অকৃত্রিম অদ্বিতীয় ছফা ভাইর সঙ্গে আমার যতো খুনসুটি

১৯৭২ পঠিত ... ১৭:৪৯, জুলাই ৩০, ২০১৯

আহমদ ছফা ছিলেন একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কবি ও পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক নানান কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সহজাত রসবোধের পরিচয় ছফার সাহিত্যে প্রবল। তবে শুধু সাহিত্যেই নয় তার দৈনন্দিন যাপনেও এই রসবোধ প্রকাশ পেয়েছে সবসময়। পাশাপাশি সমসাময়িক বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যাপারেও তিনি সবসময় ছিলেন সরব। ‘ঠোঁটকাটা’ হিসেবেও সমসাময়িকদের মধ্যে তার ‘খ্যাতি’ ছিল। আহমদ ছফা কখন কাকে নিয়ে কী বলে ফেলেন, সেসব নিয়ে তৎকালের বুদ্ধিজীবী-সাহিত্যিক মহলে বেশ আলোড়ন কাজ করত।

স্পষ্টভাষী ও সব বিষয় নিয়েই ভিন্নভাবে ভাবতে পারার ক্ষমতাসম্পন্ন এই মানুষটির সান্নিধ্য পেয়েছেন সংস্কৃতি ও সাহিত্য অঙ্গনের তরুণেরা। তেমনই ছফাকে কাছ থেকে দেখেছেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ছড়াকার লুৎফর রহমান লিটন। আশির দশকে যখন তরুণ লুৎফর রহমান রিটন উঠতি ছড়াকার ও প্রকাশক, তখন আহমদ ছফার সাথে ছিল তার অম্লমধুর সম্পর্ক। সেসব দিন নিয়েই স্মৃতিচারণা করেছেন ছড়াকার রিটন। এতে আহমদ ছফার সাথে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি উঠে এসেছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথাও। eআরকির পাঠকদের জন্য আজ থাকছে ‘পাগলাটে’ আহমদ ছফাকে নিয়ে এই বর্ণিল স্মৃতিচারণাটি।

 

‘ফাকিরকে পেলে আমি খুন কার্বো’ বললেন আহমদ ছফা। 

আসলে ছফা ভাইকে রাগিয়ে দিতে আমিই উদ্যোগী হয়ে বলেছিলাম, ‘ফকির আলমগীরের গাওয়া ‘ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না’ গানটা তো অসাধারণ! কী চমৎকার গেয়েছেন! কিন্তু বিখ্যাত এই গানের কথা যে আপনার লেখা সেইটা তো ফকির আলমগীর বলেন না কখনো!’

আমার জানা ছিলো এই প্রসঙ্গটা উত্থাপন করেই দ্রুত রাগানো সম্ভব ছফা ভাইকে। সেই বিকেলে বাংলামোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাগোয়া বিল্ডিং-এ ছফা ভাইয়ের সঙ্গে একটা জম্পেশ আড্ডার উদ্দেশ্যেই গিয়েছিলাম আমি। বিকেলটা মনমরা ছিলো। কোনো কিছুতেই আনন্দ পাচ্ছিলাম না। অথচ আনন্দ ছাড়া আমি থাকতে পারি না। কিছু আনন্দ সংগ্রহ করতেই ছিলো আমার সেই ছফাযাত্রা। তাঁর ঘরে আমাকে স্বাগত জানিয়ে বসতে দিতেই ফকির সম্পর্কিত বিষয়টা পাড়লাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই ফুঁসে উঠলেন ছফা ভাই তাঁর চিরাচরিত একসেন্টে—‘ফাকিরকে পেলে আমি খুন কার্বো’! 

ইনোসেন্ট একটা চেহারা নিয়ে খুব সরল একটা প্যারালাল প্রশ্ন করি আমি, 

- কেনো ছফা ভাই, খুন করবেন কেনো? গীতিকার হিশেবে নাম বলে না সেই জন্যে? 

(পাঠক এখন থেকে ছফা ভাইয়ের সংলাপগুলো আমি প্রমিত বাংলায় লিখবো) 

- না, শুধু সেই জন্যে না। ওকে আমি খুন করবো আমার গানের সুর বিকৃত করার অপরাধে।

- বলেন কী? ব্যাটা সুরও বিকৃত করেছে নাকি?

- করেছে। কী চমৎকার একটা সুর দিয়েছিলাম আমি এই গানটায়। আর তোমাদের ফকির বারোটা বাজিয়েছে সেই সুরের। নিজের মতো করে গাইছে। ব্যাটা বদমাশ। 

- তার মানে অরিজিনাল সুর এটা নয় যেটা আমরা জানি!

