মুজিবকোট নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা: হ্যাল্লো শ্যাক্‌ মুজিবুর রক্‌মান...

৭৮৪ পঠিত ... ১৪:০৯, মার্চ ১৮, ২০২১

mujibcoat

সময়কাল ১৯৭৪ সাল।

সে বছর ১০ জুলাই আমি বার্লিন গেলাম।

পূর্ব জার্মানির রাজধানী তখন বার্লিন। জার্মানি তখন দুই ভাগে বিভক্ত—পূর্ব আর পশ্চিম। পশ্চিম জার্মানি ধনতান্ত্রিক দেশ আর পূর্ব জার্মানি সমাজতান্ত্রিক। বার্লিনে অনুষ্ঠেয় ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন্স ফেসটিভ্যালে যোগ দিতে বাংলাদেশের শিশু প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য হিশেবে আমার সেই বার্লিন যাত্রা। সেই প্রতিনিধিদলে কচি-কাঁচার মেলার সদস্য হিশেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম আমিসহ তিনজন--ঢাকার মেয়ে ইশরাত নিগাহ্‌ বোখারী শাকিলা এবং কুমিল্লার মেয়ে শুক্লা রায় আর আমি। খেলাঘর থেকে নির্বাচিত হয়েছিলো তিনজন—ঢাকার মেয়ে তাহমিনা সুলতানা (ছাত্রনেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ছোটবোন) এবং মিতা হক(সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের ভ্রাতৃজ)। আমাদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন খেলাঘরের পান্না কায়সার(শহিদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী। অভিনেত্রী শমী কায়সারের মা।) ছয় সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধিদলে আমিই একমাত্র ছেলে। বাকি সবাই মেয়ে! সেই মেয়েদের একজন এখন খুবই বিখ্যাত, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক।

কুড়ি-পঁচিশটা দেশ থেকে ছেলেমেয়েরা এসেছিলো সেই ফেস্টিভ্যালে। বার্লিনে আমরা কুড়িদিন ছিলাম। এক বিকেলে একটা স্টেডিয়ামে আমাদের পারফরম্যান্স ছিলো। বিশাল স্টেডিয়ামভর্তি অগুন্তি (হাজার পঞ্চাশেক)মানুষের উপস্থিতিতে আমার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা একটা ছড়াগান গেয়েছিলো—রেল চলে ঝিকঝিক/ঝিকঝিক ঝিকঝিক/চলছে তো চলছে চলছে/হুঁইশেল বাজিয়ে যাত্রীকে ডাকছে/ঘুম থেকে উঠতে সে বলছে/....।

খুব ভালো হুঁইশেল দিতে পারতাম আমি। রেলের হুঁইশেল। গানটির মাঝখানে বারকয় আমি সেই হুঁইশেলটা দিতাম প্রাণপণে। এই গানটা বার্লিন ক্যাম্পে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়েরা আমাদের দেখলেই ‘ঝিক্‌ঝিক্‌ ঝিক্‌ঝিক্‌’ বলে উল্লাস প্রকাশ করতো। গানটির সুর আর রিদম সম্ভবত মুগ্ধ করেছিলো ওদের। স্টেডিয়ামেও আমাদের সঙ্গে ‘ঝিক্‌ঝিক্‌ ঝিক্‌ঝিক্‌’ করছিলো ছেলেমেয়েরা। আমার হুঁইশেলটাও বিপুল করতালি কুড়িয়েছিলো সেদিন।

mujib berlin

বার্লিনের অনুষ্ঠানমালায় একটা দিন ছিলো একেবারেই অন্যরকম। আগে থেকেই ঘোষণা দেয়া সেই দিনটা ছিলো সবক’টা দেশের ছেলেমেয়েদের জাতীয় পোশাক পরার দিন। পান্না ভাবীসহ দলের মেয়েরা সবাই পরলো সুন্দর সুন্দর শাড়ি। কী যে সুন্দর লাগছিলো মেয়েগুলোকে!

