আলোক-উজ্জ্বল প্রাসাদে জরির পোশাক পরে ঘুরছেন কজন কুইক রেন্টাল জমিদার। খুশিজলের স্ফটিক পাত্র হাতে নিয়ে সিকদার চোখ বুঁজে স্মৃতিচারণ করে। পাশের সোফায় একটা কালাশনিকভ; ব্যাংক ম্যানেজারদের গান শোনানোর বাদ্যযন্ত্র।
তিনি ম্যাজিক কার্পেটে বসিয়া আধ্যাত্মিক সাধনার এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমরা কে কে কুইক রেন্টাল জমিদার হইতে চাও?’
সামিট, ওরিওন, সিকদার হাতে ভিক্ষার থালা লইয়া গাহিলো, ‘একটা টেকা দিয়া যান, আমি গরীব ইনসান!’
অমনি তিনি বলিলেন, ‘কুন!’
একলাখ কোটি টাকা আকাশ হইতে বৃষ্টির মতন ঝরিল!
দ্রুততম ধনীরা সমবেত কণ্ঠে গান ধরিলো, ‘বুবু আমার বুবুজান, তুই যে আমার প্রাণের প্রাণ।‘
হাতির ঝিলে তখন বিশাল বপুর ভৌতিক এলাহী আলোর নাচন, ‘উনিই পারেন, উনিই পারিবেন!’
ধন্যধান্য পুত্রভরা আমাদের এই বসুন্ধরা হাতে পবিত্র কিতাব হাতে প্রবেশ করে। স্মিত হেসে বলে, পনেরো বছরের ধনাঢ্য মানেই অভিজাত। এখন কেউ আর ‘ফইন্নির ঘরের ফইন্নি’ বলার সাহস পায় না। বরং ইমেরিটাস সেইন্ট নিজামউদ্দিন আউলিয়া পত্রিকায় আমার গুণকীর্তন করে। আমি বারট্রান্ড রাসেল ফুটবল ক্লাবের প্রেসিডেন্ট।
অভিজাতেরা কেউ বলে আমি কামাল আতাতুর্ক ফুটবল ক্লাবের প্রেসিডেন্ট তো কেউ বলে, ’আমি জামালস্টোটল ফুটবল ক্লাবের প্রধান।‘ নক্সী টাইলসের মসৃণ মেঝেতে কে একজন ফুটবল গড়িয়ে দিলে, ফুটবলের সিপাহসালার এসে বলটা পায়ে আটকে বলে, ‘কীসের আর প্রাচীন ফুটবল ক্লাব; এখন এই তিন ফুটবল ক্লাবের মধ্যেই চ্যাম্পিয়ান, রানার আপ ও থার্ড পজিশন।‘ হঠাতই ফুটবলের সিপাহসালার একটি শ্বেত পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়। অমরতার আয়োজন যেন মিকেল এঞ্জেলোর ডেভিড মূর্তিতে।
ক্রিকেটের সিপাহসালার কাঁপন এসময় মোনালিসার মিস্টিক হাসি নিয়ে প্রবেশ করে অভিজাত জলসাঘরে। হঠাতই ফোন এলে কানে ফোন ধরা মাত্র সেও একটি শ্বেত পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়।
হাতে একটি তাম্রের সুরা পাত্র নিয়ে আসে থাকসিম আত্মীয়াত্রা। বীরদর্পে ঘোষণা দেয়, ‘পানি বিভাগের নতুন সংযোজন এখন ট্যাপ খুললেই আপনি পাচ্ছেন খুশিজল।‘
গুমগঞ্জের খেলা হবে মামা এসে ঠোঁটের সামনে আঙ্গুল রেখে বলে, ‘অল কুয়ায়েট, খুশিজলের মতো পচা কথা বলতে নেই। সবাই একটু আল্লা আল্লা করুন। ঋষি দরবেশ আসছেন কিন্তু।‘
দরবেশের শুভ্র বেশ; শ্মশ্রুতে আধ্যাত্মিকতার আলাপন।
: উপস্থিত হজরত সম্পদে কী এসে যায়, একদিন তো যেতে হবে সাড়ে তিনহাত কবরেই।
কে একটি কবি স্বভাবের লোক এসে একটি দরখাস্ত বাগিয়ে ধরে, একজন বিদূষকের হঠাৎ মৃত্যু ঘটেছে ডেঙ্গিতে। বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে সাড়ে তিন হাত জায়গা চাই মালিক!
অর্থনীতিবিদ লোটাস হাতে একটি ‘হাওরে পদ্ম’ নিয়ে এসে উপস্থিত হয়। পায়চারি করে।
: এই দেইখো মশা যেন প্রবেশ না করে। খেয়াল রাইখো মাসুদ।
স্বাস্থ্য সাহিত্যিক সোফায় বসে সলিলকি করে, ‘মশাকে মারতে গেলেই সে অনেক উপরে উড়ে যায়, দেখি কজন আমলাকে বিদেশে ট্রেনিং-এ পাঠিয়েছি। মশার ডানা কাটা শিখতে। ওরা ফিরে এলেই ডেঙ্গি থেকে মুক্তি।‘
প্রধান সিলেকশন কমিশনার এলে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আইন সাহিত্যিক। আর ছাড়তে চান না।
: ব্যালটে ও বুলেটে ঠেকিয়ে দিয়েছি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। আপনাকে যে কী করে ধন্যবাদ জানাই মহাত্মন।
ক্যাসিনো সম্রাট তার জরির নাগরা দুলিয়ে নাচতে নাচতে আসে, ‘জয় হুন্ডি রাজ্যের জয়!’
