চেতনাভস্কি কৌতুকভ: অথরিটারিয়ান স্টেটে রাজনৈতিক জোক

১০১৭৯ পঠিত ... ১৯:৪৪, জুন ১৬, ২০২০

গভীর রাত। হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ। বাড়ির লোকজন আতঙ্কিত। কে কোথায় লুকাবে এমন তাড়াহুড়া। কিছুক্ষণ পরে গৃহকর্তা ভয়ে ভয়ে দরজা খুললো। 

দরজায় বাড়িওয়ালা দাঁড়ানো। সে বললো, কমরেড, অযথা ভয় পাবেন না, আমি খালি বলতে আসছি বাড়িতে আগুন লাগছে। 

কেমন পরিস্থিতি হইলে বাড়িতে আগুন লাগাও আতঙ্কিত না হওয়ার মতো খবর হয়? এই সমাজের নাম কর্তৃত্ববাদী সমাজ। এইখানে আসল ভয়ের নাম রাষ্ট্র৷ এই ধরনের সমাজে পলিটিক্যাল জোকের কিছু নির্দিষ্ট ধরনের রমরমা দেখা যায়। তো, কর্তৃত্ববাদী বা অথরিটারিয়ান স্টেটে পলিটিক্যাল জোক কিভাবে কাজ করে সেই বিষয়ে আমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে। যেমন: 

রাষ্ট্র চরম অথরিটারিয়ান হয়ে উঠলে নিষ্পেষিত ও ভীতসন্ত্রস্থ জনগণ প্রতিবাদ ও সমালোচনার জন্যে কি রাজনৈতিক জোকের আশ্রয় নেয়?

অথরিটারিয়ান স্টেটে রাজনৈতিক জোকের স্বভাব-চরিত্রই বা কেমন?  

জোক কি আদৌ প্রতিবাদ হিসাবে কার্যকরী? অনেকে যে বলেন, 'এভ্রি জোক ইজ এ টাইনি রেভল্যুশন' সেই কথার যথার্থতা কতটুকু? 

এই পলিটিক্যাল কন্টেক্সটে জোক আসলে কী ধরণের ভূমিকা রাখে? 

অথরিটারিয়ান স্টেটই বা এই ধরণের জোকরে কেমন নজরে দেখে, বা কী করে? 

ইত্যাদি। 

এইসব প্রশ্নের পাশাপাশি আরও কিছু প্রশ্ন বোঝার চেষ্টা করবো এই লেখায়। তবে তার আগে বোঝা দরকার অথরিটারিয়ান স্টেট কী? কেমন এই স্টেটের স্বভাব-চরিত্র? 

২. 

অথরিটারিয়ান স্টেট 

সহজ ভাষায়, অথরিটারিয়ান স্টেটে গুটিকয়েক ব্যক্তি ও স্থানে কেন্দ্রিভূত ক্ষমতা থাকে, রাষ্ট্র এক পার্টির নিরঙ্কুশ ক্ষমতাচর্চা অনুমোদন করে, বেশিরভাগ সময় ওই পার্টি আর সরকারের মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ থাকে না। বিরোধীদল বা বিরোধীমত তো বটেই, সরকারি বয়ানের বাইরে যেকোন মতামতরে কঠোর হাতে দমন করা হয়। ফলে বাকস্বাধীনতা বা ব্যক্তিস্বাধীনতা বইলা কিছু থাকে না। এইগুলা নানামাত্রায় থাকে, তবে একটা বৈশিষ্ট্য সকল অথরিটারিয়ান স্টেটে কমন: আইডিওলজিকাল ভায়োলেন্স। যেকোন অথরিটারিয়ান স্টেটে নির্দিষ্ট আইডিওলজি বা মতাদর্শের বিগব্রাদারসুলভ ব্যাপার সর্বব্যাপী উপস্থিতি থাকে। আর সেই মতাদর্শের নামে চলে অজস্র সহিংসতা। একেক রাষ্ট্রে এই ভায়োলেন্সের আইডিওলজি একেক রকম চেহারা নিতে পারে—কোথাও কমিউনিজম বা সোশ্যালিজমের নামে, নির্দিষ্ট এথনিসিটির শ্রেষ্ঠত্বের নামে, কোথাও ধর্মের নামে কোথাও বা বিশেষ জাতীয়তাবাদী চেতনার নামে—কিন্তু ক্ষমতাচর্চার সহিংসতায় খুব বেশি উনিশ-বিশ হয় না।    

 

৩.
অথরিটারিয়ান স্টেটে রাজনৈতিক জোক

শোষণমূলক রেজিমের জোকে টেক্সটের চাইতে কনটেক্সট বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক জোক আছে যা ক্ষুদ্র গল্প। যেকোনো দেশে, যেকোনো সমাজে তা কমবেশি ফানি লাগবে। আবার অনেক জোক আছে যা এক সমাজে তুমুল মজার লাগলেও অন্য সমাজে লাগে না। কারণ এই জোকগুলা অনেক বেশি কনটেক্সট নির্ভর। রাজনৈতিক জোকও এমন। আপনাকে জোকে মজা পাইতে গেলে আগে কোন প্রেক্ষিতে বলা হইতেছে তা বুঝতে হবে। অথরিটারিয়ান রেজিমের রাজনৈতিক জোকে মজা পাইতে আপনাকে তাই বুঝতে হবে এই রেজিমের মানুষের জীবনযাপন। 

যেমন, পৃথিবীর যেকোনো অথরিটারিয়ান স্টেটে দুর্নীতি ও লুটপাটের সবচেয়ে বড় অংশটারে ধামাচাপা দেয়ার উপায় হিসেবে সেটাকে উন্নয়ন বলে চালানো হয়। ফলে উন্নয়ন বিষয়ক জোক এমন সমাজে কমন: 

বলশেভিক নেতা কালিনিনের কাছে গেছে এক চাষী। সে বললো, কমরেড দেশে আধুনিকায়নের গতি এতো ধীর কেন? কালিনিন চাষীরে তার জানালার কাছে নিয়া গেল। চলমান ট্রেনের দিকে ইশারা কইরা বললো, দেখো, এখনই যদি আমাদের ১ ডজন ট্রাম থাকে, ৫ বছর পরে আমাদের শত শত ট্রাম হবে। চাষী তার গ্রামে ফিরে গেছে। গ্রামের কমরেডরা তারে ঘিরে ধরলো। সে কী জাইনা আসছে? 

চাষী এদিক ওদিক তাকাইলো। দেখলো একটা গোরস্থান। বললো, ওইখানে ডজনখানেক কবর আছে, দেখতেছো না? পাঁচ বছর পরে ওইখানে হবে হাজার হাজার কবর।

অথরিটারিয়ান স্টেটের নানা প্রবণতার বা রিয়ালিটির প্রতিফলন ঘটে পলিটিকাল জোকে। যেমন ধরেন রাষ্ট্রীয় গুম-খুন গ্রেফতারের কিছু নজির পাইতে পারেন নিচের কয়েকটা জোকে।  

পনের বছর পর বাড়িতে ফিরছে এক লোক। বহুদিন পর দেখে তার বন্ধু জিগাইলো, কী মিয়া এতদিন কই ছিলা?
: জেলে ছিলাম। কোন অপরাধ না কইরাই ১৫ বছর জেলে কাটাইতে হইলো।
: হে হে। মিথ্যা বলার আর জায়গা পাও না? কিছু না করলে হয় মাত্র দশ বছরের জেল।    

কিংবা

কী! ইভান ইভানোভিচ মারা গেছে? কই আমি তো তার গ্রেফতার হওয়ার খবরটা পর্যন্ত পাই নাই। 

ব্যক্তি বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ঘাটতি নিয়া সোভিয়েত রাশিয়া, নাৎসি জার্মানি বা ফ্রাঙ্কোর স্পেনে অজস্র রাজনৈতিক জোক আছে। জার্মানিতে হিটলারের আমলে এই জোকটা ব্যাপক পপুলার ছিলো: 

: কি রে তুই নাকি ডেন্টিস্ট্রি পড়া ছেড়ে দিছস?
: কি আর হবে। ডেন্টিস্ট্রি করবো কেমনে? কেউ যে মুখই খুলতে চায় না।

সোভিয়েত আমলে নিচের জোকটা চালু ছিলো। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক অধ্যাপক লেকচার দিতেছেন:
: মাংসের উৎপাদনে আমাদের দেশের সাফল্য ঈর্ষনীয়।
[দর্শকশ্রোতাদের মধ্যে থেকে চাইমোভিচের কন্ঠ] : সেই মাংস কোথায়?
: দুধ উৎপাদনেও আমরা অত্যন্ত সফল।
[চাইমোভিচের কণ্ঠ আবার ]: কোথায় সেই দুধ? 

 এরপর সংক্ষিপ্ত নীরবতা। অধ্যাপক বললেন,
: ওকে। আর কারও কোনো প্রশ্ন?
[দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে ]: ইয়েস। কিন্তু চাইমোভিচ কই গেল? 

স্টেটে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলে যেমন বোঝা যায় সেইটা অথরিটারিয়ান রাষ্ট্র, তেমনই পলিটিকাল জোকের স্বভাবচরিত্র ও  প্রবণতা দেখেও কিন্তু রাষ্ট্র অথরিটারিয়ান কিনা তার ইশারা পাওয়া যায়।   

ধরেন, বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বা সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইনশৃঙখলা পরিস্থিতি ইত্যাদি বাদ দেন। গত দশ বারো বছরে দেশের পলিটিক্যাল জোক বা হিউমার খেয়াল করেন। এমন কিছু প্রবণতা আপনি দেখবেন জোকিং এর, যা এই মাত্রায় বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনোই ছিলো না। 

সমালোচনা করতে গিয়া 'কোনো একটা দেশে', 'উগান্ডা' ইত্যাদি বলা কিংবা 'নাম বললে চাকরি থাকবে না'  'উনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে' 'উনি' ইত্যাদি এক্সপ্রেশনের পাশাপাশি গত দশ বছরে বাংলাদেশে পলিটিকাল হিউমারের উচ্চফলনশীলতা কী ইশারা দেয়?  

