মানবতা বিরোধী অপরাধের ঘটনা ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে, কিন্তু শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অন ক্যামেরা। সোশ্যাল মিডিয়া বিকশিত হওয়ায়, আর প্রতিটি নেটিজেনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে ছবি তোলা ও ভিডিও করার সুবিধা থাকায় ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবকালে হাসিনার নির্দেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের দৃশ্যাবলী ইতিহাসের নিকৃষ্ট বর্বরতার সাক্ষ্য হয়ে রয়ে যায়।
সে কারণে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার পক্ষে দ্রুততম সময়ে এই মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হয়। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জুলাই হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ভিডিও ফরেনসিক পরীক্ষা করে এর অথেনটিসিটি প্রমাণ করে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া জুলাই বিপ্লবের নিয়মিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে হাসিনার ফ্যাসিজমের ইতিহাস ড্রাফট করে। ফলে শেখ হাসিনার এই মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পর্কে এত নির্ভুল তথ্য প্রমাণ রয়ে গেছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো ফ্যাসিস্টের ক্ষেত্রে ঘটেনি।
হাসিনা নিজেই নাগরিকদের বাক-স্বাধীনতা সংকুচিত করতে ইসরায়েল থেকে যে স্পাইওয়ার আমদানি করেছিলেন, তাতে রেকর্ড হয়ে গেছে জুলাই হত্যাযজ্ঞে তার সরাসরি নির্দেশনা। তিনি ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে বিক্ষোভকারীদের জটলা চিহ্নিত করে–হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার, বিক্ষোভ দমনে লেথাল উইপন ব্যবহারের নির্দেশনা, গ্রেফতার করে নির্যাতনের হুকুম দিয়েছেন। স্বকণ্ঠে টেলিফোন কথনে এসব অপরাধের প্রমাণ রেকর্ড হয়ে আছে। নাগরিকদের পীড়নে যে স্পাইওয়ারের ফাঁদ পেতেছিলেন তিনি, সেই ফাঁদে শিকারী নিজেই ধরা পড়লেন যেন।
শেখ হাসিনার জুলাই অপরাধ সংঘটনের পার্টনার ইন ক্রাইম পুলিশের আইজিপি গ্রেফতারের পরে তিনি সমুদয় তথ্য দিতে রাজি হওয়ায়; তার সাক্ষ্য জুলাইয়ের অপরাধ কর্মকাণ্ডের নিখুঁত প্রমাণ এসে গেছে আদালতের হাতে।
এছাড়া জুলাই-এ নিহতদের পরিবারের সদস্য, আহত জুলাই বিপ্লবীরা, সেসময় মৃতদেহের ময়না তদন্ত করা চিকিৎসক, আহতদের চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসকদের দীর্ঘ ও অনুপুঙ্খ সাক্ষ্য হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ দিয়েছে।
এইসব তথ্য প্রমাণ বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক আদালত শেখ হাসিনাকে তার মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। জুলাই-এ হাসিনা তার দলীয় ক্যাডার ও অনুগত বাহিনী দিয়ে যে নির্মমভাবে শিশু-কিশোর-তরুণ, ছাত্র-ছাত্রী ও নানা বয়সের সহস্র মানুষ হত্যা করেছেন; সারাজীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছেন; সেই অপরাধের তুলনায় প্রাপ্য শাস্তি কোনো আইন গ্রন্থে নেই।
পশ্চিমা বিশ্বে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে গ্রহণযোগ্য শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উপনিবেশকালে পশ্চিমা বিশ্ব পৃথিবীর বিভিন্ন উপনিবেশে যে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে; তা থেকে সভ্যতার আলোয় ফিরতে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান গ্রহণ করেছে। প্রচলিত ধর্মগুলোর শিক্ষা বিবেচনা করলেও মানুষ হত্যার বিধান অগ্রহণযোগ্য নয়। তা ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অপরাধীর অপরাধ স্বীকার ও অনুতপ্ত হবার পথ খোলা রাখে। এইসব বিবেচনায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার সমালোচনা করেছে। এই মানবাধিকার সংস্থাগুলো হাসিনার পনেরো বছরের অন্ধকার শাসনামলে সংঘটিত গুম, ক্রসফায়ার, বেআইনি কারাদণ্ড প্রদান, মৃত্যুদণ্ড প্রদান, কারাগার ও আয়নাঘরে নির্যাতনের কড়া সমালোচনা করেছে। কাজেই মানবাধিকার সংস্থার দায়িত্ব তারা নিয়মিত পালন করেছে; এখনও করছে; আর সেটাই প্রত্যাশিত।
