এ ভিখারি-দশা তবে কেন তোর আজি

২৩৫ পঠিত ... ১৭:৪৩, মে ১৩, ২০২৫

14

বাংলাদেশে এক শ্রেণির তরুণ-তরুণীর ভারতপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী মনোভাব দেখলে একঘেয়ে লাগে। অবশ্য এজন্য আমি তাদের দোষ দেই না। স্বদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে এমন পরমুখাপেক্ষিতা তৈরি হবেই।

বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা যদি ইতিহাসের গভীরে ডুব দিয়ে পাল-সেন-সুলতানি, মুঘল ও নবাবী আমলের বহুমত-পথের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নানাধর্মের সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশল, ধর্ম ও মিস্টিসিজম চর্চার দার্শনিক আবহ, মায়া ও আতিথেয়তার উষ্ণতা, সম্পন্ন কৃষক, কারিগর, কারুশিল্পীর শ্রমের আনন্দমুখর জীবন চর্যা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়; তাহলে সে বুঝতে পারবে নিজেকে না জেনে কোনো আশার ছলনে ভুলে কীসব মিথ্যার ইমারতের দিকে তাকিয়ে তাকে অভিজাত ভাবতে শিখেছে।

এই বাংলাদেশের শচীন দেব বর্মণ ভারতে গিয়ে সেখানকার সংগীতকে সমৃদ্ধি দিয়েছেন। জগত সেরা চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়ের পূর্ব পুরুষ পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতা না গেলে ভারতের মাথায় এই সাফল্যের মুকুট কে এনে দিত! নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তো ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। আর চলচ্চিত্রের প্রবাদ প্রতিম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন আমাদের পাবনার মেয়ে। ভারতের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতকে পূর্ববঙ্গের শিল্প শৈলী ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐশ্বর্য্য কিভাবে সমৃদ্ধি দিয়েছে; তার দু’একটি দৃষ্টান্ত হাজির করলাম মাত্র।

পাকিস্তানের যে ডন পত্রিকা এশিয়ার সেরা পেশাদার মিডিয়া হিসেবে সুকৃতির দাবিদার; এর পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দুজন ছাত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদক হিসেবে উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের অভিভাবকত্বে তৈরি হয়েছে তাদের বিখ্যাত আর্ট স্কুল। রবীন ঘোষ ও আলমগীর পাকিস্তানের সংগীতের আঙ্গিক বদলে এর সুফি ও ফোক ধারার সঙ্গে অক্সিডেন্টাল টিউন যুক্ত করার ফলাফল; কোক স্টুডিওতে তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। খ্যাতিমান অভিনেত্রী শবনম আর কৃতি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে।

বৃটিশ আমলে কলকাতার যে বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদার আর পাকিস্তান আমলে লাহোরের যে বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদার; আমাদের ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলমান’ স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠা প্রকাশ করেছে; এ আসলে তাদের হীনমন্যতাজনিত খোয়ারি। এরা লক্ষ্য করেছে তাদের শুধু টাকা আছে; কিন্তু পূর্ব বঙ্গের প্রতিটি মানুষের কণ্ঠে আছে সুর, ভাবনায় আছে গীতিকবিতা। আজও লক্ষ্য করবেন স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোর কোলাবরেটরেরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের শিল্প-সত্বা ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিকে ঈর্ষা করে।

কাজেই ভারত-পাকিস্তানের ফাঁপা অহমকে আমাদের এত গুরুত্ব দেবার কিছু নেই। আমরা বাংলাদেশের মানুষ নিজের সম্পর্কে কম বলতে পছন্দ করি। আমরা যে আদি জমিদার, আমাদের পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান, জীবন জুড়ে উতসব আর অন্তর জুড়ে দার্শনিকতা; এসব গল্প আমরা দিয়ে বেড়াই না। তবে ভারত ও পাকিস্তানের একটু পুরোনো শিক্ষিত ও অভিজাত মানুষেরা আমাদের বাংলাদেশের আভিজাত্য সম্পর্কে জানে। মুশকিল হয়েছিল বৃটিশ কোলাবরেটর নতুন জমিদারদের নিয়ে। তারা নিজেদের ইনফেরিওরিটি ঢাকতে সুপিরিওরিটি দেখিয়েছিল। তাদের ছেলে-মেয়েদের মাঝে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ব্রিগেডিয়ার আযমীর মতো মাতা-পিতান্ধ যারা রয়েছে; তারা এখনও পূর্ব পুরুষের ‘অপরাধ অস্বীকার’ করে। আর যারা শিক্ষিত হয়ে এভলভ করেছেন, আত্মসমালোচনা করতে শিখেছেন, তারা ভুল স্বীকার করেন ও অনুতাপ প্রকাশ করেন।