তার পেছনে পেছনে স্পেস স্যুট পরে শোভন তরুণেরা। মাথায় হেলমেট হাতে হেনরির হাতুড়ি।
: আমাদের আশীর্বাদ করুন, আমরা মহাকাশ দাপাতে যাচ্ছি আজি শুভ রাতে।
নীতিজ্ঞানাচার্য এসে লাফ দিয়ে পড়েন, ‘ছা-ছপ-ছমুছা নিয়ে যেও বাবারা; মহাকাশে এমন স্বাস্থ্যপ্রদ রেসিপি কোথায় পাবে!’
ভৌতিক এলাহি এসে মুখে একগাদা বিরক্তি নিয়ে বলেন, ‘আহা বোর করলে। গান হুন্ডি কোথায়; কোথায় বেলারুশের স্বর্ণকেশী নর্তকীরা!’
‘তাপস নিঃশ্বাসও বায়ে’ ফিউশন বাজতে শুরু করলে একদল বেলারুশি তরুণী তাদের অপরুপ ব্যালেতে জলসাঘর মাতায়।
দেশি লাল-পরী নীল পরী আবদার করে, ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’ নাম্বারে নৃত্য পরিবেশনের জন্য।
সংস্কৃতি বাচ্চু গালে সুপোরি পুরে বলে, ‘দেশজ সংস্কৃতি চর্চা বড্ড প্রয়োজন।‘
বিদ্যুৎ বাবু বপু দুলিয়ে বলে, ‘উহ বোর করলে, তোমরা বরং দিবসগুলোতে সরকারি অনুষ্ঠানে এসো; অথবা আমি ফোন করে দিচ্ছি, বাতাবি টিভিতে গিয়ে বেশ করে নাচো!’
উন্নয়নের দুর্জয় শিখরে সেকেন্ড হোম আর কিছু অফশোর অ্যাকাউন্টের ধারাপাত খুইয়ে মনমরা হয়ে বসে তরুণ হুন্ডিরা। গণতন্ত্রের সংরক্ষিত ভবনের নবনির্বাচিত সভ্য টগর এক পাত্র সুরা হাতে নিয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদে।
ও রুখ রুখ রুখসানা
মাঝে আটলান্টিক বহেরে
ওপারে তুমি রাধা এপারে আমি!
সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসে সম্রাট সেলিম, ‘দার পরিগ্রহ করো; গৃহে যদি গণতন্ত্র দিতে পারো; তবে দুজন সংবেদনশীল জায়া জুটবে; আরো পাবে নিপুণ কোন বৃদ্ধস্য আনারকলি ভার্যা। আর্য হও; নতুন টগর ফোটাও প্রেমের বাগানে!’
গম্ভীর মুখে ঋষি আলেমপনা বলে, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা ও উগান্ডায় অল্পদামে জমি পাওয়া যাচ্ছে; যারা কিনতে চান যোগাযোগ করুন।‘
মাথার পরচুলো ঠিক করতে করতে কিং ফয়সাল বলেন, ‘আমি কেনিয়াটা প্রেফার করি, নাইরোবি বড় সুন্দর শহর!’
সব কথাতেই ওকে বলা সেতু সাহিত্যিক বলেন, ‘কী শুধুই কী সেকেন্ড হোম হারানোর বিষাদ সিন্ধু; নাকি খাওয়া দাওয়া কিছু আছে!’
পানিসম্পদ সাহিত্যিক বলে, ‘আপনার হাতের রোলেক্স ঘড়িটা বড্ড মনোহর।‘
: এই তুমি নাকি লন্ডনে বাড়ি কিনেছিলে!
: মশা ঢাকা এই শহরে যে দামে গমমণ্ডিতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া যায়; ওর চেয়ে কম দামে পাওয়া যায় বিলেতে বাগানওয়ালা বাড়ি।
হারুনের ভাতের হোটেল থেকে এসেছে গোয়েন্দা হাজির বিরিয়েনি, সাদা ভাত, মৌরালা মাছের ঝোল, পাঙ্গাশ ভুনা, আদমের ব্রেনমাসালা, কান ও নাক ভাজা, কব্জির নেহারি, চোখের কোপ্তা, খাঁটি দুধের দই আরো কত কী!
সেন্টার ফর রুথলেস ইনটেলিজেন্সের ছোট চুল সুঠামদেহী শিক্ষা কবিকে ফিস ফিস করে বলে, ‘আমাদের সার্বিক সাফল্যের চাবিকাঠি "গুজবশাস্ত্র" গ্রন্থটি কী পাঠক্রমে অন্তর্ভূক্ত করা যায়।‘
পাশে বসা দেশি আইনস্টাইন চশমার মাঝে চোখ টুলটুল করে বলেন, ‘এটা সবার পড়া উচিত, এতে বিজ্ঞান আছে!’