শেখ হাসিনা যেহেতু ২০২৪-এর ৫ অগাস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন, ভারত সরকার এই মানবতাবিরোধী অপরাধ ও তার অপরাধ কর্মকাণ্ডের পার্টনার ইন ক্রাইমদের আশ্রয় দিয়েছে। এতে ভারত হয়ে উঠেছে অন্যদেশের খুনি ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। ২০০৯-২৪ শেখ হাসিনার বেআইনি শাসনকালে তার সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভারতের ক্ষমতা কাঠামোর সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া ভারতের প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির লেখা আত্মজীবনীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি রয়েছে। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশের ২০১৪ সালের নির্বাচনে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। ঢাকায় এসে তিনি এই হস্তক্ষেপ করেন; এমন তথ্য-প্রমাণ সংবাদপত্রে রয়ে গেছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাগ্রহণের পর তার অনুসৃত ইসলামোফোবিয়ার নীতি অনুযায়ী শেখ হাসিনা ইসলামি সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন করিয়েছেন। এতে নারী, শিশুসহ নিরাপরাধ মানুষ নিহত হয়েছে। মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা গুজরাটের কসাই বলে নিন্দিত এই হিন্দুত্ববাদী নেতার আগমনের প্রতিবাদ জানালে; মোদিকে খুশি করতে হাসিনার পুলিশ প্রায় ১৭ জন কিশোর ও তরুণকে গুলি করে হত্যা করে। মোদি এসেছিলেন ঢাকায়। আর ঐ মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছিল কুমিল্লায়।
এসব ঘটনা প্রবাহ আর জুলাই বিপ্লবের সময় থেকে আজ অবধি ভারতীয় মিডিয়া, প্রশাসন ও বুদ্ধিজীবীদের বৈরী প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়; হাসিনা হয়ে উঠেছিলেন দিল্লির আস্থাভাজন কর্মচারী।
সেই কর্মচারী মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত হওয়ায়; প্রচলিত বন্দী প্রত্যার্পণ আইন অনুযায়ী দিল্লি যে হাসিনাকে ঢাকার কাছে হস্তান্তর করবে না; তা হাসিনার দণ্ড ঘোষণার পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়সারা বিবৃতি থেকে ধারণা করা যায়।
ভারত তার পররাষ্ট্রনীতির ত্রুটির কারণে আর প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছায়া উপনিবেশ কল্পনা করার কারণে কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে তার সহজাত সদ্ভাব নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় কার্যত আফগানিস্তানের তালিবান প্রশাসন ছাড়া দিল্লি প্রশাসনের আর কোনো বন্ধু নেই। ইড, ইগো আর সুপার ইগোকে দূরে সরিয়ে ভারতের আত্মজিজ্ঞাসা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। একবিংশ শতকের পররাষ্ট্র নীতি পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে পরিচালিত। কাজেই ভারতকে তার ওল্ড প্যারাডাইম-এর কলোনিয়াল ড্রিম কিংবা পৌরাণিক অখণ্ড ভারতের ইউটোপিয়া থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিবেশীর সার্বভৌমত্বের জন্য ঝুঁকি না হয়ে; সভ্য দূরত্ব ও নৈকট্য ধরে রাখতে হবে।
মানবতা বিরোধী অপরাধী শেখ হাসিনার অনুসারীরা, হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও সহিংসতা জারি রেখেছে। এই দায় হাসিনাকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা মোদি প্রশাসনকে নিতে হবে। হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষিত হবার পর গোটা পৃথিবীর মিডিয়া তা গুরুত্বের সঙ্গে ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে সংবাদ প্রচার করেছে। আর ভারতীয় মিডিয়া ও বিজেপির নেতাদের দেখা গেছে এক মিথ্যা একশোবার বলে তা সত্য প্রমাণের বৃথা চেষ্টা করতে। এ রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে কলাকৈবল্য ভারতের মিডিয়া ও রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে লক্ষ্য করা গেছে, তা হাসিনার পার্টনার ইন ক্রাইম হিসেবে ভারতের সক্রিয়তাকেই মেলে ধরে যেন।
যে কোনো শাস্তির লক্ষ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আর জাতিগত শিক্ষা। শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার; বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতিক-পুলিশ-প্রশাসনের জন্য শিক্ষামূলক। বাংলাদেশে আর কখনও যেন ফ্যাসিস্ট শাসক তৈরি না হয়; নিজের দেশের জনগণের জীবন ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে তার পরিণতি শেখ হাসিনা ও তার অপরাধের দোসরদের মতো হয়; এই হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক আদালতের রায়ের দৃষ্টান্তে।



পাঠকের মন্তব্য