গ্যারি সোবার্স ফ্রম জিঞ্জিরা : জিঞ্জিরার যে সোবার্সকে বিশ্বক্রিকেট কখনো চেনেনি

৯৬৭ পঠিত ... ২৩:৫৫, এপ্রিল ১৫, ২০২০

জিঞ্জিরার সোবার্সের কথা আমাকে প্রথম বলেছিলেন শুভ্রদা; উৎপল শুভ্র-আমাদের স্পোর্টস এডিটর।

সোবার্সের ভালো নাম মোহাম্মদ মামুন। বাম হাতে ব্যাট করতেন, বাহাতি স্পিনার ছিলেন এবং পেস বল করতেন। ফিল্ডিংয়েও নাকি দুর্দান্ত ছিলেন। আবাহনীর হয়ে দুই মৌসুম ঢাকা লিগও খেলেছেন। সে সময় শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের সাথে পাল্লা দিয়ে রান করতেন। কিন্তু জাতীয় দলে খেলা হয়নি কখনো। হাটুর ইনজুরিতে শেষ হয়ে গিয়েছিলো ক্যারিয়ার।

অফিসে বসে বসে একদিন সোবার্সের ফুটেজ দেখছিলাম। পাকিস্তানের বিপক্ষে ট্রিপল সেঞ্চুরির ইনিংসটা।
আনমনেই বলে উঠেছিলেন,
‘সোবার্সই সর্বকালের সেরা।’
শুভ্রদা এ ব্যাপারে কখনোই আমার সাথে দ্বিমত হন না। অলরাউন্ডার হিসেবে বাকিরা যে সোবার্সের চেয়ে অনেক পেছনে, এটা তিনিই অনেকবার বলেছেন। সেদিন আমার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বললেন,
‘আমাদেরও একজন সোবার্স ছিলেন।’
একটু অবাক হয়ে বললাম,
‘কে? মোহাম্মদ রফিক?’
‘রফিকের ব্যাটিংটা তো সেরকম ছিলো না। আর শুরুতে পেস বোলিং করলেও পরে শুধু স্পিন করেছে। ফলে রফিক লিজেন্ড হলেও ঠিক সোবার্স বলা যায় না।’
‘তাহলে আবার সোবার্স কে ছিলো। সাকিব তো অনেক বেশি আনঅর্থোডক্স।’
‘না, সাকিবও না। সোবার্স বলতাম আমরা মোহাম্মদ মামুনকে।’
‘কে উনি?’
সেই শুনলাম আমাদের সোবার্সের গল্প।
সেই রকম কলার উচু করে নাকি মাঠে ঢুকতেন। একইরকম ব্যাটিং স্টাইল ছিলো। যখন মাঠে যেমন দরকার, তেমন বোলিং করতেন। সেই থেকে বেশ কয়েক বার শিহাব ভাইয়ের মুখে সোবার্সের কথা শুনলাম। উনিই একদিন বললেন,
‘একবার জিঞ্জিরা থেকে ঘুরে এসে ওনার ওপর স্টোরি করতে পারিস।’
ব্যাপারটা মজাই লাগলো। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সোবার্সের ঠিকুজি পাবো কোথায়?
শুভ্রদাই বললেন, জালাল ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে। জালাল ভাই মানে, জালাল আহমেদ চৌধুরী। ক্রিকেট কোচ, সাংবাদিক। আমাদের ক্রিকেট জগতের একজন কিংবদন্তী। ওনার কাছে সব সাবেক ক্রিকেটারের খোজ মেলে।
জালাল ভাইকে স্টেডিয়ামেই পেয়ে গেলাম। এখন শরীরটা একটু দুর্বল। তারপরও খেলা হলে মাঠে না এসে পারেন না।
আমাদের মিরপুরের প্রেসবক্সের বাইরে সিগারেট টানার একটা জায়গা আছে। ব্যালকনির মতো একটা চিপা জায়গা। ওখানে গায়ে গা ঠেকিয়ে গল্প করতে করতে আমরা সিগারেট টানি। সিগারেট ছাড়াও কেউ কেউ অনেকটা সময় ধরে গল্প করেন।
সেখানে বসেই আজকালকের খেলাধুলার কথা নিয়ে আড্ডা হচ্ছিলো। এক পর্যায়ে অলরাউন্ডারদের কথা এলো। ইউসুফ বাবু থেকে শুরু করে সাকিব; অনেকের কথা এলো। তখনই আমার সোবার্সের কথা মনে এলো। জালাল ভাইকে ধরলাম,
‘জালাল ভাই, আপনাদের সময়ে কী আবাহনীতে এক সোবার্স খেলতেন?’
‘কে? মোহাম্মদ মামুন?’
‘হ্যা।’
‘ওরে বাবা! মোহনীয় একটা সৌন্দর্য ছিলো তার ব্যাটে। সত্যিকারের অলরাউন্ডার। সবচেয়ে বড় কথা, মাঝে মাঝে চায়নাম্যানও করতেন।’
‘বলেন কী! সোবার্সও তো মাঝে মাঝে চায়নাম্যান করতেন।’
‘হ্যা। সে জন্যই তো মামুনকে আমরা দরিদ্রের সোবার্স বলতাম।’
আমি সুযোগ পেয়ে গেলাম,
‘এখন আমাকে বলেন, এই সোবার্সকে খুজে পাবো কোথায়?’
‘এই তো মুশকিল? ইনজুরিতে পড়ে খেলা ছাড়ার পর ওর সাথে তো আর কোনো যোগাযোগ নেই।’
‘কোথায় গেলে ঠিকানা পেতে পারি, বলেন না।’
‘ওর বাসা ছিলো জিঞ্জিরা। কিন্তু বিস্তারিত তো বলতে পারছি না। তুমি একটু বাবুর সাথে কথা বলে দ্যাখো।’
বাবু মানে, আমাদের আরিফুর রহমান বাবু ভাই। সিনিয়র সাংবাদিক। সেই ছোটবেলা থেকে ঢাকার স্টেডিয়ামে ফুটবল, ক্রিকেট দেখে আসছেন। আমাদের নিজস্ব জগতে খেলাধুলার এনসাইক্লোপিডিয়া বলে পরিচিত। আশি বা নব্বই দশকে তার না চেনা ক্রিকেটার খুজে পাওয়াই কঠিন।
বাবু ভাইও সোবার্স শুনেই চিনতে পারলেন। একটু স্মৃতি হাতড়ে বললেন,
‘যেবার রানাতুঙ্গা প্রথম এলো, সেবার মামুন টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন। সর্বোচ্চ বা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ছিলো মনে হয়।’
কিন্তু মুশকিল হলো, বাবু ভাইও বলতে পারলেন না মোহাম্মদ মামুনের ঠিকানা।
খোজায় কোনো ঘাটতি রাখলাম না। ততোদিনে ব্যাপারটা আমার জন্য একটা ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। এর মধ্যে সাকিব জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একই ম্যাচে সেঞ্চুরি করলো ও ৪ উইকেট নিলো। বাবু ভাই বললেন, আবাহনীর হয়ে এই কীর্তি ছিলো মোহাম্মদ মামুনের। আগ্রহটা আরও বাড়লো। হেডিংটাও দেখতে পাচ্ছিলামÑসাকিবের পূর্বসুরী এক সোবার্স।
কিন্তু স্টোরি করতে হলে লোকটাকে তো খুজে পেতে হবে। সেটাই পারছিলাম না।
এর মধ্যে আমার ছেলে হলো। সেই নিয়ে হাসপাতাল ছোটাছুটি করছিলাম। আমার স্ত্রীর যে ডাক্তার, উনি একসময় ক্রিকেট খেলতেন। ডেলিভারির পর উনি আমার সাথে গল্প জুড়ে দিলেন,
‘আপনি তো ক্রিকেট কাভার করেন?’
‘জি¦, স্যার।’
‘আমি একসময় খেলতাম, জানেন।’
‘আপনি ক্রিকেট খেলতেন, গান করতেন; সবই জানি।’
‘হ্যা। সে একটা সময় ছিলো।’
এই সুযোগে ওনার কাছেও একটু খোজ খবর করার সিদ্ধান্ত নিলাম,
‘স্যার, আপনি তো পুরোনো ঢাকার মানুষ। মোহাম্মদ মামুনকে কী চিনতেন?’
‘সোবার্স?’
‘হ্যা। ওনার কোনো খবর জানেন?’
‘মামুনের সাথে তো যোগাযোগ নেই। তবে ওর এক ভাইয়ের ছেলেকে চিনি আমি।’
অবশেষে। অবশেষে একটা সূত্র পাওয়া গেলো।
স্যারের দেওয়া সেই ঠিকানা ধরে জিঞ্জিরায়ই এক গাড়ি মেরামতের দোকানে গেলাম। মোহাম্মদ মামুনের ভাতিজাকে পাওয়া যাওয়ার কথা এখানে। ভাতিজার নাম শিহাব।
নাহ। পাওয়া গেলো না। দোকানের মালিক একজন বয়ষ্ক ভদ্রলোক। তিনি বেরিয়ে এসে বললেন,
‘শিহাব তো এহন আর এইহানে চাকরি করে না।’
‘ওনাকে কোথায় পাওয়া যাবে, বলতে পারেন চাচা?’
‘আমি বলমু ক্যামনে?’
এমন সময় পাশ থেকে এক মিস্ত্রী বললো,
‘শিহাবের বাড়ি ওই নদীর ওই পারে। প্রাইমারী স্কুলের পাশে।’
এই মিস্ত্রীর কথা মতো চলে সেই শিহাবের বাড়ি পাওয়া গেলো। শিহাব বাড়ি নেই। তিনি এখন বাংলা মটরে একটা দোকান দিয়েছেন-গাড়ির পার্টসের দোকান। তবে কিছুটা কাজ হলো। শিহাবের স্ত্রী বললেন, তার চাচার সাথে তাদের এখন আর কোনো যোগাযোগ নেই। তবে চাচা মিরপুরে কোথায় যেনো থাকেন।
শিহাবের নম্বর পাওয়া গেলো। সেই নম্বরে ফোন দিয়ে মামুন সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করতেই খেপে উঠলেন ভদ্রলোক,
‘মামুনের খবর আমি জানবো ক্যামনে?’
‘আপনার চাচা তো।’
‘ওসব চাচা গোনার টাইম নাই।’
‘দেখেন, আমি একটা নিউজ করার জন্য ওনাকে খোজ করছি। যদি কোনো ফোন নম্বর টম্বর...’
‘আমার কাছে পাবেন না। আমাগো সাথে হের কোনো সম্পর্ক নাই।’
এতোদিন ধরে ছোটাছুটি বিফলে গেলো। শুধু জানা গেলো যে, মামুন সাহেব বেচে আছেন এবং তিনি এখন মিরপুরে থাকেন। এ ছাড়া কিছুই উদ্ধার হলো না।
এখানেই সাঙ্গ দিলাম ব্যাপারটায়। যদিও শুভ্রদা বললেন,
‘হাল ছাড়িস না। একবার কাশীদার সাথে কথা বলে দ্যাখ।’
কাশীনাথ বসাক। এক কালে ক্রিকেট স্কোরার ছিলেন। পরে সাংবাদিকতায় এসেছেন। আমাদের দেশের ক্রিকেটের খুটিনাটি সব বিষয় পর্যন্ত মুখস্থ ওনার। হ্যা, ওনার কাছে একটা খবর মিলতে পারে।
কাশীদা একটু ইতিবাচক খবরই দিলেন,
‘মামুন খেলা ছাড়ার পর কিছুদিন আম্পায়ারিং করার চেষ্টা করেছে।’
‘তাহলে তো আম্পায়ার্স অ্যাসোসিয়েশনে ওনার ঠিকানা থাকতে পারে।’
‘নাহ। আমি খোজ করেছিলাম। নেই ওদের কাছে।’
‘তাহলে কোথায় পাওয়া যায়?’
‘দেখি, আমি খুজে পাই কি না।’
আপাতত কাশীদার ওপর ভরসা করে চুপ করে থাকতে হলো। তখন অবশ্য চুপ করে থাকা ছাড়া আর আমার কিছু করারও ছিলো না। মানে, সোবার্সকে নিয়ে ছোটার সময় ছিলো না। ইংল্যান্ড এসেছে বাংলাদেশ সফরে। প্রতিদিন প্র্যাকটিসে ছুটতে হচ্ছে। এর মধ্যে আশির দশকের এক ক্রিকেটারকে নিয়ে ছোটার সময় কই।
সেদিন মাঠে ঢুকতে ঢুকতে মনে হলো, আজ সাকিবের সাথে কথা বলতে পারলে একটা স্টোরি করা যায়। মাথা জুড়ে তখন সাকিবের একটা রেকর্ড। এটা নিয়ে আর কারো সাথে উচ্চবাচ্যও করছি না। কারণ, রেকর্ডটা বেশী লোক খেয়াল করেনি। এটা এক্সক্লুসিভ করতে হবে।
কপালটাও ভালো। স্টেডিয়ামে ঢুকেই দেখি, সাকিবের গাড়ি দাড়ানো।
গাড়ি থেকে সাকিবের ক্রিকেট ব্যাগ নামাতে থাকা সিউরিটির লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘সাকিব ভিতরে?’
‘হ্যা, স্যার। আগে আগে যান, ফাকা পাইতে পারেন।’
সিকিউরিটির এই লোকটা সবসময় আমাকে হেল্প করে। একটু হেসে বললাম,
‘ঠিক আছে, ভাই। আগাই।’
কয়েক কদম এগিয়ে যাওয়ার পর ঝট করে মনে হলো, লোকটার নাম তো মামুন। দীর্ঘদেহী মানুষ।
আস্তে আস্তে ফিরে এলাম,
‘আপনার বাসা কি জিঞ্জিরায়?’
একটু থতোমতো খেয়ে গেলো লোকটা। বললো, ‘জি, স্যার।’
‘আপনি আশির দশকে ক্রিকেট খেলতেন?’
এবার লোকটা সরে পড়তে চাইলো। চেপে ধরতেই বললো, ‘জি।’
‘আপনি মোহাম্মদ মামুন?’
‘জি।’

কী দারুন একটা স্টোরি- সাকিবদের ব্যাগ টানেন এক কালের সোবার্স!

৯৬৭ পঠিত ... ২৩:৫৫, এপ্রিল ১৫, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top