- অরিজিনাল সুর আরো অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী। তোমাকে শোনাই।

বলতে বলতে হারমোনিয়াম বের করলেন তিনি। হারমোনিয়ামটা বিছানার ওপর রেখে বিছানায় বসে ওস্তাদী কায়দায় রিডে কিছুক্ষণ আঙুল চালিয়ে প্রাণপণে গেয়ে উঠলেন ছফা ভাই—ঘার কার্লামনারে আমি সাংসার কার্লামনা...

আঁতকে উঠলাম আমি রীতিমতো। হারমোনিয়াম বাজছে একদিকে আর ছফা ভাইয়ের কণ্ঠ যাচ্ছে আরেক দিকে। কিন্তু ছফা ভাইয়ের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সেদিকে। সে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। প্রাণপণে গাইছেন বলে দুদিক থেকেই ছফা ভাইয়ের গলার রগ উঠেছে ফুলে! গানের মাঝখানে তাঁকে থামানোর কোনো উপায় নেই। (অরিজিনাল সুরটার ধারে কাছে থাকেন নি বলে ফকির আলমগীরকে জড়িয়ে ধরে বিশাল একটা হাগ দিতে ইচ্ছা করলো।) টানা তিন চার মিনিট ধরে চললো ছফা ভাইয়ের ভয়াবহ সঙ্গীত পরিবেশনা। গান শেষে তিনি জানতে চাইলেন কেমন ছিলো সুরটা। আমি বললাম, এক্সেলেন্ট।

ছফা ভাইয়ের ব্যালকনি টাইপের বারান্দাটা খুব সুন্দর। বেশ কিছু ফুলের টব সেখানে সাজানো। এই ব্যালকনিতে ছফা ভাই তাঁর কাক বন্ধুদের আপ্যায়ন করেন। কাকরা দলবেঁধে আসে ছফার কাছে। ছফা ওদের খেতে দেন। গাছেদের সঙ্গে পাখিদের সঙ্গে আহমদ ছফার বন্ধুত্বের কাহিনী আমাদের জানা ছিলো। প্রাণিদের প্রতি ছফার মমতাটা ছিলো খুবই আন্তরিক। ব্যক্তিজীবনে এবং লেখার জগতেও বৃক্ষ-লতা পশু-পাখির প্রতি তাঁর দরদ প্রতিফলিত হয়েছে। আমার সঙ্গে খুব মাখামাখি ধরনের ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও খুবই পছন্দের মানুষ ছিলেন তিনি, আমার। ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিলো খোঁচাখুঁচির। তাঁকে খুঁচিয়ে আমি মজা পেতাম।

কী এক অজানা কারণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে অপছন্দ করতেন ছফা ভাই। আমাকে বললেন, ‘তুমি তো হযরত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের চ্যালা।’

আমি বললাম, ‘জ্বি ছফা ভাই। খালি চ্যালা না। মহাচ্যালা। আপনি যে স্যারকে দেখতে পারেন না সেইটা স্যারও জানেন। স্যার কিন্তু (বানিয়ে বানিয়ে বললাম) আপনাকে খুব পছন্দ করেন। আপনার সম্পর্কে অনেক উত্তম উত্তম বাক্য বলেন তিনি।’

- বানোয়াট কথা বলছো তুমি। সায়ীদ সাহেব আমার সম্পর্কে উত্তম উত্তম বাক্য বলতেই পারেন না। কারণ উত্তম বাক্য কী বস্তু তোমাদের হযরত সেইটা জানেনই না। টেলিভিশনের সস্তা একজন এন্টারটেইনার তোমাদের হযরত!

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং সায়ীদ স্যার সম্পর্কে তাঁর অপছন্দের একটা নমুনা পেশ করি। এক বিকেলে ঢাকার বাইরে থেকে এক ভদ্রলোক জীবনে প্রথম আসছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। বাংলামোটরের গলিতে ঢুকে কেন্দ্র অভিমুখে সঠিক পথেই এগোচ্ছিলেন তিনি। কেন্দ্রে ঢোকার খানিক আগেই তিনি দেখেন বিখ্যাত আহমদ ছফা আসছেন হেঁটে হেঁটে। কেন্দ্র দর্শন করতে আসা ভদ্রলোক ছফা দর্শনে বিমুগ্ধ হয়ে গেলেন। কুশল ইত্যাদির পর ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা এখানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রটা কোথায়?’ ‘আমি জানি না’ বলে ফের হাঁটা ধরেছিলেন ছফা ভাই বাংলামোটর অভিমুখে। অতঃপর মাত্র দশবারো কদম এগিয়েই ভদ্রলোক আবিস্কার করেছিলেন কেন্দ্রের মূল ফটক। সেই ভদ্রলোক খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন ছফা ভাইয়ের এই অদ্ভুত আচরণে। আমি আর স্যার বসেছিলাম কেন্দ্রের আম্রকুঞ্জের নিচে ছোট্ট লবিতে। ভদ্রলোকের কাছে ঘটনা শুনে উচ্চ কণ্ঠে হেসে উঠেছিলেন সায়ীদ স্যার, ‘ছফা ভাই লোক ভালো কিন্তু কী এক কারণে তিনি আমাকে সহ্যই করতে পারেন না। অই যে দেখেন কেন্দ্রের পরের বিল্ডিংটা ওখানেই থাকেন আহমদ ছফা।’ শুনে মফস্বল শহরের সরল সাদাদিধে অধ্যাপক লোকটার চেহারাটা মলিন হয়ে গিয়েছিলো। শহরের বিখ্যাত মানুষদের জটিল মনস্তত্ব বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। সায়ীদ স্যার প্রসঙ্গ পালটে দ্রুত লোকটাকে হাস্যোজ্জ্বল করে তুলেছিলেন অপরূপ দক্ষতায়।

তরুণদের ছফা ভালোবাসতেন। তরুণদের প্রতি উপদেশ বিতরণে তিনি ছিলেন অকৃপণ। তবে,পারতপক্ষে আমাকে উপদেশ দিতেন না তিনি। কারণ, ঠোঁটকাটা হিশেবে আমারও খানিক সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি ছিলো। কিন্তু চিরকালের অভ্যাস বলে কথা। একদিন বেমক্কা আমাকেও দিয়ে বসলেন উপদেশ। তাঁর ‘উত্থানপর্ব’ কার্যালয়ে এক বিকেলে প্রবেশ করেই দেখি তিনি এক তরুণ কবিবন্ধুকে পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘সময়ের সন্তান না হয়ে সময়ের পিতা হও।’ বুঝে হোক না বুঝে হোক আমার সেই কবিবন্ধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়াচ্ছিলেন। সেই কবির পাশে বসেই আমি ছফা ভাইয়ের কথার বিরোধিতা শুরু করলাম, ‘ছফা ভাই কেনো আপনি আমার এই বন্ধুটির সর্বনাশ করতে চাইছেন! আপনার কথামতো সময়ের পিতা হতে গেলে তো এই লোকটা না খেয়ে মরবে। পরিবার পরিজন নিয়ে পথে বসবে। কোথাও একটা চাকরি পাবে না। একটা ব্যবসা পাবে না। সময়ের পিতা হতে গিয়ে ওর নিজের ‘পিতা হওয়ার’ খায়েসটাও মিটে যাবে। বউবাচ্চা নিয়ে পথে পথে ঘুরবে। হয়তো আপনার কাছেও আসবে সাহায্য চাইতে। আপনি ওকে একদিন দুদিন সাহায্য করবেন ঠিকই কিন্তু এক পর্যায়ে আপনিই ওকে এভয়েড করা শুরু করবেন। ওর উৎপাতে শহরের সমস্ত পরিচিতজনরা অস্থির হয়ে উঠবে। সময়ের পিতা হওয়ার সময়টা ওর এখনো আসেনি ছফা ভাই। আগে সময় হোক, তারপর সে চেষ্টা করবে সময়ের পিতা হওয়ার।’

আমার ওপর মহাবিরক্ত ছফা ভাই তাঁর মহাক্ষিপ্ত চেহারাটা লুকানোর চেষ্টা না করেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে আপনিই বলুন হযরত, কখন আসবে তাঁর সেই সময়?’

- যেদিন ওর নিজের একটা এঞ্জিও থাকবে। যেদিন লিবিয়া বা জার্মানি বা সৌদি বা নিদেনপক্ষে ইন্ডিয়ান হাইকমিশন থেকে ওকে ফান্ড বরাদ্দ করা হবে। টাকা পয়াসার দুশ্চিন্তা থেকে যেদিন সে মুক্ত হবে সেদিনই সে রুখে দাঁড়াবে সময়ের পিতা হবার জন্যে। 

আমার কথায় বিক্ষুব্ধ ছফা ভাই বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লেন উত্তেজনায়। সম্ভাব্য ফাইটিং আশঙ্কায় মানে মানে সটকে পড়লেন তরুণ সেই কবিবন্ধুটি। ছফা ভাই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর ব্যতিক্রমী পেপারওয়েটের দিকে মনোযোগী হয়ে সেটাকে হাতের মুঠোয় পাঁচ আঙুলের গোল চক্করে ঘোরাতে লাগলেন অবিরাম। আমি অপেক্ষা করছি কখন তিনি আমাকে তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে বলবেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড! তিনি তা বললেন না। পরিস্থিতি গুবলেট হয়ে গেছে বিবেচনা করে আমি নিজেই প্রস্থানে উদ্যত হলাম। আমি দরোজা অতিক্রম করার ঠিক আগের মুহূর্তে ছফা ভাই আমাকে উপদেশটা দিলেন, ‘শোনো, তুমি রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ পড়ো।’ 

