখের সামনে ইমার্জেন্সিতে এলাকার ফাইভ পাশ মেম্বারকে এমবিবিএস মহিলা ডাক্তারকে থাপ্পড় মারতে দেখছি।বিচার দূরের কথা,মামলাও নেয় নি।আর স্বাচিপ,বিএমএ,বিএমডিসি নামের যে ক্লাউন প্রতিষ্ঠানগুলো আছে,ওরা কালো ব্যাচ পরে জোকারগিরি করেছে।আর আমরা কিছু করতে গেলে উপর থেকে গায়েবি আওয়াজ এসেছে... তোমরা নিজে থেকে কিছু করতে যেও না,সমস্যা হবে। সমস্যা আসলে অলরেডি অনেক হয়ে গেছে।নতুন করে সমস্যা হবার কিছু নেই।   

এখন আলাপে আসি, ডাক্তার সুরক্ষা আইন হলে জনগণের লাভ কী? আর লস কী? জনগণের লস ১টাই, ইচ্ছেমতো ডাক্তারদের উপর মনের ঝাল আর গায়ের তেজ ঝাড়তে পারবেন না। ঝাড়লে নির্দিষ্ট শাস্তির আওতায় আসতে হবে। এলাকার হ্যাডারাও আর হসপিটালে হ্যাডম দেখাতে পারবেন না। কিন্তু রোগী হিসেবে আপনাদের লাভ কী হবে? উত্তরটা হলো প্রান্তিক পর্যায়ে সুচিকিৎসা। একটা সিক্রেট বলি, প্রান্তিক পর্যায়ে আসলে অনেক ইমার্জেন্সির চিকিৎসা পসিবল হলেও নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ডাক্তাররা সেটা দেয়া থেকে বিরত থাকে। কারণ ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট অলওয়েজই রিস্কি। যে রোগী মারা যাওয়ার, সে তো মরবেই। কিন্তু যাকে বাঁচানো সম্ভব তাকেও চিকিৎসা দেয়া হয় না আক্রমণের ভয়ে। কারণ সেই আক্রমণের কোনো বিচার নাই।বরং রেফার্ড করা হয়।আর পেশেন্ট পার্টির একটা অদ্ভুত সাইকোলজি আছে, তাদের মুমূর্ষু রোগীগুলোকে রেফার্ড করলে তারা মনে হয় খুশি হয়! তাদের কাছে মনে হয় যে রোগটা যে আসলে গুরুতর সেটা ডাক্তার বুঝতে পেরেছে, অ্যাডমিট করেছে। এই তো অনেক। কিন্তু এর ফলে যে তার পেশেন্টের বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে নাই হয়ে যায়। শুধুমাত্র ডাক্তার পিটিয়ে গায়ের ঝাল ঝাড়ার বৈধতা পেতে তারা যে সুষ্ঠু চিকিৎসাটা মিস করে সেটা তাদের মাথায় আসে না।

এজন্যই সারা দেশ থেকে সব ইমার্জেন্সি রোগীদের ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয় কারণ এখানে সিটের বাইরেও ভর্তি নেয়া হয়,আর ডাক্তাদের উপর আক্রমণের তেমন সুযোগ থাকে না। কিন্তু সেই ঢাকা মেডিকেলেই যখন একরাতে তিনবার ডাক্তাররা আক্রান্ত হয় তখন আসলে বসে থাকার আর কোনো সুযোগ থাকেনা। তাই অবশ্যই ডাক্তার সুরক্ষা আইন বাস্তবতা করে সকল ডাক্তারদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থলের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে বন্ধ থাকবে ইমার্জেন্সিসহ সকল কার্যক্রম। এতে হয়ত অনেক রোগী সীমিত সময় সঠিক চিকিৎসা পাবে না। কিন্তু আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সুচিকিৎসার আওতায় আসবে অগণিত মানুষ। তাই জনগণের কাছে অনুরোধ, আমাদের সাথে থাকুন। সুন্দর নিরাপদ একটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যেখানে সবাই সুচিকিৎসা পাচ্ছে এবং ডাক্তাররাও নিরাপদ… এমন একটা কিছুর স্বপ্ন তো আমরা সবাই দেখি। তাই না?

৬৫ পঠিত ... ১৮:২৪, সেপ্টেম্বর ০১, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top