ঢাকায় যে সংখ্যক মানুষ আগে বলতেন যে তাদের পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন; তাতে বাংলাদেশের আয়তন চীনের সমান হবার কথা। পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে যে সংখ্যক লোক বলেন যে, তারা জমিদারী ফেলে এসেছেন, তাতে পূর্ববঙ্গের আয়তন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের সমান হবার কথা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেক লেখকই জমিদারি কালচার নিয়ে যে হাসাহাসিটা করেছেন; ইংরেজি সাহিত্যে টমাস হার্ডি নব্য জমিদার বা ফিলিস্টাইন্স নিয়ে যে হাসাহাসিটা করেছেন; তাতে আমার মনে হয়েছে জমিদারি কালচার নিয়ে যদি হাসাহাসি করা যায়, সহমত-রহমত-শিবব্রত-শরিয়ত ভাই কালচার নিয়ে যদি হাসাহাসি করা যায়; তাহলে হাইল্লা কালচার নিয়ে হাসাহাসি করা যাবে না কেন! পৃথিবীর কোন কালচারটা হাসাহাসির পরিসীমার বাইরে।
দুই বাংলার ইতিহাসে জমিদারের ছেলেরা বাম রাজনীতিতে চলে যাওয়া; নকশালবাড়ি আন্দোলন করে জীবন পুড়িয়ে ফেলার ইতিহাসও রয়েছে। বাংলাদেশেই জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য করেছেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ অমর গীতিকবিতা লিখেছেন, আসাদ চৌধুরী ‘তোমাদের যা বলার ছিলো বলছে কি তা বাংলাদেশ’ প্রশ্ন রেখেছেন।
বাংলাদেশে অধিকাংশ ইতিহাসবিদই যখন উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা রচনা করেছেন, কেউ কেউ নিজের বাবা-চাচা-ভাইয়ের বীরত্ব তুলে ধরতে শয়ে শয়ে ইতিহাস গ্রন্থ লিখিয়েছেন; আর আফসান চৌধুরী সারাজীবন ধরে গবেষণা করে মুক্তিযুদ্ধে কৃষকের বীরগাথা রচনা করেছেন। গ্রামের মুক্তিযুদ্ধ তার রচিত উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ। নারীর মুক্তিযুদ্ধ, হিন্দুদের মুক্তিযুদ্ধ আরো দুটি প্রণিধানযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ তার।
আমরা তো আধপেটা খেয়ে বিসিএস গাইড মুখস্থ করে বড় কর্মকর্তা হবার স্ট্রাগলের গল্পগুলো শুনে নয়ন জলে ভাসি। কিন্তু আফসান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই কথিত জমিদারির এফলুয়েন্স প্রত্যাখ্যান করে সাম্যের সমাজ রচনার লড়াইয়ে ব্রতী হন। তার সতীর্থদের অনেকেই আমার সিনিয়র ফ্রেন্ড। আফসান চৌধুরীর সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জিদের কারণে তার বন্ধুরা মজা করে তাঁকে কার্ল মার্কস বলে ডাকতো।
বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংকলনের কাজে তিনি যে ঋজুতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে সে সময়ের জিয়া সরকারও কোন হস্তক্ষেপের সাহস করেনি। আফসান চৌধুরীর মেরুদণ্ড আছে। আর সেসময় প্রশাসনের মানও এমন ভিলেজ পলিটিক্সের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়নি বলে মনে হয়। এই ভিলেজ পলিটিক্স কালচার দানা বেধেছে একবিংশ শতকে। মার্শাল ম্যাকলুহান গ্লোবাল ভিলেজের ডাক দিতেই; আমরা গোপাল ভিলেজ বানিয়ে ফেলেছি।