দরোজা থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে খুবই শান্ত উচ্চারণে আমি বললাম, ‘উহ্‌ ছফা ভাই, মূর্খ তরুণ অনুচরদের সঙ্গে মিশতে মিশতে আপনি ডাল হয়ে যাচ্ছেন। কাকে কী উপদেশ দিতে হবে সেটাও ঠাহর করতে পারছেন না। আপনার কেনো মনে হলো ‘গল্পগুচ্ছ’ আমার পড়া নেই! আমি বরং বলি—আপনিই পড়েন ‘গল্পগুচ্ছ’। তারপর আমার সঙ্গে সেটা নিয়ে আলোচনায় বসেন।’ 

আমার ঠাণ্ডা আক্রমনে হেসে ওঠেন ছফা ভাই। শিশুর সারল্যমাখা এবং বিপুল দুষ্টুমিভরা বিখ্যাত সেই হাসি, ‘ঠিক আছে তোমার সঙ্গে বসবো একদিন ‘গল্পগুচ্ছ’ নিয়ে। আজ এখানেই সমাপ্তি। ঠিকাছে?’ 

এরপর আমরা মুখোমুখি বসেছি বহুবার কিন্তু ‘গল্পগুচ্ছ’ নিয়ে আলাদা করে বসা হয়নি আর। 

 

২. 

আজিজ মার্কেটের তিনতলার একটি কক্ষ আমি ‘ছোটদের কাগজ’র জন্যে ভাড়া নিলাম। মার্কেটের মাঝখান দিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়ি ব্যবহার করতে গেলেই দোতলায় টার্ন নেয়ার মুখেই ছফা ভাইয়ের ‘উত্থান পর্ব’র কার্যালয়। প্রায় রোজই দেখা হয় ছফা ভাইয়ের সঙ্গে। মাঝে মধ্যে তাঁর আমন্ত্রণে ভেতরে গিয়ে বসি। রঙ চা পান করতে করতে নানান বিষয়ে গল্প করি। আমি যে ছফা ভাইয়ের বই পড়ি বা পড়েছি সেটা ছফা ভাইকে বুঝতে দিইনা। তিনি আমাকে তাঁর লেখা নানান বই পড়তে বলেন। বাঙালি মুসলমানের মন, যদ্যপি আমার গুরু, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, ওঙ্কার, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী। আমি না সূচক মাথা নাড়ি—একটাও পড়িনি। তিনি হতাশ হন। তাঁর মতোন একজন বিশাল মানুষকে হতাশ করতে পেরে অহেতুক আনন্দে বিগলিত হই আমি। কিন্তু ছফা ভাই হাল ছাড়েন না। অন্য আরেকদিন তিনি একই কায়দায় তাঁর ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ বইটা পড়েছি কিনা জানতে চাইলে না সূচক মাথা নেড়ে আমি পালটা জিজ্ঞেস করি, ‘ছফা ভাই আপনি আমার ‘ছড়াসমস্ত’ বইটা পড়েছেন?’ আসলে আমার প্রশ্নটা ছিলো একটা ফাঁদ। ছফা ভাই সেই ফাঁদে ধরা দিলেন, ‘না পড়িনি। পড়বো কি তুমি তো ওটা আমাকে দাওনি।’ নির্বিকার আমি বললাম, ‘আপনিও তো আমাকে ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ দেননি।’

- প্রকাশক তো আমাকে লেখক কপি হিশেবে মাত্র পঁচিশটা কপি দেয়। ওখান থেকে তোমাকে কী করে দেই?

- প্রকাশক তো ছফা ভাই আমাকেও মাত্র পঁচিশটা কপিই দেয়। ওখান থেকে আপনাকে কী করে দেই?

আমার কথার প্যাঁচে পড়ে শিশুর মতোন অপরূপ সারল্যভরা হাসিতে চোখ নাচালেন ছফা ভাই, ‘আমার পাপ হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’

অনেক কষ্টে হাসি গোপন করে আমিও বলি, ‘সেই একই পাপ আমারো হয়েছে ছফা ভাই। আমাকেও আপনি ক্ষমা করে দেন।’

পরস্পরকে বই উপহার না দেয়ার অপরাধে কল্পিত অপরাধী আমরা দুজন দুজনার কাছে অকপটে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আহা ছফা ভাই, এই জীবনে আপনাকে বলাই হলো না কতোটা পছন্দ করতাম আমি আপনাকে। আপনার পাণ্ডিত্য আর পাগলামিতে কতোটা বিমুগ্ধ ছিলাম আমি। সমাজের খ্যাতিমান সমস্ত বিশিষ্টজনদের রীতিমতো দৌড়ের ওপর রাখতেন আপনি। আর আপনাকে দৌড়ের ওপর না হোক, খানিকটা আউলাঝাউলা রাখার মহান একটা দায়িত্ব আমি স্বপ্রণোদিত হয়েই আপন স্কন্ধে অর্পণ করেছিলাম। এটা ছিলো আমার এক নির্দোষ ফান। আপনাকে ব্যতিব্যস্ত এবং বিচলিত রাখাই ছিলো আমার কাজ। কিন্তু কোনোদিন আপনার সঙ্গে বেয়াদবি করিনি। তর্ক আর বেয়াদবি যে এক জিনিস নয় সেটা আপনার মতো আধুনিক মানুষকে আলাদা করে বুঝিয়ে বলতে হয়নি। আমার তর্ক করার অধিকারকে আপনি কখনোই অসম্মান করেননি। আমার ‘ছোটদের কাগজ’ পত্রিকাটা যাতে বন্ধ না হয় সে ব্যাপারে আপনার ছিলো অকুণ্ঠ উচ্ছ্বাস। বেশ কয়েকবার লিখেওছিলেন ছোটদের কাগজে। নতুন একটি ছড়া লিখে আপনার মতো মহাত্মন সবার আগে খোঁজ করতেন আপনার আপাত চিরবিরোধী আমাকেই। আপনার নতুন একটা ছড়া ছাপতে পারার আনন্দে আমি মশগুল থাকতাম যেদিন, সেদিন কোনোই ঝগড়া হতো না আপনার সঙ্গে। কিন্তু পরের সংখ্যাতেই খোঁচাখুঁচি বলবৎ থাকতো। ছোটদের কাগজের চিঠিপত্র বিভাগ ‘ভালোলাগা মন্দলাগা’য় আমাদের মৃদুল আহমেদ নামের ভয়াবহ পাঠক বন্ধুটি হামলে পড়তো নির্দয় ভয়ংকর ঠোকাঠুকি সমেত। এক সংখ্যায় আপনার ছড়া ছাপা হলো। পড়ে দুলাল বললেন, ‘ছফা ভাইয়ের ছড়ায় তো ছন্দ মাত্রা ভুল।’ আমি বললাম, ‘ভুলগুলো কী কী সেটা ধরিয়ে দিয়ে একটা চিঠি লেখেন। ‘ভালোলাগা মন্দলাগা’য় মৃদুলের আশেপাশে ছাপাই।’ দুলাল লিখলেন—‘ছফার দফারফা’। লেখাটা দুলালের হলেও শিরোনামটা ছিলো আমার। দফারফা সংখ্যাটা প্রকাশিত হবার পর সেই বিষয়ে কোনোরকম উচ্ছ্বাস বা উষ্মা কোনোটাই প্রকাশ করেন নি আপনি। না দুলালের কাছে না আমার কাছে।

মনে পড়ে, ছফা ভাই, কবি শামসুর রাহমানকে তাঁর বাড়িতে ড্রইংরুমে আক্রমন করলো হরকাতুল জিহাদ নামের একটি ধর্মান্ধ সংগঠনের এক উন্মাদ কর্মী। পত্রিকায় ফলাও করে সেই খবর ছাপা হলো পরদিন। সারাদেশে তুমুল আলোড়ন। সেই দুপুরে আমি আমার ছোটদের কাগজ অফিসে যাচ্ছি। আজিজ মার্কেটের দোতলার সিঁড়ি টপকে ডানে মোড় নিতেই দেখা আপনার সঙ্গে। উত্থানপর্বের দরোজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আপনি। আমার সঙ্গে ছিলো প্রীতিভাজন ওয়াসিফ-এ-খোদা, শামসুর রাহমানের ভক্ত-সৈনিক। আমাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন আপনি, ‘তোমাদের শামসুর রাহমানের গল্পটা যদি সত্যি হয় তবে আমি দুঃখিত।’ 

শুনে আমি থমকে দাঁড়াই, ‘কী বললেন ছফা ভাই?’