নিশ্চয়ই জ্ঞানীদের জন্যে ইহাতে রহিয়াছে চিন্তার খোরাক! 

 

৪.
রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়া জোক

নদীতে গোসলের সময় একদিন হঠাৎ ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয় স্টালিনের। এক কৃষক নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যাইতেছিলো। সে ঝাপায়ে পড়ে স্টালিনরে বাঁচাইলো। স্টালিন খুশি হয়া কৃষকরে বললো, সে এই কাজের জন্যে কী পুরস্কার চায়? কারে বাঁচাইছে রিয়ালাইজ করতে পেরে কৃষক কাঁদতে কাঁদতে বললো, কিচ্ছু চাই না কমরেড। খালি একটা অনুরোধ: আমি যে আপনারে বাঁচাইছি এইটা কাউরে বইলেন না।  

 

এমনিতে জোকের ইতিহাস আসলে রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের প্রধানদের নিয়া জোকের ইতিহাস। প্রাচীন গ্রিস বা রোমান সাম্রাজ্যের যত জোক পাওয়া গেছে দেখা যায় একটা উল্লেখযোগ্য সংখক জোকের টার্গেট রাজা-রানী বা প্রভাবশালী শাসকবর্গ। 

প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের একটা পপুলার জোক ছিলো এমন: 

রোমে একজন লোকরে খুঁইজা পাওয়া গেলো, যার চেহারার সাথে সম্রাট অগাস্টাস সিজারের চেহারার আশ্চর্য মিল। তারে সম্রাটের কাছে নিয়া যাওয়া হইলো। সম্রাট অবাক হয়া জিজ্ঞেস করলো: তোমার মা কখনও রোমে ছিলো? সত্যি করে বলো।
লোকটা জবাব দিলো: না, জাহাপনা ছিল না। তবে আমার বাবা অনেক দিন ছিলো! 

জোকের দুনিয়া এমনই মজার যে হয়তো দেখা যায় বরিশালের কোনো কৃষক বর্ষাকালে ধানক্ষেতে বইসা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রানীরে নিয়া রসিকতা করতেছে। তপন রায়চৌধুরী 'রোমন্থন অথবা ভীমরতি প্রাপ্তর পরচরিতচর্চা'য় লিখছেন-  

'ক্ষেতে বর্ষা নেমেছে, হাঁটু অবধি জল, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুই চাষি ধানের চারার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। প্রথমের প্রশ্ন: ক দেহি, মহারানি ভিক্টোরিয়া এহন কী করতে আছে?
উত্তর: হে কি আর আমাগো মতো? পানি নাবতেই পান্তাভাত খাইয়া কাঁথামুড়ি দিয়া উব্বুত।

নিচের জোকটা আমাদের জেনারেশনে পাই নাই। হয়তো অনেকে জানলেও ভয়ে বলে না। আমি শুনছি বয়স্ক এক লোকের কাছে, সত্তরের দশকে যে ছিলো যুবক।   

শেখ মুজিবুর রহমানের একবার পেটে সমস্যা হইছে। তার ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন জানতে চাইলেন যে কী হইছে, ডাক্তার আমতা-আমতা করতে লাগলো।
এবার শেখ মুজিব বললেন, নির্ভয়ে বলে ফেলো।
ডাক্তার বললো, আপনার বাংলাথলিতে সমস্যা হইছে।  

এই জোকের শানে নজুল না জানলে ধরা যাবে না। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর, পাক শব্দযুক্ত নামগুলারে বদলায়ে ফেলা হয় পাইকারি দরে। পাকমোটর হয়ে গেলো বাংলামোটর। আইয়ুব গেট করা হইলো আসাদগেট। বঙ্গবন্ধু 'পাক' শব্দটা পারতপক্ষে শুনতে পারতেন না। ডাক্তার তাই পাকস্থলী শব্দটা না বলে বাংলাথলি বলছে।

জিয়াউর রহমানের আমলে একটা পত্রিকা নিউজ করছিলো 'বন থেকে হেগে এলেন জিয়া।'* 

[*বন= তৎকালীন পূর্ব জার্মানির রাজধানী, হেগ= নেদারল্যান্ডসের শহর] 

অবশ্য রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়া জোক থাকা মানেই অথরিটারিয়ান রাষ্ট্র হবে এমন না। 

কার্টুন: মুবতাসিম আলভী

তবে জোকের বাটের (বাট অফ দ্য জোক বা জোকে যারে টার্গেট করা হয়) প্রতি জোকের ট্রিটমেন্ট দেখে রাষ্ট্র অথরিটারিয়ান কিনা তার ইশারা পাওয়া যায়। কারণ যেকোন রেজিমের মত অথরিটারিয়ান স্টেটেও জোকের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক থাকে রাষ্ট্রের প্রধান বা রাষ্টের ক্ষমতাবান রুই-কাতলাদের নিয়া। আর জোকগুলাতে রাষ্ট্রপ্রধানদের চিত্রায়ন হয় নেগেটিভ বা স্থুলবুদ্ধির বা হাস্যকর ভঙ্গিতে। যেমন, হিটলারের আমলে প্রচুর আন্ডারগ্রাউন্ড জোক চালু ছিলো হিটলাররে নিয়া।  

হিটলার একটা পাগলাগারদে গেছে। রোগীরা প্রত্যেকে প্রথামাফিক তারে স্যালুট দিলো। হঠাৎ হিটলার দেখলো একজন স্যালুট দেয় নাই।
হিটলার জিগাইলো, তুমি আমারে দেখে বাকিদের মতো স্যালুট দিলা না ক্যান?
লোকটার জবাব: ফুরার, আমি একজন আর্দালি, পাগল না। 

অথবা 

প্রশ্ন: হিটলার, গোরিং,আর গোয়েবলস নৌকাভ্রমণে বাইর হইছেন। নৌকাটা ঝড়ের কবলে পইড়া ডুবে গেলো। কে বাঁচবে?
উত্তর: জার্মানি 

স্টালিন, হিটলার বা আরও নানা রুইকাতলা নিয়া অজস্র জোক চালু ছিলো। এখনও আছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জোকগুলির অনেকগুলা সৃষ্টি হইছে সোভিয়েত রাশিয়ায়। এবং সোভিয়েত শাসনকালের সবচেয়ে বেশি জোক সৃষ্টি হইছে স্টালিনের আমলে। 'সোভিয়েতস্কি কৌতুকভ' মাসুদ মাহমুদের একটা অনবদ্য কাজ। 'সোভিয়েতস্কি কৌতুকভ' বাংলা ভাষা তো বটেই, বিশ্বেরই অন্যতম সেরা এক জোক সংকলন। সোভিয়েত জোকের মণিমানিক্য থেকে একটা: 

স্টালিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলো। দেখলো, পূর্ব দিগন্তে সূর্যোদয় হইতেছে। স্টালিন সূর্যরে বললো, হ্যালো কমরেড সূর্য। কী অবস্থা?
সূর্য বললো, সবকিছু খুব ভালো চলছে, কমরেড স্টালিন।
দুপুরবেলায় একই ঘটনা ঘটলো।
সন্ধ্যায় স্টালিন আবার বললো, কী অবস্থা কমরেড সূর্য?
সূর্য বললো, মারা খাও তুমি স্টালিন। যাইতেছি পশ্চিমে। এবার তুমি আমার বা*টাও ছিড়তে পারবা না।     

 

৫.
অথরিটারিয়ান স্টেটে রাজনৈতিক জোক কিভাবে কাজ করে? 

কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে রাজনৈতিক জোকের কাজ কী? কী ভূমিকা রাখে এই ধরনের জোক? প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বা সমাজ বদলে ভূমিকা রাখে কিনা?—এইগুলা নিয়া অনেক হাইপোথিসিস আছে। সবগুলারে অন্তত চারটা ক্যাটিগরিতে ফালাইতেছি আমি। অনেকে হয়তো ক্যাটাগরি বেশি বলবে। তবে আমার মনে হইছে এই হাইপোথিসিসগুলারে মোট চারটা গ্রুপে ফেলা যায়৷  

 

৫.১
হাইপোথিসিস: এক 

বার্লিনের দেয়াল ভাঙার আগের কথা। পূর্ব জার্মানি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হইলেও লোকের বাকস্বাধীনতা ছিল না। সেই তুলনায় পশ্চিম জার্মানিতে জনগণের খাওয়া পরার সুবিধা থাকুক না থাকুক, মন খুইলা গালমন্দ করার স্বাধীনতা ছিল। তো পূর্ব জার্মানির একটা কুকুর দেয়াল টপকায়ে একদিন চলে আসলো পশ্চিম জার্মানিতে। পশ্চিমের এক কুকুর তারে দেখে জিগাইলো—

: কী? মালিক কি ঠিকমত খাইতে দেয় না?
: না, খাবারের অভাব নাই।
: মালিক কি লাথি মারে?
: না, অনেক আদর করে।
: মালিকের ছোট বাচ্চারা জ্বালায়?
: না, ওরাও আদর করে, যত্ন নেয়।
: তাইলে এইখানে আসছো ক্যান?
: আসছি একটু ঘেউ ঘেউ করতে।

