কাপটা পরিষ্কার কইরা স্যাররে চা দে, নীচে পিরিচ দিস

২৭৪ পঠিত ... ১৮:৩৮, জুলাই ১৭, ২০২৫

সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট ব্যাপারটা আমাদের সমাজের মতো আর কোথাও দেখবেন না। একটা লোক দুটি পাশ দিয়ে লুঙ্গি খুলে শার্ট প্যান্ট পরা শিখলেই সে মনে করে, এই সমাজে তার সম্মান প্রাপ্য; লুঙ্গি পরা লোকের দায়িত্ব তাকে প্রেফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট দেয়া।

গ্রামের যে ছেলেটা এলাকার প্রথম ম্যাট্রিক পাশ বলে গ্রামবাসী মিষ্টি বিলিয়েছিলো; সেই ছেলেটি শহরে গিয়ে আরো দুটি পাশ দিয়ে ফিরলে; তখন তার মধ্যে সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট এসে পড়ে। সে মনে করে এই গ্রামে সেই সর্বজ্ঞ।

ইতিহাসে নবাবী আমলে যারা ভ্যাগাবণ্ড ছিলো; বৃটিশ আমলে তারা কোলাবরেটর হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর অধীনে জমিদারি পেয়ে যায়। সেই জমিদারের যে সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট সেটাই আজো আমাদের সমাজে বিরাজ করে।

যেহেতু গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশ; অতএব সে জমিদার তনয় সেজে গ্রামময় হামবড়া করে বেড়ায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় এই গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশ ও জমিদার তনয় সিনড্রোম ও সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্টের বাড়বাড়ন্ত।

তারা গ্রামবাসীদের দিনমান জ্ঞান দেয় কোনটি সঠিক ও কোনটি বেঠিক সে সম্পর্কে।

আমরা ২০২৪-এর জুলাই পর্যন্ত এই সমুদয় গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশদের বিদ্যার দৌড় ও তা থেকে সৃজিত ব্যর্থ সমাজ দেখেছি। এদের চিন্তার বর্জ্যকে প্রত্যাখ্যান করে জেনজি'রা জুলাই বিপ্লব সাধিত না করলে; আজো দেখতেন গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশেদের গলায় গামছা দিয়ে গ্রামময় ঘুরাচ্ছে আওয়ামী লীগের ম্যাট্রিক ফেলেরা।

কিন্তু জেনজিরা যেহেতু বিপ্লব করে দেশটাকে ক্যানিবালের হাত থেকে রক্ষা করেছে; সুতরাং গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশ প্রথম দিন বললো, এটা বিপ্লব নয়, অভ্যুত্থান। কারণ অমুক গ্রন্থে তমুক যেভাবে বিপ্লবের ডেফিনিশন দিয়েছেন; তার সঙ্গে এটা মেলেনা। গ্রন্থ মানে এম এম আকাশের বুক শেলফে যে বইগুলো থাকে আর কি। এর কিছু দিন পর গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশেরা বললো, নাহ এটা অভ্যুত্থানও নয়, আন্দোলন।

যেহেতু বয়সে ধাড়ি, কিন্তু জীবনে জিনস টি-শার্ট পরে কফি খাওয়া ছাড়া আর কোনো এচিভমেন্ট নাই; তাই তিরিশের নীচের তরুণেরা যা অ্যাচিভ করেছে; তাকে নাই করে দিতে হবে। ঊনবিংশ শতকের জোড়াসাঁকোর আড্ডা সাজিয়ে বেশ খানিকটা সংস্কৃতি মামা ও খালার ভং ধরে শুরু হলো তোতাপাখির মতো মেটিকুলাস মেটিকুলাস শব্দের উচ্চারণ। সেই যে ‘আই ডোন্ট নো’ বাক্যের অর্থ ‘আমি জানি না’ বলাতে গ্রামবাসী যেরকম খুশিতে হুটোপুটি খেয়েছিলো।

ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাহত জার্মানির ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সময় লেগেছে। অথচ গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশ মামা ও খালারা ৫ অগাস্ট সন্ধ্যা থেকে তারাপদ রায়ের ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’ আর ‘বিপ্লব তার সন্তানদের খেয়ে ফেলে’ আলাপটা জুড়ে দিলো। প্রবীণ প্রজন্মের মুখে যা শুনেছে ঐসব কথাই কপি পেস্ট করে নতুন ফাঁপা প্রজন্মটি দাঁড়াতে থাকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে।

সভ্যতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মাপকাঠি বিশ্বজনীন। কিন্তু গ্রামের ম্যাট্রিক পাশের চোখে সভ্যতা ও মূল্যবোধের পদ্ম ফুল কেবল ফুটে থাকে আওয়ামী লীগের পুকুরে। আওয়ামী লীগের গণহত্যা তাই গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশের বয়ানে ইসলামি সন্ত্রাস দমন; আর আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস প্রতিহত করার চেষ্টা গণহত্যা। এদের চিন্তা নরেন্দ্র মোদির বয়ানের সঙ্গে মিলে যায়। কারণ গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশ হিসেবে সবুজ লুঙ্গি ও খসখসে ধুতি খুলে শার্ট-প্যান্ট পরার সময় থেকে সে শিখেছে, জঙ্গি-মৌলবাদি-ইসলামপন্থী-মব এসব শব্দ ব্যবহার করলে ‘জাতে’ ওঠা যায়।

পুরো বিশ্বে যখন জাত-পাতের বাইরে সাম্য চিন্তাই সমসাময়িক চিন্তা বলে স্বীকৃত; তখন এরা পড়ে আছে আঁশটে আভিজাত্যের মোহে।

আমাদের সমাজের বেজায় দোষ হলো এর অন্তর্গত রেসিজম; ফলে প্রচলিত সংজ্ঞায় দেখতে আকর্ষণীয় নয় এমন কিশোর-কিশোরীদের মাঝে তৈরি হয় হীনমন্যতা। তখন সুপিরিয়র সাজতে গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশ সংস্কৃতি মামা-খালা হিসেবে তারা আঁট কষতে থাকে। দেখবেন এরা লোকজনকে বাঙ্গি, ছাপড়ি, ফইন্নি বলে নিজেরা অভিজাত সাজতে চেষ্টা করে।

এরা এতোই অভিজাত যে, বিপ্লবের সাঁঝ থেকে তারা দেশে ফাইভ স্টার ফ্যাসিলিটিজ চাইতে শুরু করে। রেললাইনের ধারে প্রাতঃক্রিয়া সারা লোকের যেমন শার্ট প্যান্ট পরলেই তাদের এটাচড বাথের প্রয়োজন হয়।

গ্রামের প্রথম ম্যাট্রিক পাশ; এই পাশটা না দিলে কিন্তু আনন্দে সময় কাটাতে পারতো। কিন্তু যেহেতু পাশ দিয়েছে, ফলে সে বিষাদ-বিষণ্ণতা এই শব্দগুলো শিখেছে। সারাক্ষণ ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাচক্যাচানি যেহেতু অস্বাভাবিক আচরণ; ফলে এদের চোয়াল ঝুলে যায়। তখন ব্যক্তিগত বিষাদের পাঞ্চিং ব্যাগ বানায় জুলাই বিপ্লবীদের। কিংবা শিল্প আড্ডায় ভাজা পোড়া খেয়ে গড়বড় হলে ফেসবুক এসে লিখে দেয়, স্টেপ ডাউন ইন্টেরিম।

এই তো কিছুদিন আগে জুলাই বিপ্লবীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে সংস্কৃতি মামা ও খালারা এসে বিপ্লবীদের কতো বকাঝকা করলো। এখন আবার সেনাবাহিনী জুলাই বিপ্লবীদের গোপালগঞ্জে পতিত আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে রক্ষা করলে,  সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে লেকচার দিচ্ছে।

দার্শনিক ছফা আহমেদ বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে বাংলাদেশ কখনও স্বাধীন হতো না। সেইকালে পড়ালেখা জানা বুদ্ধিজীবীদের যদি এ অবস্থা হয়; তাহলে একালের জোড়াতালি দেয়া বুদ্ধিজীবীর কথা শুনলে, হাসিনার স্বৈরশাসন অনন্ত যৌবনা হয়ে থাকত। এদের কথা না শোনাতেই অন্তত দেশকে ক্যানিবাল শাসনমুক্ত করা গেছে।

২৭৪ পঠিত ... ১৮:৩৮, জুলাই ১৭, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top