- বললাম, তোমাদের শামসুর রাহমানের গল্পটা যদি সত্যি হয় তবে আমি দুঃখিত। আর গল্পটা যদি মিথ্যা হয় তবে আমি আরো দুঃখিত। 

আপনার এইরকম সংলাপে আমি খুবই আমোদিত হলেও শামসুর রাহমানের অন্ধ ভক্ত আমার সঙ্গী ওয়াসিফ দেখলাম উত্তেজনায় কাঁপছে রীতিমতো। আমি বললাম, ‘ছফা ভাই আমি কিন্তু শামসুর রাহমানকে এই আপনার এই ডায়ালগ হুবহু ডেলিভারি দেবো।’ আপনি বলেছিলেন, ‘দিও। আর হযরতের প্রতিক্রিয়াটাও আমাকে জানিয়ে দিও দয়া করে।’

তিন তলায় আমার অফিস ছোটদের কাগজে এসে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত ওয়াসিফ বেদনায় ছটফট করতে করতে আমার সঙ্গ ত্যাগ করতে উদ্যত হলো, ‘রিটন ভাই আপনি একটুও প্রতিবাদ করলেন না! আশ্চর্য! আমি গেলাম। আমি মানতে পারছিনা। আমি ভাবতেই পারছি না আপনি এরকম একটা কথার প্রতিবাদ না করেই চলে এসেছেন।’ 

কপট রাগে ওয়াসিফের ওপর উলটো ফাঁপড় দিলাম, ‘অই মিয়া আমি কি তোমার মতো শামসুর রাহমানের চ্যালা নাকি! আমি কি শামসুর রাহমানের দায়িত্ব নিয়েছি নাকি! তুমি প্রতিবাদ করলে না কেনো?’ 

আমার নিষ্ঠুর উচ্চারণ সরলস্নিগ্ধ তরুণ ওয়াসিফকে হতাশার অকুল দরিয়ায় নিক্ষেপ করলো। একবুক হতাশা নিয়ে ওয়াসিফ চলে গেলো।

এর কিছুদিন পর কলামিস্ট মহিউদ্দিন আহমেদের বাড়িতে সান্ধ্যকালীন পানাহার পার্টিতে কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার দেখা হলো। অনেকের সঙ্গে পার্টিতে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যারও আছেন। শামসুর রাহমানের পাশের আসনটিতেই বসেছিলাম আমি। এক পর্যায়ে চোখে গ্লুকোমা আক্রান্ত কবি পকেট থেকে খুদে একটা ড্রপ কন্টেইনার বের করে আমার হাতে দিলেন। আমি তাঁর চোখে দুফোঁটা অষুধ ঢেলে দিলাম। কবি কষে চোখ বন্ধ করে রইলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি কথাটা পাড়লাম, ‘রাহমান ভাই, ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আপনার কাহিনি কী!’ চোখ বন্ধ অবস্থাতেই পালটা প্রশ্ন ছূঁড়ে দিলেন শামসুর রাহমান, 

- কেনো! বলুন তো কেনো জিজ্ঞেস করছেন এটা?

- আপনার ওপর হামলার ঘটনার পর সেদিন ছফা ভাই বলছিলেন, ‘তোমাদের শামসুর রাহমানের গল্পটা যদি সত্যি হয় তবে আমি দুঃখিত। আর গল্পটা যদি মিথ্যা হয় তবে আমি আরো দুঃখিত।’

দুই চোখ বন্ধ রেখেই মুখটা ঘরের ছাদের দিকে আরেকটু উঁচিয়ে শামসুর রাহমান বললেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা!’ 

আমি জীবনে কখনোই শামসুর রাহমানকে গালি দিতে শুনিনি। তাঁর বরাহশাবকসম্বন্ধীয় গালিটা দ্বিতীয়বার শুনে কনফার্মড হবার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বললেন রাহমান ভাই? কাকে বললেন?’ 

চোখ বন্ধ অবস্থাতেই শামসুর রাহমান বললেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা বললাম। ছফাকে বললাম।’ বলেই পিটপিট করে তাকালেন তিনি আমার দিকে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চোখ খুলে ফেলেছেন বলে কিছুক্ষণ আগে দেয়া দু’ফোঁটা অষুধ জল হয়ে গড়িয়ে পড়লো। 

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমি কিন্তু বলে দেবো ছফা ভাইকে যে আপনি তাঁকে শুয়োরের বাচ্চা বলেছেন।’

- বলবেন। অবশ্যই বলবেন।

কিন্তু না। আমি এটা বলিনি ছফা ভাইকে। শুধু ওয়াসিফকে বলেছিলাম। কী যে খুশি হয়েছিলো ওয়াসিফ! ওয়াসিফের বাইরে শুধু একজনই সেই গালির ঘটনা জানতেন। তিনি মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সেই সন্ধ্যায়, মহিউদ্দীন ভাইয়ের বাড়িতে আমাদের পাশে বসা মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার আমাদের দু’জনার বাৎচিত খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন আর হাসছিলেন মিটিমিটি।

অন্যকে আক্রমণের ক্ষেত্রে তীব্র আর প্রচণ্ড ছিলেন ছফা ভাই। বাংলা একাডেমি প্রেসের ইনচার্য ছিলেন ওবায়দুল ইসলাম। একসময় প্রচুর আড্ডা দিতাম ওবায়েদ ভাইয়ের কক্ষে। ওখানে প্রতিদিন খ্যাতিমান লেখক অধ্যাপকদের আগমন ঘটতো। এক দুপুরের আড্ডায় আমাদের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতিভাবান দুই কীর্তিমান পুরুষ হুমায়ুন আজাদ এবং আহমদ ছফাও উপস্থিত আছেন। নানান বিষয়ে কথা এবং তর্ক হচ্ছে। এক পর্যায়ে হুমায়ুন আজাদ বেমক্কা আহমদ ছফাকে কথার ছুরিতে বিদ্ধ করলেন। ছফা ভাইও পালটা আক্রমনে ক্ষতবিক্ষত করলেন হুমায়ুন আজাদকে। টানটান উত্তেজনা কক্ষটায়। আমরা সবাই দর্শকের ভূমিকায়। এক পর্যায়ে ওবায়দুল ইসলামের মধ্যস্থতায় দুজনার ঝগড়ার পরিসমাপ্তি ঘটলো। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু শেষ হইয়াও হইলো না শেষ! কিছুক্ষণ নিস্তরঙ্গ শুনশান নিরবতার পর ছফা ভাই হুমায়ুন আজাদকে তাঁর সেই চিরকালের অস্থির এক্সেন্টে বললেন, ‘হুমায়ুন, আপনার স্ত্রীকে পেলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।’ হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘কী কথা?’ ছফা ভাই বললেন, ‘আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম আপনার মতো একটা পশুর সঙ্গে তিনি ঘর করেন কী করে!’ 

অতঃপর দুজনার হাতাহাতির উপক্রম। ওবায়েদ ভাই সামাল দিলেন হুমায়ুন আজাদকে আর আমি ছফা ভাইকে নিয়ে সটকে পড়লাম দ্রুত, সেই কক্ষ থেকে।

ছফা ভাইয়ের রসিকতাও ছিলো মারাত্মক রকমের উচ্চতাসম্পন্ন, রীতিমতো ক্লাসিক। আজিজ মার্কেটের তিন তলায় কবি দুলালের একটা অফিস ছিলো। নিউইয়র্ক থেকে কবি শামস আল মমিন এসেছেন। একদিন ছফা ভাই একটা খামে আমার জন্যে, দুলালের জন্যে এবং শামস আল মমিনের জন্যে তিনটি চিঠি পাঠালেন তাঁর পিওন মারফত। এক খামে তিন চিঠি। খামের ওপর আমাদের তিনজনের নামই ভুল লিখেছেন ছফা ভাই। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালকে লিখেছেন সাইফুল্লা মো দুলাল। লুৎফর রহমান রিটনকে লিখেছেন লুৎফর রহমান লিটন। এবং শামস আল মমিনকে লিখেছেন শামসুল মোমিন। পরদিন সকালে দুলাল আমাকে চিঠিটা দেখালেন। আমি দুলালকে বললাম, ‘এখন আমাদের উচিৎ ছফা ভাইয়ের নামের বানান আহমদ ছফার জায়গায় ‘আহমদ ছপা’ লিখে একটা চিঠি তাঁকে পাঠানো।’ দুলাল একটা চিঠি কম্পোজ করিয়ে পিওনকে দিয়ে সেটা পাঠিয়ে দিলেন ছফা বরাবরে। ছফা ভাই অফিসে ছিলেন না, চিঠিটা তাই তাঁর টেবিলে রেখে এসেছে পিওন ছেলেটা। চিঠিতে দুলাল আমাদের তিনজনের নামের বানান ভুল করার বিষয়টি উল্লেখ করে জানতে চেয়েছেন—এখন আমরা যদি আপনাকে আহমদ ছফার জায়গায় আহমদ ছপা লিখি তাহলে কেমন লাগবে? 

পরদিন অফিসে এসেই ছফা ভাই চিঠিটা পেলেন এবং চিঠিটা পড়েই জরুরি ভিত্তিকে দুলালকে তলব করে পাঠালেন। এক্ষুণি যেতে হবে। এক্ষুণি। আমি তখনো অফিসে এসে পৌঁছুইনি। দুলাল পায়ে পায়ে উত্থানপর্বে প্রবেশ করা মাত্র নিজের ছফা ভাই তাঁর আসন থেকে উঠে দৌড়ে এসে হাঁটুমুড়ে দুলালের সামনে বসে পড়ে দুলালের পা দুটিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমার অনেক পাপ হয়েছে তোমাদের তিনজনের নামের বানান ভুল করেছি, আমাকে মার্জনা করো, এখন তোমাকে না হয় পাওয়া গেলো বাকি চারটা পা আমি কোথায় পাই?’ 

অনেক কষ্টে দুলাল সে যাত্রা ছফা ভাইয়ের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। এই কাহিনী শোনার পর থেকে আমি আজিজের পেছন দরোজা দিয়ে অফিসে আসি। উত্থানপর্বের সামনে পড়বো বলে দোতলার সিঁড়ি টপকাই না। ছফা ভাইয়ের সামনেও পড়ি না। কারণ আমি জানি ছফা ভাইয়ের সামনে পড়া মাত্রই তিনি আমাকে ঠেঁসে ধরবেন। মান সম্মান সব ধুলায় লুটিয়ে দেবেন। আমি আমার ‘দুই পা’ নিয়ে নিরাপদ দুরত্বে পালিয়ে বেড়াই। আমার ‘পা দুটি’কে কিছুতেই ছফা ভাইয়ের খপ্পরে পড়তে দেয়া যাবে না। এভাবে কতোদিন যে পালিয়ে ছিলাম ছফা ভাইয়ের দৃষ্টি থেকে! আহারে, ছেলেমানুষীতেও আপনি অনন্য এবং অদ্বিতীয় ছিলেন ছফা ভাই! 

 

৩. 

আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের কঠিন সমালোচক ছিলেন আহমদ ছফা। আওয়ামী লীগের জয়-পরাজয় নিয়ে ছফার একটা বাণী তো এখনও মুখে মুখে ফেরে। ১৯৯৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন জেতে তখন শেখ হাসিনা তথা কিছু মুষ্টিমেয় নেতা জেতেন। আর আওয়ামী লীগ যখন হারে গোটা বাংলাদেশ পরাজিত হয়।’ 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনীতির ঘোর বিরোধী ছিলেন ছফা। কিন্তু তিনি দলকানা বুদ্ধিজীবীদের মতো ছিলেন না বলেই শেখ মুজিবের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলতে পেরেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত-পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে। ... বস্তুত বাঙালী জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গীতাঞ্জলি নয়, বলাকা নয়, সোনার তরী নয়, “আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।” ... শেখ মুজিবুর রহমান এই জাতির মহান স্থপতি এবং একজন মহান পুরুষ। সমস্ত দোষত্রুটি, রাজনৈতিক প্রমাদ এবং সীমাবদ্ধতাসহ বিচার করলেও তিনি অনন্য। শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় শেখ মুজিবের ভূমিকা অস্বীকার করা মানুষদের সম্পর্কে ছফা তীব্র ও স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অভিযাত্রার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক না থাকার যে লজ্জা, যে গ্লানি, সেটুকু ঢাকার অপকৌশল হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে তারা অক্ষম।’

১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামের বিজয় মেলার স্মরণিকায় ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নামের প্রবন্ধের শেষাংশে আহমদ ছফা লিখেছিলেন- ‘আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়তো কোন পিতা তার পুত্রকে বলবেন, জানো খোকা, আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলন, যার দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্না রাতে রূপালি কিরণ ধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি এবং নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জানো খোকা, তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’

আমার পরম সৌভাগ্য আমি আমার সময়ে একজন আহমদ ছফাকে ছুঁয়ে দেয়া দুরত্বে অবলোকনের সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁর সাহচর্য পেয়েছিলাম। স্নেহ পেয়েছিলাম। রাষ্ট্র-সমাজ-সংস্কৃতি-মানুষ আর ইতিহাসকে ব্যাবচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে আশ্চর্য এক নির্মোহ সক্ষমতা ছিলো আহমদ ছফার। ছফা সব সময় এগিয়ে ছিলেন সময় থেকে।

৩০ জুন শিশুর সারল্যে আর মেধার লাবণ্যে অকৃত্রিম অদ্বিতীয় আহমদ ছফার জন্মদিন। 

হ্যাপি বার্থ ডে ছফা ভাই। 

 

[রচনাকাল: অটোয়া ৩০ জুন ২০১৪; সূত্র: স্মৃতির জোনাকিরা, প্রকাশক কথাপ্রকাশ, বইমেলা ২০১৫]

১৯৭২ পঠিত ... ১৭:৪৯, জুলাই ৩০, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top