ওরা যখন সাস্টের তরুণীকে ধর্ষণ করল; আপনারা ফিরেও তাকালেন না; ওরা যখন ইপ্সিতাকে ধর্ষণ ও হত্যা করল; আপনারা তখন অনুশীলিত নির্লিপ্ততায় মুখ বুঁজে থাকলেন। মুরাদ নগরের তরুণী ধর্ষণের অভিযোগে আপনারা ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন। এই যে আপনাদের সিলেক্টিভ তন্দ্রা কিংবা তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠা; এ কারণেই নারীর জন্য নিরাপদ জনপদ আমরা গড়তে পারিনি।
এটাই তো আপনারা করে আসছেন; পূর্ণিমা ধর্ষণ নিয়ে আপনারা দিস্তার পর দিস্তা লিখলেন; কিন্তু সুবর্ণচরের গৃহবধু ধর্ষণে আপনারা আবার ফুলের মাঝে ঘুমিয়ে পড়লেন ফুলের মধু খেয়ে।
নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা আপনাদের কাছে রাজনীতির রণাঙ্গন। নারীকে আপনারা ধর্ম-দলীয় পরিচয়-এক্টিভিজমে আপনার কি লাভ; তা দিয়ে ভাগ করে নিয়েছেন; ধর্ষণের অপরাধীকেও আপনি ধর্ম ও রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে ভাগ করে নিয়েছেন; এ কারণেই বাংলাদেশে নারীর নিরাপত্তা এমন ভঙ্গুর অবস্থায় রয়ে গেলো।
মনের খুব গোপনে কিংবা ভাষায় প্রকাশ্যে ‘আগেই ভালো ছিলাম’ মন্ত্রটিকে প্রমাণে আপনি ধনুক ভাঙ্গা পণ করে লেগেছেন। সাস্টের তরুণীর ধর্ষকের ধর্ম পরিচয় আপনার কাংখিত পলিটিক্যাল এঙ্গেল স্যাটিসফাই করতে পারছে না বলে; আপনি স্পিকটি নট হয়ে রইলেন, ইপ্সিতা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন কর্মী বলে তার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড মায়া জন্ম দিতে পারলো না আপনার মাঝে। মুরাদ নগরের মেয়েটির ধর্ষণ আপনার জন্য চৌম্বক আবেশ তৈরি করেছে; কারণ তার ধর্ম পরিচয়টির প্রতি চুম্বকীয় আকর্ষণ রয়েছে আপনার। ধর্ষকের ধর্ম পরিচয় আপনার রাজনৈতিক এঙ্গেলের জন্য উপযোগী। পতিত আওয়ামী লীগ মুরাদনগরের ভিডিওটি ছড়িয়েছে ধর্ষক বিএনপি কর্মী এই আনন্দে। এইসব শোকের উতসব ও অভিনয়ে দ্রুত নারীকে বাংলাদেশের পতাকা পরিয়ে এসথেটিকস ঘনীভূত করেছেন; আপনারা ভাই ইমেজ, ভিডিও, পেইন্টিং নিয়ে খেলতে পারেন। মানুষের বিপদ আপনাদের কাছে নেহাত রাজনীতির খেলা।
বাংলাদেশসহ এই বিস্তীর্ণ দক্ষিণ এশিয়া; এইখানে নারীর কোন ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় নেই। সে আজন্ম ভিক্টিম একজন। পাশবিক পুরুষ সমাজের লিঙ্গ গর্বের সামনে অসহায় সে। এইখানে সে কি পরবে, কি করবে তা ডিকটেট করতে চেষ্টা করে পুরুষ সমাজ। আমসিপারা কিংবা গানের শিক্ষক পেডোফিলিক হয় কন্যাশিশুদের সঙ্গে। পথে বের হলে ধর্ষণ কামনা নিয়ে জুল জুল করে তাকিয়ে থাকে লালসার লালামাখা লোলুপ পুরুষেরা, ধর্ম মামা ফতোয়া দেয় নারীকে ঘরে আটকে রাখতে; সংস্কৃতিমামা কাস্টিং কাউচে ম্যানিম্যাল হয়ে ওঠে, অফিসের বস, কারখানার সুপারভাইজার, পাড়ার মাস্তান পদে পদে নারীর জন্য মাইন পেতে রাখে যেন। পুরুষেরা নারীকে হানি ট্র্যাপের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে; ফেসবুকে নারীকে দিয়ে কল ফাঁস কিংবা স্ক্রিনশট ফাঁস করানোর রিং মাস্টারেরাও পুরুষ।
গত তিনটি দশকে শিক্ষায় ও কর্মক্ষেত্রে নারী যেভাবে এগিয়ে গেছে; তাতে ঈর্ষান্বিত পুরুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় কিংবা প্রকাশ্যে নারীকে খানকি মাগী, বেশ্যা ইত্যাদি গালি দিয়ে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। সাম্প্রতিক সময়ে নারী সংস্কার কমিশনের রিপোর্টকে ঘিরে ধর্ম মামা ও কমুনিস্ট মামা উভয়েই নারীকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে সক্রিয়। নারীর জীবনে প্রতিকূলতার কোন শেষ নেই যেন।
ধর্ম পরিচয় কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় নয়; নারী ও পুরুষ হচ্ছে প্রতিপক্ষতার আসল ক্ষেত্র। এই বাস্তবতা অনুধাবন না করে; ধর্মঘন ও রাজনৈতিক দলঘন পুরুষের অঙ্গুলি হেলনে নারী নিজেকে দ্বন্দ্বের রণাঙ্গণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেয়।
তাই ভারত ও আওয়ামী লীগ বলয়ের বহুব্যবহারে জীর্ণ সংখ্যালঘুর ভিক্টিম কার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে নারী মুক্তির সংগ্রাম সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। ভারতে নারী ধর্ষণের প্রাবল্যের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো ভারত ভ্রমণে সাবধানতা জারী করেছে। আর আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাংলাদেশের ধর্ষণের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করা সেঞ্চুরি মানিকদের ধর্ষকামিতার প্রতীক।
ধর্ম-দল নির্বিশেষে নারীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে; নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে। নিরাপত্তার জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে চলবে না। কন্যাশিশুদের জন্য শরীর চর্চা ও সেলফ ডিফেন্স ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে স্কুল পর্যায় থেকে।
আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীকে ভিজিল্যান্ট থাকতে হবে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কোন অপরাধ সংঘটিত হবার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীর বিচার করে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
আসন্ন নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করতে হবে। বাংলাদেশ সমাজকে উত্তরণের পথে নিয়ে যেতে পারে কেবল এই নারী সমাজ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী এই নারী সমাজ। জুলাই বিপ্লবে নারী প্রমাণ করেছে; সে চাইলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে হয়।
নারীকে মুক্তি দিতে হবে "অনার" নামের অনড় পাথরের ভার থেকে। ম্যানিম্যালেরা নারীর ভিডিও করে ছেড়ে দিলেই মান ইজ্জত সব চলে গেলো বলে নারীকে লোকলজ্জাজনিত আত্মহননের পথে এগিয়ে দেয় সমাজ। নারীর ভিডিও তৈরি করে ছাড়ে যারা লোকলজ্জার পাথরটা তাদের ওপর চাপানো উচিত। তাদেরকে আইনি পথে শাস্তি দেবার পাশাপাশি সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। ফেসবুকে নারীকে যারা গালাগাল করে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।
ভিক্টিম কার্ডের মাতম আর রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য নারীকে ব্যবহার চিরতরে বন্ধ না করলে; নারীর ঐক্য ও মুক্তি সম্ভব নয়। নারীর নিরাপত্তার জন্য মিছিল কোন ক্ষণস্থায়ী ইভেন্ট নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না হচ্ছে; ততক্ষণ পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মকে রাজপথে সক্রিয় থাকতে হবে। নারীর জন্য নিরাপদ জনপদ তৈরি করে তারপর ঘরে ফেরা।
পাঠকের মন্তব্য