গোপাল ভিলেজে প্রবীনদের গালাগালির চল হয়েছে শুক্রবার বিকেলে গালে সুপারি পুরে বেগম খালেদার অন্দর মহলের কাল্পনিক গল্প বলে প্লট সাংবাদিক ও প্লট সচিব নিয়ে আনন্দে খলবল করে ওঠার ঠোঁঠাবাজার কালচার-চর্চার মাঝ দিয়ে।
গোপাল ভিলেজে আপনি অনায়াসে মুখে যা আসে তাই বলতে পারবেন যাকে-তাকে। কেউ এর প্রতিক্রিয়া জানালে তখন ফেসবুক এজেন্সি তৈরি হবে প্রতিক্রিয়ার শব ব্যবচ্ছেদে। আলফডাঙ্গা বা চিতলমারীর পোলা একজন সিনিয়র সিটিজেনকে মুখে যা এলো তা বলে চলে গেলো তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই ফেসবুক এনজিও ও এজেন্সিগুলোর। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় সিনিয়র সিটিজেন "হাইল্লা কালচার" আর ‘আরবান কালচার’ আলাদা বললেই ‘হাইল্লা’ অনুভূতি ফুঁসে উঠবে।
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুভূতি উত্থিত করে সারি সারি সেকেন্ড হোম গড়ে উঠতে দেখেছি; ধর্মীয় অনুভূতিতে চাগান দিয়ে ধর্ম-ব্যবসা করে হেলিকপ্টারে চড়া ওয়াজ-মেহেফিল জমিদার হয়ে উঠতে দেখছি; হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে ভীষণ লাকি সব বিদূষক জমিদার হয়ে উঠতে দেখেছি সংস্কৃতির জমিনে; তাই আমি খুব নিশ্চিত করে জানি "হাইল্লা" অনুভূতিতে টান দিয়ে কী করে নতুন বুদ্ধিজীবী জমিদার, সংস্কৃতি জমিদার ন্যুনতম এনজিও জমিদার হয়ে উঠবে এরা।
পশ্চিমবঙ্গের জমিদার পরিবার থেকে নকশাল আন্দোলনে গিয়ে প্রায় দুই দশক জেল খেটে আসা আজিজুল হক বলছিলেন, ‘যে কৃষক তোমাকে ভাত খাওয়ায়, যে তন্তুবায়ী তোমার বস্ত্রবয়ন করে, যে শ্রমিক তোমার গৃহ নির্মাণ করে তাকে কক্ষণো ভুলে যেও না।‘ আফসান চৌধুরী তাদের কখনোই ভুলে যাননি বলেই মুক্তিযুদ্ধে তাদের ইতিহাস রচনা করেছেন। এই ইতিহাস রচনার অংগীকারের কারণে বিবিসির চাকরি ছেড়েছেন, উন্নয়ন সংস্থার চাকরি ছেড়েছেন, ক্যানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টির কাজ ছেড়ে দেশে চলে এসেছেন। ঢাকায় একটা ছোট্ট বাসায় থাকেন, নিজের রান্না নিজে করে খান। আগেকার দিনের পণ্ডিতেরা যেমন অভিধান রচনার অধ্যবসায়ে নিজেকে বিলীন করে দিতেন, আফসান চৌধুরী ঠিক তাই করছেন।
এই নিরলস ইতিহাস গবেষণার পাশাপাশি তিনি অবসরে ক্রিকেট খেলা দেখেন, ফেসবুকে কিছু তরুণ-তরুণীর সঙ্গে আড্ডা দেন। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি বলে তাঁর ছাত্রছাত্রীরাও আড্ডা দিতে আসেন। বাংলাদেশে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকে বেড়ে ওঠা মানুষদের সেন্স অফ হিউমার, স্যাটায়ার সার্কাজমের গুনটি অনন্য। পরে যখন নকল করে পাশ করার যুগ এলো, তখন তৈরি হলো অসংখ্য রামগোরুড়ের ছানা।