কার্টুন: মুবতাসিম আলভী

পলিটিক্যাল জোকের ভূমিকা নিয়া চালু থাকা হাইপোথিসিসের একটা হইতেছে, পলিটিক্যাল জোক অন্যান্য জোকফর্ম যেমন, সেক্সুয়াল জোক, শ্বশুর-শাশুড়ি, মাতাল, এথনিক জোকসহ, ভুলোমনা অধ্যাপক জোক ইত্যাদির মতোই। তেমন কোনো তফাৎ নাই। অন্যান্য তথাকথিত নন-পলিটিকাল জোক যা করে অথরিটারিয়ান রেজিমে জোক তার চাইতে মৌল স্বভাবে ভিন্ন কিছু করে না। 

এই হাইপোথিসিস সহজে খন্ডন করা যায়। কারণ, বাকি নিরীহ জোক ফর্মের তুলনায় পলিটিক্যাল জোক ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি পলিটিক্যাল একটা জোকের কারণে, কার্টুনের কারণে (কার্টুনও তো আসলে এক রকম ভিজুয়াল জোক) জেলে যাইতে পারেন, গুম খুনও হইতে পারেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ, নাৎসি জার্মানি, ফ্রাঙ্কোর স্পেইনসহ বিভিন্ন দেশে পলিটিক্যাল জোকের কারণে জেল-জুলুম বা খুন হওয়ার ভুরিভুরি নজির আছে। বাংলাদেশে কার্টুন আকার কারণে কি মানুষ গ্রেফতার হইতেছে না? 

ইতিহাসের দিকে তাকাইলে দেখা যায়, শোষণমূলক অথরিটারিয়ান স্টেটগুলাতেই পলিটিক্যাল জোকের রমরমা।

অন্য সকল জোকের মতো হইলে এই জোকের জন্যে এতো ঝামেলা পোহাইতে হইতে না নাগরিকের। আমি এই হাইপোথিসিস নিয়া তাই বিস্তারিত আর্গুমেন্টে যাবো না। জাস্ট মনে করায়ে দেব যে পলিটিক্যাল হিউমার নিয়া বলশেভিকদের অবশ্যই পরিষ্কার ধারণা ছিল। বিপ্লব-সংগ্রামে শক্তিশালী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে তারা। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পরে তারা সিদ্ধান্ত নিলো সোভিয়েতে পলিটিকাল হিউমারের বড় ভূমিকা থাকবে। রাষ্ট্র তাই প্রচুর স্যাটায়ার, ফান ম্যাগাজিন প্রকাশ করছে এই উদ্দেশ্যে। এইসব কাগজ রাষ্ট্রের নানা প্রপাগান্ডার পক্ষে এবং বিরোধিদের পচায়ে জোক করতো। 

১৯৩৪ সালে সোভিয়েত লেখক সংঘের সম্মেলনে একজন এইটা সংক্ষেপে বলছেন, সোভিয়েত কমেডির উদ্দেশ্য হলো, 'হাসিতে শত্রুদের কুপোকাত করা' আর রেজিমের অনুগতদের 'হাসির মাধ্যমে সংশোধন করা'।

 

৫.২
হাইপোথিসিস: দুই 

এক দর্শক স্টালিনের মায়ের একটা স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়ায়ে মনোযোগ দিয়া দেখতেছিলেন। হঠাৎ মৌনতা ভেঙে  বললেন: কি সুন্দর একজন মহিলা! অথচ সময়মতো অ্যাবরশনটা ক্যান যে করান নাই। 

আরেকটা হাইপোথিস হইলো, জোক এমন সব মেসেজ দেয় বা এমন সব কথা বলে, যা সরাসরি বলা ডেঞ্জারাস বা অসম্ভব। রোমানিয়ার পলিটিক্যাল জোক আলোচন করতে গিয়া এলান ডুন্ডেস লিখছেন, স্টালিনের আমলের পলিটিক্যাল জোকগুলায় এমন সব জিনিস পাওয়া যায় যা লোকে ফিল করছে কিন্তু উচ্চারণের সাহস পায় নাই। 

পলিটিক্যাল হিউমার গবেষক দুন্ডেস লিখতেছেন, 'খুব নিচু স্বরেই কেবল সমালোচনা করা যাবে আর এই কারণেই (সোভিয়েত ব্লকের) পূর্ব ইউরোপে জোকের এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। ব্যক্তি অন্য কোনো উপায়ে বলতে না পারলে জোকের মাধ্যমে বলে। যেমন, সরকারের দুর্নীতি, অক্ষমতা ইত্যাদি নিয়া কথা বলা যায় না বলেই পূর্ব ইউরোপে পলিটিক্যাল জোকের এতো ছড়াছড়ি, যা আপনি আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপে দেখবেন না।' 

একই কথা সোভিয়েত, হিটলারের জার্মানির জন্যেও প্রযোজ্য। 

ফ্রাঙ্কোর স্পেনের পলিটিকাল জোকের ব্যাপারে, গবেষক স্টানলি ব্রান্ডেসের মতামতও একই। তিনিও পলিটিকাল জোকরে দেখছেন, 'এন্টি-রেজিম সেন্টিমেন্টের সেফটি ভালভ' হিসাবে। কারণ, 'ক্ষোভ আর ভীতি, আতঙ্ক আর সেল্ফ ডিফেন্সের মিশেল সবচাইতে বেশি স্পষ্ট পলিটিক্সে। শোষণমূলক পুলিশি রাজনৈতিক আবহাওয়ায় লোকে সাধারণত তাদের রাগ আর হতাশা জোকের মাধ্যমে চালান কইরা দেয়। ফলে তারা সর্বব্যাপ্ত বাকস্বাধীনতার অভাব ও পুলিশি থিকা সাময়িক মুক্তির আনন্দ পায়।'

 

৫.৩
হাইপোথিসিস: তিন 

লেনিন তখন মৃত্যুশয্যায়। মাথার পাশে বইসা আছে জোসেফ স্টালিন। লেনিনের মৃত্যুর অপেক্ষা করতেছে।
লেনিন: কমরেড স্টালিন, আমার আশঙ্কা জনগণ তোমাকে মেনে নেবে না। ফলো করবে না।
স্টালিন: ও নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না কমরেড। কিছু লোক মেনে নেবে।
লেনিন: আর বাকিরা?
স্টালিন: বাকিরা আপনারে ফলো করবে।

আরেকটা হাইপোথিসিস হইলো, জোকিং একটা বৈপ্লবিক কাজ। অথরিটারিয়ান স্টেট নিয়া ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বা ‘১৯৮৪’ এর মতো ডিস্টোপিয়ার লেখক জর্জ অরওয়েলের একটা উদ্ধৃতি বেশি দেয়া হয়: প্রত্যেকটা জোক একেকটা ক্ষুদ্র বিপ্লব।

আরও অনেকে এই ধরণের মতামত ব্যক্ত করছেন।  

জর্জ মাইকস বলেছেন, কোনো রেজিমের বিরুদ্ধে ফিসফিস কইরা বলা প্রতিটা জোক, হিটলার বা স্টালিনদের পঁচায়ে হাসা প্রতিটি হাসি তাদের কফিনে পেরেক মারার মতো।

জর্জ মাইকেস জোকরে মনে করেন, জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের একমাত্র অস্ত্র। জোক একই সাথে শক্তিশালী অস্ত্র আবার সেফটি ভালভ।

ওরিওল পি-সুনিয়ের ফ্রাঙ্কোর স্পেনে পলিটিকাল জোকরে বলছেন, গেরিলা যুদ্ধের মৌখিক ভার্সন। এগন লারসেন তার পলিটিক্যাল জোকের ইতিহাসের বইয়ের নামই দিছেন 'উইট অ্যাজ এ উইপন'।  

কমিক, লেখক বা সাংবাদিকেরা এই মতের সবচাইতে বড় ভোক্তা ও প্রচারক। বিখ্যাত কমেডিয়ান, ফিল্ম নির্মাতা মেল ব্রুকসের মত: ডিকটেটরদের ব্যাপারে আশ্চর্যের জিনিস হইলো, আপনার বুঝতে হবে,আপনি যদি তাদের সাথে একই মঞ্চে দাঁড়ান, নিশ্চিতভাবে হারতে যাইতেছেন, কারণ দর্শক-শ্রোতারে মন্ত্রমুগ্ধ রাখতে যথেষ্ট বাক্যবাগীশী তাদের আছে। তবে আপনে যদি তাদের হাস্যকর পর্যায়ে নামায়ে আনতে পারেন, অনেকখানি আগায়ে থাকবেন। আপনি দেখাইতে পারবেন সে কতটা হাস্যকর ও উন্মাদ।

মিলান কুন্ডেরার উপন্যাস 'দ্য জোক'-এর একটা চরিত্র মনে করে, দুনিয়া বদলানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত যেকোনো বড় আন্দোলন বা মতাদর্শ তারে ছোট করা বা তারে নিয়া হাসিঠাট্টা সহ্য করতে পারে না। কারণ হাসিঠাট্টা সবকিছুতে জং ধরায়ে পবিত্র চেহারা বিনষ্ট করে।

বিপ্লব বা সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে জোক পাঠ করার শুরুটা করছেন দেসিদেরিউয়াস ইরাসমাস। প্রাচীনকাল থেকে তার আগ পর্যন্ত জোকরে সমাজের জন্যে ভালো কিছু মনে করা হইতো না। প্লেটো থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত প্রায় সব চিন্তাবিদের চোখে জোক বা হাসিতামাশা ছোটলোকের বিনোদন, যা সমাজের জন্যে ইতিবাচক না। ইরাসমাস ১৫০৯ সালে ল্যাটিন ভাষায় লেখা তার রচনা ইন 'প্রেইজ অফ ফোলি'-তে সবার আগে এই ধরনের দাবি করছেন।  

আমরা দেখছি সময়মতো একটা উপযুক্ত জোক মাঝেমধ্যে এমনকি গম্ভীর স্বৈরশাসকদেরও নাড়ায়ে দিতে পারে। যদিও লোকের সামনে ক্লাউনরা শাসকদের প্রায়ই পঁচায়, নির্দয় জালিমরা তবুও ক্লাউনদের সহ্য করে। কারণ জোকিং সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম।

সমস্যা হইলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বা বিপ্লব হিসাবে পলিটিক্যাল জোকরে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গিতে গলদ আছে। 

এই ধরনের চিন্তা জোকরে যতটা বীরোচিত মনে করতে চায় জোকটেলিং এমন বৈপ্লবিক কিছু না। জোক আসলেই বৈপ্লবিক কিছু না। বড়জোর এই বিপ্লব কার্নিভালের ফ্যান্টাসি রেভোল্যুশনের মতো। বাস্তবে কোনো কার্যকরী প্রভাব রাখতে পারে না।

বিপ্লব বলতে বোঝায় সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তন। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে জোকের আইডিয়ার দাবি জোক রেজিমের ডামেজ কইরা দেয়, বদলায়ে ফেলে। অথচ জোক কোথাও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করছে ইতিহাসের কোথাও এমন নজির নাই। 

অরওয়েলের উদ্ধৃতির ব্যাপারটা দুঃখজনক কেননা, অরওয়েল ওই অর্থে বলে নাই। অরওয়েল বিশ্বাস করতেন, জোক 'এস্টাবলিশড অর্ডারে বিপর্যয়' ঘটায়। তবে সেই বিপর্যয় বাস্তবদুনিয়াতেই ঘটে এমন না। জোকের লক্ষ্য 'মর্যাদা' জিনিসটারে আক্রান্ত করা। কিন্তু ‘জোকের কারণে কোনো রেজিম তার মর্যাদা হারাইছে’ আর ‘সেই মর্যাদাহীনতা দিয়া কোনো রেজিমের চেঞ্জ হওয়া’ ভিন্ন জিনিস।   

ব্রান্ডেস, স্প্যানিশ জোকের কোন পজিটিভ ইফেক্ট ফ্রাংকোর স্পেনে দেখতে পান নাই। হ্যান্স স্পিয়েরের মতে, 'বিদ্রুপ করার হাতিয়ার হিসাবে জোক যতটা না দুর্বলের তার চাইতে অনেক বেশি কাজের ক্ষমতাবানদের। নির্যাতন-শোষণের ভিক্টিমদের জোক সাহায্য করে বড়জোর তাদের জীবনের দুর্দশা সহ্য করতে।’

হিটলারের জার্মানিতে জোকিং নিয়া বই লিখছেন রুডলফ হেরজগ। রুডলফ বিখ্যাত জার্মান ফিল্ম নির্মাতা ওয়ার্নার হেরজগের ছেলে। রুডলফ নিজেও একজন ফিল্মমেকার। রুডলফের বইটা, ইনফ্যাক্ট, তার ডকুমেন্টারি থেকে এদিক সেদিক করা। তো, রুডলফ তার বই 'ডেড ফানি: হিউমার ইন হিটলার্স'স জার্মানি'তে লিখছেন, এই ধরনের জোক আসলে সামাজিক বিবেক বা ব্যক্তিগত সাহসিকতার প্রকাশ না বরং টেনশন রিলিফ করা বিনোদন। এই বিনোদন কোনো বাস্তব রাজনৈতিক পরিবর্তন  ঘটায় না।

বরং অনেকে এমনও দাবি করছেন যে, পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট আমলে সিক্রেট পুলিশের একটা বিভাগ ছিলো, যাদের কাজ সরকাররে সমালোচনা করে জোক বানানো আর ছড়ায়ে দেওয়া। তারা জোকের পজিটিভ ফাংশনের ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলো। রাজনৈতিক জোক সাধারণ মানুষরে তাদের ক্ষোভ ও হতাশা একটা সহনীয় মাত্রায় বের করে দিতে হেল্পায়। 

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, পলিটিক্যাল জোকের বাস্তব দুনিয়ায় আদৌ কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব আছে কিনা। খালিদ কিশতায়নি আরব অঞ্চলের পলিটিক্যাল হিউমার নিয়া গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। খালিদ মন্তব্য করছেন: 

লোকে তাদের অত্যাচারী শাসকদের নিয়া জোক করে শাসকদের উৎখাত নয়, সহনীয় করে তুলতে।

যাদের বন্দুক আছে প্রতিবাদের জন্যে জোক তো লাগেই, জোকে তাদের কিছু আসে-যায়ও না।

আলেকজান্ডার রোজ: জোক সাময়িক যন্ত্রণালাঘবকারী যা বাস্তব রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অর্থহীন এক ধরনের বিকল্প।

রবার্ট কোচরানের মতে, পলিটিকাল জোক একই সাথে এক ধরনের উদ্ধত ভঙ্গি এবং পরাজয় স্বীকার করে নেয়া। জনকল্যাণমূলক কোনো পরিবর্তন রাজনৈতিক জোকে ঘটে না।

 