শাহজাদি আসেন কালো বসনে, স্মিত হেসে চারপাশে তাকান। ফিস ফিস করে বলেন, ‘এদেশে অটিস্টিক বাচ্চাদের ছোট বেলায় আইডেন্টিফাই করা গেলে যত্ন নিয়ে চিকিৎসা করে এই ঘরের লোকগুলো আরও গুছিয়ে চিন্তা করতে পারতো। বাট এলাস! ইটস টু লেট।‘
শাহজাদা তাকে বলেন, ‘সবজায়গায় ডাক্তারি করতে যেও না। এরা যদি এরকম না হতো তাহলে হুন্ডিরাজ্য এত সাফল্য পেত না। এই যে বেলারুশের নাচ আর কম্বোডিয়ার বাদ্যে আনন্দিত এরা; তা কী কখনোই হতে পারতো, ঠিক সময়ে মনের চিকিৎসা পেলে!’
সবাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে টিপসিরা টলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে প্রাসাদের খাদ্য পরিবেশনকারী বালক ও বালিকারা তাদের ধরে কোনমতে দাঁড় করিয়ে রাখে।
ভাবুক পরিকল্পনা কথা সাহিত্যিক ব্যালকনিতে এসে প্রাসাদের সামনের মাঠে তাকিয়ে দেখেন ওখানে সহমত ও শিবব্রতদের খাওয়ানো হচ্ছে। মুফতে খুশিজল পেয়ে কেউ কেউ বাগানের সবুজ ঘাসের ওপরে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুনছে আর হিসাব করছে কে কোথায় প্লট পেলো কে কোন পদবী কে কোন পদক পেতে পারে গণতন্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য। বাগানের এক জায়গায় আংকেল স্যামের একটা কাকতাড়ুয়া মূর্তি বানিয়ে বিশিষ্ট নাগরিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সম্পাদকেরা তাতে পাথর ছুঁড়ছে। মূর্তির পাশে লেখা ঘৃণাস্তম্ভ।
পরিকল্পনা কথা সাহিত্যিক একলা একলাই কথা বলেন, ‘এই ওপর তলায় বসে বাগানের লোকগুলোর জন্য মাথাপিছু একশো টাকা বরাদ্দ দিলে তাদের হাতে পৌঁছাবে মাত্র দশ টাকা। নব্বুই টাকা ভেসে বেড়াবে বঙ্গোপসাগর, ভারত সাগর, আরব সাগর, পারস্য সাগর হয়ে আফ্রিকার কঙ্গো নদীতে। হুন্ডিরাজ্যের মিডল ম্যানগুলো কপাল করে জন্মেছিলো।‘
হঠাত একটা ম্যাজিক কার্পেট উড়ে আসতে দেখা যায়। জলসাঘর থেকে নর্তকীদের খেদিয়ে দেয়া হয়। খুশিজলগুলোর পাত্র ও ভাণ্ড নিয়ে যে যেদিকে পারে দৌড়ে পালায়। হারুনের ভাতের হোটেল দ্রুত চা পরিবেশন করে, সঙ্গে পান ও মুখওয়াশ; যাতে কোন গন্ধ না থাকে হারাম পানীয়ের।
হালাল রুহ আফজা পরিবেশিত হয়। আতরের গন্ধে চারপাশ কাতর হয়ে পড়ে। ম্যাজিক কার্পেট উড়ে এসে জলসাঘরের মাঝ খানে ল্যান্ড করলে; স্থানটি পবিত্র হয়ে ওঠে; হয়ে ওঠে উপাসনালয় যেন। চেয়ার সরিয়ে সারাঘরে পাতা হয়েছে নক্সীচাদর ও খেজুরের পাটি।
আনন্দ অশ্রুতে সবাই ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে। বালতিতে করে অশ্রুজল বাইরে নিয়ে যায় অশ্রুবহনকারীরা। ভক্তিতে মুক্তি লাভের আশায় সবার চক্ষু নিমীলিত। উনি হাসলে সবাই হাসে, উনি গম্ভীর হলে সবাই গম্ভীর হয়।
এসময় দরবেশ ও বসুন্ধরার আসমানি কিতাব বহনকারী পুত্র পিন পিন করে গাইতে থাকে, এ কোন মধুর শরাব দিলে আল আরাবি সাকি, নেশায় হলাম দিওয়ানা যে, রঙ্গিন হলো আঁখি।
পরিবেশটা হালকা করতে উনি বলেন, ‘আজ হৃদয়রঞ্জিত বাবুকে বড্ড মনে পড়ছে। উনি বলেছিলেন, বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে।‘
উনি স্নিগ্ধ হাসিতে সরল দুষ্টুমি নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তার পরের লাইন কী!’
সবাই সমস্বরে বলে, ‘উনি ধরলে ছাড়ে না।‘
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন