নগরের জনৈক প্রেমিক ‘ঢাকা অ্যা-টাক’ যেমনটা দেখিলেন

২৭৮১ পঠিত ... ১১:৫৯, অক্টোবর ১৮, ২০১৭

ঢাকায় আসিয়াছি বোধ করি বছর দেড়েক হইবে। চাকুরির সন্ধানে মাসের পর মাস কেবল ঘুরিয়াই বেড়াইয়াছি এই শহরে। এরই মাঝে ঘন চুলের মাথায় গুলিস্তানের মতো টাক দেখা দিয়াছে। অথচ চাচায় বলিয়াছিলেন, ঢাকায় আসিলেই নাকি চাকুরি পাওয়া যায়... তাই ঢাকায় অ্যাটাক করিবার জন্য, মানে ঢাকা যাইবার জন্য। কিন্তু চাকুরি খুঁজিতে খুঁজিতে জুতোর তলা খসিয়া গেলেও চাকুরি আর ধরা দিচ্ছিল না।

অতঃপর চাকুরি ধরা দিলো ঠিকই। মাস তিনেক আগে স্বল্প মাইনের এক চাকুরিতে প্রবেশ করিলাম বটে, পরন্তু ইহার পর নিজের জন্য সময় বাহির করাই দুঃসাধ্য হইয়া পড়িয়াছিল। ওদিকে ঢাকায় আসিয়াই কোন কুলক্ষণে যে এক বড়লোকের বেটিকে পটাইয়া নিজের কপালে শনি ডাকিয়া আনিয়াছিলাম তা আর না ই বলি। তো এরই মাঝে উক্তি বেটি অর্থাৎ গফ বলিলো- ‘আরিফিন শুভর একটা জোস মুভি আসছে, চলো না দেখতে যাই।’ আমি বলিলাম- ‘সময় পাইলে যাইবো।’ এরপর আবার একদিন বলিল- এবিএম সুমনের একটা জোস মুভি আসছে, ‘চলো না দেখতে যাই। আমি বলিলাম- সময় পাইলে যাইবো।’

এরপর দুইদিন তাহার আর কোন খবর নাই, আমিও হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম এই ভাবিয়া যে যাক, আপদ দূর হইয়াছে। ওইদিন কী মনে করিয়া আয়নার সামনে দাঁড়াইয়াছিলাম (ক’বছর পর কে জানে!), মনে হইল টাকটায় কিছু চুল উঠিয়াছে বুঝি! কিন্তু সেইদিনই রাত্রিবেলা আমাকে কল করিয়া গফ যা বলিলো, তাহা শুনিয়া আমার মাথার থেকে চুল তো চুল, বুক হইতে একরকম আত্মাই উড়িয়া গেলো। সে বলিলো- ‘শোন বিড়ালের ছাও, কাল যদি আমাকে তুই তাসকিনের মুভি দেখাতে না নিয়ে যাস তাহলে তোর সাথে ব্রেকাপ তো করবোই সাথে বাপিকে বলে তোর চাকরিও খেয়ে দিবো।’ আমার তো মাথা সহ যাবতীয় অঙ্গে হাত, এই বেগানা নারী বলে কী! কোন কুলক্ষণে যে eআরকিতে একটা রম্য লেখা লিখিয়াছিলাম! তারপর সেই লেখা পড়িয়া আমাকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া ফেসবুকে চ্যাট শুরু। তার পাউট করা ফেস আর সারমেয় ফিল্টারের ছবি দেখিয়া কিঞ্চিৎ ক্রাশ খাইয়াছিলাম বিধায়ই আজ এই অবস্থা আমার।

উপয়ান্তর না দেখিয়া রাজি হইয়া গেলাম, কাল তাহাকে নিয়া দেখিয়া আসিবো সেই সিনেমা। মাথার টাকে হাত বুলাইয়া আদর করিয়া নিজেকে বলিলাম, ঢাকায় আসিয়া যে আমার টাক হইল, সেই আমাকেই নাকি এখন দেখিতে হইবে- ‘ঢাকা অ্যা টাক’, উপসস... ঢাকা অ্যাটাক!

সকাল সকাল উঠিয়া, দাঁত মাজিয়া পকেটে দুই হাজার টাকা লইয়া বাহির হইয়া গেলাম গফকে পিক আপ করিবার জন্য। বাহির হইয়াই দেখি গফ তাহার বাপির বিশাল গাড়ি লইয়া আমার মেসের সামনে অপেক্ষমান। গাড়ি দেখিয়া গরম থেকে বাঁচিবার আনন্দ অনুভূত হইলেও গফের ভবিষ্যৎ বকবকানির আশঙ্কায় সেই আনন্দ নিমিষেই উড়িয়া গেল। গাড়িতে বসিতেই সে শুরু করিল কোন এক তাসকিনের গুণগান, তার নীল নীল চোখ আর ম্যানলি হাসি শুনিয়াই নাকি গফ আমার কাইত। আমি মনে মনে বলিয়া উঠি- ‘তুই ঐ তাসকিনের কাছে গিয়াই থাক, তাহার সহিতই খেল... আমাকে এইবার রেহাই দে...’

এইসব পকপক আর বকবক শুনিতে শুনিতেই ড্রাইভার বলিলো, বসুন্ধরা সিটি আসিয়া পড়িয়াছি। সিনেপ্লেক্সে উঠিবার জন্য লিফটে চড়িতেই সামনে দেখি এক মোটা বাচ্চা হাসি হাসি মুখ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। সে অতি আনন্দ নিয়া আমার পা মাড়াইতেছে বারবার। তাকে বলিলাম- বাবু, পা টা সরাও। সে আমার কথা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করিয়া অতি আনন্দ লইয়া হাসিতে লাগিল। মন চাইলো হাতে ছেপ লাগাইয়া গালে কষিয়া একখানা চটকনা মারি। কিন্তু পাশেই তাহার দশাসই মা দাঁড়াইয়া থাকায় ইচ্ছাটা চাপিয়া গেলাম।

সিনেপ্লেক্সের সামনে আসিয়াই দেখি বিশাল এক লাইন টিকিটের জন্য। লাইনে দাঁড়াইয়া রইলাম আধাঘণ্টা, এর মাঝে গফের ‘তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো’ আর সেলফি তোলা চলিতেই লাগিলো। আমি লাইনেই দাঁড়াইয়া বেশ কয়েকবার অদ্ভুত মুখভঙ্গী করিয়া তাহাকে যথার্থ সঙ্গ দিয়াছি বৈকি!

অতঃপর টিকিট পাইতে পাইতে সিনেমার দশ মিনিট শেষ, গফ আমার ইতমধ্যে কান্নাকাটি শুরু করিয়া দিয়াছে তাহার তাসকিনকে অলরেডি দেখাইয়া ফেলিয়াছে বলিয়া। সেই কান্না দেখিয়াই চেকিং ছাড়া ঢুকিতে দিলো সিকিউরিটি গার্ড। হলে ঢুকিয়াই দেখি মাহিয়া মাহি ছায়ায় দাঁড়াইয়া বেঢপ একখানা সানগ্লাস পড়িয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জেরা করিতেছেন, বুঝিলাম এই সিনেমার সাংবাদিকরা অনেক ফ্যাশন সচেতন। পাশে আমার গফের ‘আমার তাসকিন কই, আমার তাসকিন কই’ রব চলিতেই লাগিল। এরই মাঝে দেখি আরিফিন শুভ পর্দায়, তখন বুঝিলাম এই সিনেমার কথাই প্রথম বলিয়াছিল গফ। তাহলে এই সিনেমায় তাসকিন আসিলো কোথা থেকে? আমার গফ কারে চায়, শুভ নাকি তাসকিন? হঠাৎ দেখি মাহিয়া মাহির সামনে তার বস, একটা ক্রাইম কেস থেকে তিনি মাহিকে অব্যাহতি দিতে চান, কিন্তু মাহি এতে এতোটাই কষ্ট পাইয়া যান যে একবার তার বসকে ‘ভাইয়া’ তো আরেকবার ‘স্যার’ ডাইকা বসেন। হয় ভাইয়া নাহয় স্যার ডাকে বিগলিত হইয়া অবশেষে তার বস সেই কেস তাহাকেই কভার করিতে বলেন। এই দেখে ভাবিলাম নিজের বসের ওপর এই ট্রিক এপ্লাই করিয়া দেখা যাইতে পারে।

কেস জমিয়া উঠিয়াছে এর মাঝে, আমার গফ রাগী রাগী চোখে তখনও তার তাসকিনকে খোঁজ করিতেছে। হঠাৎ পুরো ঘটনা চলিয়া গেলো চট্টগ্রামে, আমার সামনের তিনটা ছোকরাকে দেখিলাম প্যান্টের গিট টাইট করিয়া নিতে। বুঝিলাম একটা আইটেম নাম্বার হবে এখন, তাহারই প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। কিন্তু আইটেম সং শুরু হইতেই দেখি সিনেপ্লেক্সের সবাই চুপচাপ বসিয়া আছে। ঐ তিন ছোকরা তা দেখিয়া কেবল তালিতেই সীমাবদ্ধ থাকিলো। গান শুনিয়া যা বুঝিলাম এই গানে না নাচা অপরাধের সামিল, তবে পাশে গফ থাকায় সেই অদম্য ইচ্ছা সেই দফায় প্রশমিত করা লাগিলো। কিন্তু চিটাগং এ বসিয়া (নাকি নাচিয়া?) কেন টিকাটুলির মোড়ে থাকা অভিসার হলের প্রচারণা চালানো হইতেছে, ইহা ঠিকমত বুঝিলাম না।

এরই মাঝে আসিলো সোয়াট লিডার আশফাক, তাকাইয়া দেখি এবিএম সুমন। এই সিনেমার কথাও তো বলেতেছিল গফ, সব তো দেখি একসাথেই। তাহইলে আমার গফ আসলে কারে চায়- শুভ, সুমন নাকি তাসকিন?

বিরতি আসিলো, তবু তাসকিন আসিলো না। গফ রক্তচক্ষু দ্বারা সম্ভব হইলে আমাকে যেন ঝলসাইয়াই দেয়। তাসকিন কেন আসেনাই, এই নিয়া আরও একবার আমার ওপর ঝাড়াঝাড়ি পর্ব চলিলো। বুঝিলাম না, আমি কি সিনেমার প্রোডিউসার না ডিরেক্টর যে তাসকিন এখনও আসে নাই কেন ইহা আমার দোষ! পপকর্ন লইয়া আবার মুভি শুরু করিতেই দেখি ভিলেনের আসি আসি ভাব। সবাই বুঝিয়া গেল তাসকিন ইজ কামিং। উইন্টার যেমন আসি আসি করিয়াও আসে না, তেমনি তাসকিনও আসি আসি করিয়া বারবার দাগা দিয়া যায়। তারপর যখন হঠাৎ তাসকিনের এন্ট্রি হয়, তখনই আমার গফের গগনবিদারী চিৎকার, মনে হইল পারিলে এখনই পর্দার ভিতর ঢুকিয়া তাসকিনকে বিবাহ করিয়া আমাকে তাহার ভবিষ্যৎ সন্তানের মামা বানাইয়া দিবে। তাহার চিৎকার থামাইতে যাইয়া মনে হইল আরও দুইটা চুল টুপ করিয়া টাক হইতে খসিয়া পড়িল। আমার মাথায় চিন্তা অবশ্য তখন একখানাই, এই তাসকিন তবে বাংলাদেশের বোলার তাসকিন নহে? আমি তো শুনিয়া ভাবিয়াছিলাম...

খেলোয়াড় তাসকিন নয়, অভিনেতা তাসকিনের অভিনয় দেখিয়া মনে হইতেছিল যে দেশে এখন ভালো ভালো অভিনেতারা আসিতেছে, এরই মাঝে সিঙ্গাড়ায় এলাচ হিসেবে আবারও মাহিয়া মাহির আগমন। এরপর তিনি যা করিলেন তা ঐতিহাসিক, মনে পড়িয়া গেল অনন্ত জলিলের হোয়াটিজ লাভের সেই মুহূর্তগুলো। সিরিয়াস অপারেশনে শুভকে বারবার যাইতে বাঁধা দিয়াই যাচ্ছিলেন মাহি, তার একটাই কথা তাকে প্রমিস করিতে হইবে যে শুভ ঠিকঠাকভাবে তার কাছে ফিরিয়া আসিবেন। আমি বুঝিয়া পাইলাম না, বোম কি তবে নায়কের প্রেমিকার প্রমিসের কথা শুনিয়াই ডিফিউজ হইয়া যাইবে! মনে হইতেছিল শুভ বলিবেন প্রমিস আর সেই প্রমিস বলার শব্দতরঙ্গ বাতাসে বহিয়া বোমের সার্কিটে গন্ডগোল লাগাইয়া বোম ডিফিউজ করিয়া দিবে। সেখানেই শেষ নয়, শুভ যেখানে যান মাহি তার সঙ্গে উঠিয়া পড়েন। তার একটাই কথা, যেই ঐতিহাসিক কথা রাজ্জাক শাবানাকে, ইলিয়ান কাঞ্চন চম্পাকে, সালমান শাহ্‌মৌসুমিকে, শাকিব খান অপু বিশ্বাসকে বলিতে বলিতে এবং দর্শক শুনিতে শুনিতে ক্লান্ত। সেই কথাখানা হইল- বাঁচলে একসাথে বাঁচবো, মরলে একসাথে মরবো। ওকে ফাইন, তিনি মরিয়া হইলেও যদি তখন সিনেমা থেকে সরিতেন, তালির অভাব হইতো না। আমার গফও তালি দিতো সমানতালে।

মুভি শেষ হইলো। শেষ হইতেই অনুভূতি পাইলাম- এই যে আসতে যাইতে পুলিশকে গালি দেই, মন্দ বলি, অথচ তাদেরও যে জীবন আছে, পরিবার আছে, স্যাক্রিফাইস আছে এগুলার কথা তখন চিন্তা করি না। পুলিশের অপারেশনগুলো জনসাধারণের জন্য অজানা থাকিয়া গেলেও সে সব অপারেশনে কতো পুলিশ যে দেশের জন্য জীবন দিয়ে যান সেটা আমরা টের পাই না। গফের তাসকিন অ্যাটাক চলতে চলতেই আমি গাড়িতে না উঠিয়া একা হাঁটা শুরু করি। সামনে এক পুলিশ সদস্য পড়তেই তাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলাম- থ্যাংক ইউ। ঢাকায় আসিয়া টাক পড়ুক, অথবা ঢাকায় অ্যাটাক পড়ুক, এই একটা ভালো কাজ করিতে পারিয়া মুহূর্তেই মনটা আনন্দে ভরিয়া গেল।

২৭৮১ পঠিত ... ১১:৫৯, অক্টোবর ১৮, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top