আফসান চৌধুরী মশার কয়েলের আগুনে মশারির প্রান্ত পুড়ে যাওয়া, রুটি বানাতে গিয়ে রুটি পুড়ে যাওয়া, নিরন্তর টাকা পয়সার টানাটানি, শারীরিক অসুস্থতার গল্পগুলো অক্লেশে বলেন। এতে তার কোন দুঃখ নেই, আছে কৌতুক। সেই গল্পের আসরে এই সিনিয়র সিটিজেনের আলোচনায় তার শৈশবের গল্প আসে। কলকাতায় তার খালা-খালাত বোন, করাচীতে তার মামা, ঢাকায় তার বাবা-মা'র জীবনের ইতিউতি উঠে আসে। সেই শৈশবে যদি খালা সুইমিং কস্টিউম পরেন, কাজিন প্রথম মুসলিম নারী মডেল হন, মামা যদি ডন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন; শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসর একটি অতীত যদি থাকে; উনি তো লোকরঞ্জনের জন্য বলতে পারেন না যে; আমার আব্বা অনেক স্টাগল করে বড় চাকরি পেয়েছিলেন বা খালা রিক্সার চারপাশে শাড়ি দিয়ে ঘিরে তারপর রিক্সায় এসে চড়তেন। যে লোক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন প্রায় পাঁচটি দশক; তার নিজের পবিবারের স্মৃতিচারণও তো বস্তুনিষ্ঠই হবে।
সাত দশক আগে খালা সুইমিং কস্টিউম পরেছেন শুনেই, ছি ছি জাত গেলো, ইসলাম গেলো, বাঙ্গালী সংস্কৃতি গেলো, একী বেলেল্লাপনা এই যে ফট করে মন্তব্যে এসে মুখে যা আইলো কইলাম; এইটা গোপাল ভিলেজের একটি নেতিবাচক দিক। মানে নিজের চরকায় তেল না দেয়ায় ঘ্যার ঘ্যার করছে; সারাক্ষণ অন্যের চরকা নিয়ে মুখফোঁড় হওয়া। নিজের অভিজ্ঞতার দুই ইঞ্চি গজফিতায় আরেকজনের অভিজ্ঞতা মাপা।
গ্রামের সৌন্দর্য্য নিয়ে, মানুষের মনের সরলতা নিয়ে, ইতিবাচক দিক নিয়ে লক্ষাধিক কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে। সেইখানে গ্রামের সংস্কৃতির কোন নেতিবাচক আচরণ সম্পর্কে বললেই অনুভূতিতে আঘাত লেগে নব্য জমিদার ও জমিদার হয়ে চাওয়া মহল, অথবা নেহাত বিবেকের জমিদার এসে হাউ মাউ খাউ রেসিজমের গন্ধ পাউ বলে উঠবেন; সভ্যতার সংলাপের ধারাতে এই মামা বাড়ির আবদার চলে নাকি! পৃথিবীর কোন কালচার ও ইজমকে হোলিকাউ করে রাখার কোন সুযোগ নাই।
আমি লেখক জীবনের শুরুতেই বিচূর্ণীভাবনার গ্রন্থ বিষণ্ণতার শহর ও উপন্যাস মৃত্যুর শহরে ফাঁপা নগর সংস্কৃতির যে ব্যবচ্ছেদ করেছি, প্রখর সমালোচনা করেছি; তাতে গোপাল ভিলেজ কালচার নিয়ে রম্য করার কিছু অধিকার তো আমি অর্জন করেছিই।
একবার এক লেখক এক বাসায় ঘুরতে গিয়ে শোনেন, পাশের বাসার বৃদ্ধা মহিলা সারাক্ষণ তার ছেলের বউকে গালাগাল করছেন। লেখক ভাবেন, কী পিশাচ শাশুড়িটি! লেখক ঐ ছেলের বৌ-এর জীবনের ট্র্যাজেডি সহ্য করতে না পেরে প্রাচীরের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেন, ছেলের বৌটি কিছুক্ষণ পর পর ঝাড়ু দেখায় শাশুড়িকে যিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছেন। মি চৌধুরীর একটি ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট ফেরি করে সমাজ বিপ্লবের ডাক দেয়া দেখে মনে হলো আপনি শাশুড়ির চিৎকার শুনছেন। কিন্তু আমি ছেলের বউয়ের ঝাডু দেখেছিলাম। এই পোস্ট ক্রিয়া নয়। নোংরা আক্রমণের প্রতিক্রিয়ামাত্র।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন