সেপ্টেম্বর, ১৭৫২: ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম মাস

৩১২৬ পঠিত ... ২১:৫১, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৮

ধরুন আপনি আজ দোসরা সেপ্টেম্বর রাতে ঘুমিয়ে সকালে উঠে দেখলেন আজ ৩ তারিখের বদলে সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ! মাঝের এই এগারো দিন কোথায় গায়েব হয়ে গেল, সেই দুশ্চিন্তায় বোধহয় আপনার আরও এগারো দিনের ঘুম গায়েব হয়ে যাওয়ার কথা। ঘুমের মাঝে এতগুলো দিন অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা গল্পের রিপ ভ্যান উইংকেলের কথা মনে করিয়ে দিলেও আড়াই শতাব্দী আগে এই দিনে ব্রিটিশ মানুষেদের জীবন থেকে এগারো দিন এক নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেছিল। এগারো দিন হারিয়ে যাওয়ার ক্ষোভে এমনকি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদও করেছিল তারা। কিন্তু কী ঘটেছিল সে দিনে?

অপ্রচলিত হয়ে যাওয়ার পরও ব্রিটেন এবং আমেরিকায় প্রচলিত ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবহার। যেখানে ইউরোপের সবগুলো দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে তাদের বছর হিসাব করতো, সেখানে ১৭৫২ সালের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখের আগ পর্যন্ত ব্রিটেনে বহাল তবিয়তে ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। সেদিন ব্রিটেনে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হওয়ায় ৩ সেপ্টেম্বর বদলে হয়ে যায় ১৪ই সেপ্টেম্বর, ব্রিটিশদের ক্যালেন্ডারে অদৃশ্য হয়ে যায় ১১ টি দিন।  

ঘুম থেকে উঠে এই ‘অস্বাভাবিক’ ঘটনা কোন ভাবেই মেনে নেয়নি ব্রিটিশরা। রাস্তায় নেমে তারা চ্যাঁচামেচি করতে শুরু করে ‘ফিরিয়ে দাও আমাদের ১১ দিন’ বলে। তাদের ধারণা হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার তাদের আয়ুষ্কাল থেকে এগারো দিন কমিয়ে দিয়েছে!

এই ভূতুড়ে ঘটনার শুরুটা আসলে ঘটেছিল ১৫৮২ সালে, সেসময়ের রোমান পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি সিদ্ধান্ত নেন পোপের সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা দেশগুলোর জন্য গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করার জন্য। তৎকালীন সময়ে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বিশ্বে দিন-ক্ষণ নির্ধারিত হত।

রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে এই ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। তার নামেই এর নাম জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হয়। এই ক্যালেন্ডার মূলত নির্ধারিত হয়েছিল সৌর বছরের উপরে, অর্থাৎ সূর্যের চারপাশে সম্পূর্ণভাবে প্রতিক্ষণ করতে পৃথিবীর যত সময় লাগে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারেও বছর হত 'প্রায়' ৩৬৫.২৫ দিনে। অর্থাৎ প্রতি চতুর্থ বছরটি একটি 'লিপ ইয়ার' বা অধিবর্ষ। তবে তখন ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ ছিল না, দুই দিনব্যাপী ফেব্রুয়ারি ২৩ হিসাব করা হতো। কিন্তু সূক্ষ্ম হিসেবের মারপ্যাঁচে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ১১ মিনিটের একটা হিসাবের ভুল ছিল। যার ফলে প্রতি ১২০ বছর সময়ে প্রায় ১ দিন যোগ হয়ে যাচ্ছিল ক্যালেন্ডারে, সকলের অজান্তেই। 

তৎকালে বছর শুরু হত মার্চ মাস থেকে। ২১ মার্চ ছিল খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব ইস্টারের তারিখ। প্রায় দেড় হাজার বছরের পরিক্রমায় একটা সময় ক্যাথলিক চার্চের কর্তাব্যক্তিরা আবিষ্কার করেন, ২১শে মার্চ নক্ষত্ররাজির যে অবস্থান থাকার কথা ছিল, সেটি আর থাকছে না। অবশেষে ১৫৮২ সালে নতুন একটি ক্যালেন্ডার গ্রহণ করা হয়।

পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা সকল দেশই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার বাদ দিয়ে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে অভ্যস্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি মাস পায় তার ২৯তম দিন এবং জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে থাকা ১১ মিনিটের ত্রুটিও দূর হয় অনেকাংশে। একইসাথে আগের প্রায় দেড় হাজার বছরে যুক্ত হওয়া ১০ দিন ফেলে দিয়ে তারিখও পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। 

বিপত্তিটা ঘটলো আরও ১৭০ বছর পর। অন্যান্য দেশগুলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে চলে আসলেও ‘আভিজাত্যের প্রতীক’ ব্রিটিশদের গড়িমসিতে তারা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে চলছিল। বিশেষত তারা তখনো ক্যাথলিক হয়ে ওঠেনি, পোপের কথা কেনই বা মানতে হবে! তবে পোপের কথা না শুনলেও, ইউরোপের অন্যান্য রাজ্যের সাথে ব্রিটেনের সময়ের হিসাব মেলাতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। অবশেষে বাকি ইউরোপের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ১৭৫১ সালে ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নেয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে চলার। ১৭৫১ সালটি মার্চ মাসে এসে শেষ হবার কথা থাকলেও ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যায় এবং জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হয় নতুন বছর। ফলে ১৭৫১ সালটি শেষ হয়ে যায় ২৮২ দিনেই।

নতুন ক্যালেন্ডার ১ জানুয়ারি শুরু হয় ঠিকই কিন্তু বছরের বেশ অনেকদূর গিয়ে শাসকরা আবিষ্কার করেন, বাকি ইউরোপ পিছিয়ে আছে ১১ দিন। নতুন ক্যালেন্ডার করে লাভই কি, যদি সবার সাথে সময়ের ঐকতান না আসে। তাই ২ সেপ্টেম্বরের পরের তারিখটি ১১ দিন কেটে দিয়ে নির্ধারণ করা হয় ১৪ সেপ্টেম্বর। আর দেরিতে এসে ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের জন্য ব্রিটিশ মানুষদের খেসারত দিতে হয় পাক্কা এগারোটি দিন!

রোমান এই ‘অদৃশ্য ১১ দিন’ এর হিসাব-নিকাশ ঠিক করতে ভাল বেগ পোহাতে হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারকে। ১১ দিনের শোকে দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া ব্রিটিশদের ঠাণ্ডা করতে তাদের আশ্বস্ত করা হয়, সেপ্টেম্বরে ১১ দিন কম হলেও এই ১১ দিনের মজুরি তাদের দেওয়া হবে এই বলে। এই ঘটনার আগে ও পরে ক্যালেন্ডার বদলের জন্য দিন হারিয়ে ফেলার ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটলেও বড় পর্যায়ের দাঙ্গা-হাঙ্গামা এখানেই ঘটেছিল শুধু। 

এখন পর্যন্ত ব্রিটিশরা তাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সংরক্ষণ করলেও ক্যালেন্ডার থেকে হারানো ১১ দিন আর কোনভাবেই ফেরত পায় নি। শুধু যে ব্রিটেনে তাই নয়, তখন ব্রিটিশ শাসনে থাকা উত্তর আমেরিকা ও অন্যান্য কলোনিগুলোও হারিয়ে ফেলে ১১টি দিন। অবশ্য আধুনিক বিশ্বের প্রায় প্রতিটি কোণে অনুসরণ করা এই ক্যালেন্ডারটিও যে পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত তাও কিন্তু নয়। সূক্ষ্মতর এক হিসাবে প্রতি ৩২৩৬ বছরে আমরাও ১টি দিন 'হারিয়ে' ফেলব। 

৩১২৬ পঠিত ... ২১:৫১, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৮

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top