আপনি যদি আজকের বাংলাদেশ ও ভারত-পাকিস্তানের তুলনা করেন, দেখবেন দারিদ্র্য সীমার নীচে ঐ দুটি দেশের চেয়ে কম মানুষ বাংলাদেশে রয়েছেন। মাথাপিছু আয়, স্যানিটেশন সিস্টেম, মা ও শিশু স্বাস্থ্য এরকম মৌলিক জায়গাগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান শ্রেয়তর। এই মুহূর্তে তিনটি দেশকে যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন, ড ইউনূস, নরেন্দ্র মোদি, শাহবাজ শরিফ; এই তিনজনকে দেখলে ও তাদের কথা শুনলে তিনটি দেশের সাংস্কৃতিক মানের একটি তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়।

এবার আসা যাক আর্য কল্পনাতে। ভারত ও পাকিস্তানের এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে আর্য কল্পনা রয়েছে। ফ্রিডেরিশে নিটশের ভ্রান্তিজনিত এই সুপিরিওরিটির যে ধারণা; ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের সঙ্গে আড্ডায় একজন বাংলাদেশি হিসেবে জানতে চেয়েছি, কোথায় তোমাদের সে আর্য একটু দেখিয়ে দেবে ভাই! আমি তো কলকাতা ও লাহোরের জমিদারদের মতে অনার্য মানুষ; তাই কলকাতা ও লাহোরের আর্য দেখে এ জীবন পূর্ণ করতে চাই! আমার এই স্ট্যান্ডিং জোকসটিই হচ্ছে ভারত-পাকিস্তানের গ্রাম্য পঞ্চায়েতি ‘সেন্স অফ সুপিরিয়রিটি’ নিয়ে অত্যন্ত শিষ্ট ডার্ক হিউমার।

একমাত্র ইউরোপে গিয়ে মনে হয়েছে; পূর্ব পুরুষের ঔপনিবেশিক অপরাধ স্বীকার করে; এভলভ করেছে সেখানকার সমাজ। যেখানে ইউরোপের একটি মেয়েকেও কখনো কারো গায়ের রঙ, চেহারা, ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি করতে দেখিনি। দাড়ি-টুপি বা গেরুয়া দেখে মুখ টিপে হাসতে দেখিনি। বাংলাদেশে এই রেসিজমের রোগ এসেছে কলকাতা ও লাহোর থেকে বলাই বাহুল্য। ইউরোপের ছেলেরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, যারা ধর্ম-গায়ের রং-জাত-পাত নিয়ে এখনও খোয়ারি করে; তারা ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষময় ফল লাভের পর; দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর ইউরোপ তাই উগ্র জাতীয়তাবাদের চর্চা নিষিদ্ধ করে কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার দিকে মন দিয়েছিল। দুর্নীতি নেই বলে তা ঢাকতে সমাজে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের অতিরঞ্জিত নাটক নেই।

মাথায় পতাকা বেঁধে ঘোরা, যত্রতত্র জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করা, নারাএ তাকবির স্লোগান দিয়ে আসেন ভাই পাশের মসজিদে একটু আখেরাতের ঘর বানাইতে মিলিত হই বলে দীনের দাওয়াত দেওয়া, চলো ভাই পাশের মন্দিরে ভগবানকে পুজো দিয়ে ধন্য হই বলে জয় শ্রীরাম স্লোগানের দাওয়াত; হিটলারের জার্মানিতে সামাজিক গণতন্ত্রীর জায়গা নাই টাইপের নিষিদ্ধ স্লোগান, সারাদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কালচারাল ওয়ার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম ইসলামি চেতনার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিরাট বিরাট ডায়ালগ চাঁড়া; ফ্রান্সের লিবেরেল মেয়ে ঘাড় কাত করে পিয়ানো বাজাতে বাজাতে খ্রিস্টিয় গণতন্ত্রীদের ছাগু বলে ডাকা, ভ্যাটিক্যানের ধর্মের ঠিকাদার হয়ে রোমের রাস্তায় মিনি স্কার্ট পরা মেয়েকে বেত্রাঘাত; এইসব কলতলা কালচার ইউরোপে নেই। কারণ তাদের কাউকে এসে শ্রেষ্ঠত্বের কোন প্রমাণ দিতে হয় না। তারা নিজেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ইউরোপীয় বলে বুক চাপড়ায় না; রেনেসাঁর প্রশ্নে কোনো আপোস নাই বলে রেনেসাঁর স্বপ্রণোদিত ঠিকাদার হতে হয় না কাউকে। অপরকে পাকি-রেন্ডি গালি দিয়ে বিরাট বাঙ্গি ফলানোর বিকৃতি ইউরোপে নেই। এসবই বিবর্তনে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষণ।

অপশন হাতে এই দুটো; হয় ইউরোপের মতো কল্যাণরাষ্ট্র গড়ায় মনোযোগী হওয়া; বৈষম্যমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্যে কাজ করা। অথবা ভারত-পাকিস্তানের মতো ফাঁপা জাতীয়তাবাদ-ধর্ম কান্না দিয়ে বৈষম্যধূসর কলতলা রচনা। চয়েস আমাদের হাতে।

 

২৩৫ পঠিত ... ১৭:৪৩, মে ১৩, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top