ফিরোজা রঙের ঝলমলে একটা শাড়ি পরেছিলেন পান্না কায়সার। অসম্ভব রূপসী ছিলেন তিনি। তাঁকে পরির মতো লাগছিলো। সেদিন বিকেলের সেই অনুষ্ঠানে মিডিয়ার দৃষ্টি কেড়েছিলো আমাদের মেয়েরা,সবক’টা দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রবল ঈর্ষা জাগিয়ে। সেদিন, সব ক্যামেরাম্যান মানে ফটোসাংবাদিকরা ঝাঁক বেঁধে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে অবিরাম শাটার টিপে যাচ্ছিলেন বাংলাদেশের শাড়িপরা মেয়েদের তাক করে।

বাংলাদেশের মেয়েদের না হয় জাতীয় পোশাক শাড়ি। কিন্তু ছেলেদের?
আমি কি লুঙ্গিটুঙ্গি পরে নেমে পড়বো মাঠে?
না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি হাজির হলাম সেখানে, শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিবকোট পরে। মুহূর্তেই বেঁধে গেলো হুলুস্থুল কাণ্ড! ফটোসাংবাদিকরা এবার একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার ওপর। অবিরাম শাটার টিপছেন তাঁরা। ফ্লাশগানের আলোয় ভেসে যাচ্ছি আমি!

শেষ বিকেলের যাই যাই রোদের আলো-আঁধারীর অপরূপ বিভায় সে এক স্বর্ণালি সময়ের বর্ণালি মুহূর্ত! বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের নেতারা ছুটে এসে আমার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করতে করতে মহাবিস্ময়ে উচ্চারণ করলেন—''শ্যাক্‌ মুজিবুর রক্‌মান, ব্যাঙ্গালাডেস...!''

ফটোসাংবাদিকরাও আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন—হ্যাল্লো শ্যাক্‌ মুজিবুর রক্‌মান!

আমার খুশি দেখে কে! খুশিতে প্রায় লাফাচ্ছি আমি।

সদ্যস্বাধীন একটি দেশের মহান স্থপতিকে, আমাদের বঙ্গবন্ধুকে, আমাদের শেখ মুজিবুর রহমানকে পৃথিবীর সবাই চেনে! তাঁর নাম, তাঁর ফটোগ্রাফ এমনকি তাঁর পোশাকটি পর্যন্ত পরিচিত বিশ্ববাসীর কাছে! ওরকম শাদা পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে হাফ স্লিভ কালো কোট পৃথিবীতে একজন নেতাই পরেন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর পোশাকটাই ট্রেডমার্ক পৃথিবীর মানুষের কাছে। আর তাই তো বঙ্গবন্ধুর পোশাকে আমাকে দেখেই চারপাশের লোকজন উল্লাসে ফেটে পড়েছে—হ্যাল্লো শ্যাক্‌ মুজিবুর রক্‌মান!

সেদিন রাতে বার্লিনের টিভি নিউজে আমাদের দেখিয়েছিলো। টিভি পর্দায় নিজের রঙিন ছবি দেখার অভিজ্ঞতা আমার সেই প্রথম। এর আগে কালার টিভি দেখিনি আমি।
পরদিন বার্লিনের বেশ কয়েকটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো 'শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিবকোট পরিহিত খুদে এক বঙ্গবন্ধুর ছবি'! ছবির ক্যাপশনে এমনটাই বলা হয়েছিলো। আমাদের ইন্টারপ্রেটার জার্মান তরুণী ডাচ ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকার ক্যাপশন অনুবাদ করে শুনিয়েছিলো আমাকে।

বঙ্গবন্ধুর পোশাকটি, শাদা পাজামা পাঞ্জাবির সঙ্গে তাঁর কালো মুজিবকোটটি পৃথিবী বিখ্যাত ছিলো সেই চুয়াত্তর সালেই! আওয়ামী লীগের নেতা-এম্পি-মন্ত্রীরাও পরেন বিশেষ এই পোশাক--শাদা পাজামা পাঞ্জাবির সঙ্গে কালো মুজিবকোট। কিন্তু ইদানিং বঙ্গবন্ধুর সেই বিশেষ পোশাকে সজ্জিত হয়ে শপথ নেয়া কিছু নেতা-এম্পি এবং মন্ত্রীকে দেখছি--বঙ্গবন্ধুর মুজিব কোটের রঙ তারা পালটে ফেলেছেন! কালো মুজিবকোটের বদলে তারা নানান বাহারী রঙের মুজিব কোট পরছেন নানা আনুষ্ঠানিকতায়। কালো আর তাদের ভালো লাগছে না। (কেউ আমাকে বোঝাতে আসবেন না প্লিজ, যে ওগুলো মুজিবকোট নয়, কটি!)

আওয়ামী লীগের কতিপয় টিকিটধারী পালটে ফেলছেন মুজিবকোটের রঙ! হায় রে ফ্যাশন!!

৭৮৪ পঠিত ... ১৪:০৯, মার্চ ১৮, ২০২১

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top