৫.৪
হাইপোথিসিস: চার 

বুখারেস্টের রাস্তা ধরে ভীতসন্ত্রস্ত এক লোক ছুটতেছে। এক বন্ধু তারে থামাইলো, এইভাবে দৌঁড়াইতেছ কেন?
: তুমি শোনো নাই? তারা ঠিক করছে সব উট মাইরা ফেলবে।
: তাতে তুমি ডরাও কেন? তুমি কি উট?
: আমি উট না হইলেও এরা আগে গুলি করে তারপর বিবেচনা করে আমি উট কি না।  

আরেকটা হাইপোথিসিস আছে। এইটা রিসেন্ট। এবং আমি এই মতের সাথে আংশিকভাবে একমত। এই মতানুযায়ী, পলিটিকাল জোকিং রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের ক্ষমতাসম্পর্করে সেই ক্ষমতার সিম্বলের সাথে সম্পর্কে নিয়া যায়। অর্থাৎ সিম্বলিক ক্ষমতার কেন্দ্রবদল হয়। এলেক্সেই ইয়ারচাক, ওলগা তাতিয়ানাদের মতো ক্রিটিকরা তাদের হাতের কাছের সোভিয়েত রাশিয়া থেকেই উদাহরণ দিছেন। 

যেমন, ৭০-এর দশকেই সোভিয়েতের নাগরিকরা অফিশিয়াল আইডিওলজির সারবত্তা না থাকার ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলো। জীবন চলছে সেই আইডিওলজিরে পাত্তা না দিয়া, এমনকি 'সোভিয়েত রেপ্রেজেনটেশনের হেজিমনিরে' দেখেও না দেখার মতো, যেন কিছু হয় নাই, এমনভাবে সমান্তরালে হাসি-ঠাট্টায় তাদের জীবন চালায়ে গেছে।

এইরকম পরিস্থিতিতে গভীরভাবে সিনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া জীবনযাপন সম্ভব না। ভান করতে হইছে নাগরিকদের। লোকে এমন ভাব করতো যেন সোভিয়েত অফিশিয়ালরা যা বলতেছে সেইটাই তারা বিশ্বাস করতেছে, এর বাইরে কিছু তারা জানে-বোঝে না। পলিটিকাল হিউমার, ইয়ারচাক বা তাতিয়ানাদের মতে, এইরকম ভান ছাড়া তৈরি হইতে পারে না। এই প্রেক্ষিতে, একই সাথে রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার এবং সেই মিথ্যারে নাগরিকদের সত্যি ভাবার অভিনয় দুইটারে ফাঁস করে দিতো রাজনৈতিক জোক। 

এইভাবে পলিটিকাল এনেকডটস অফিশিয়াল মতাদর্শের প্রতিরোধের কোনো চিহ্ন না, এমনকি গোপনে সত্যি কিছু রিভিল করাও না। বৈরী, শোষণমুলক একটা রেজিমে নিজের আত্মসম্মান ধরে রাখার আন্ডারগ্রাউড পদ্ধতিও না এই পলিটিকাল জোকিং। এই ধরনের জোক মূলত সেল্ফ মকিং, যেহেতু তা একই সাথে নিজেদের আত্মপ্রবঞ্চনা ও অপারগতা দুইটাই তুলে ধরে। ফলে এই জোকগুলা, অফিশিয়াল ও সমান্তরাল—দুই ধরণের অসামঞ্জস্য এবং ব্যক্তির দুইটাতেই অংশগ্রহণরে তুলে ধরে। 

এর প্রমাণ হিসাবে বলা যায়, বিভিন্ন এনেকডটসে অফিশিয়াল ক্লিশে কথাবার্তার ব্যবহার। 

: সোভিয়েত ইউনিয়নে চিরস্থায়ী বিষয়টা কী?
: সাময়িক সমস্যা।  

: অন্য ব্যবস্থার চাইতে সমাজতন্ত্র কোন দিক দিয়া ভালো?
: অন্য ব্যবস্থায় নাই এমন সমস্যাগুলা সমাধানে সোভিয়েত অত্যন্ত কার্যকরী।  

জোকগুলা তাদের প্রবলেম সলভ করতে বা সমস্যা নিয়া ভাবাইতে বা নতুন প্রতিরোধী কোনো রাস্তা দেখায় না। অফিশিয়াল রিয়ালিটি নিয়া বিদ্রুপ, না বরং এইটার সাথে মানায়ে নিতেই অভ্যস্ত করে এই ধরনের জোকিং। অনেকটা 'বাঙালি তো এমনই', 'ভাইরে ভাই এই দেশে তো এইটাই স্বাভাবিক' ধরনের ভ্যালু উৎপাদন করে। 

 

৬.
তবুও জোক করেন 

আত্মতৃপ্তির জায়গা থেকে ব্যক্তি হয়তো ক্ষমতা, অপ্রেসিভ কোনো রেজিম বা অন্যায্য ক্ষমতাবানদের নিয়া স্যাটায়ার বা জোক করে একটু সাময়িক শান্তি পাইতে পারে। সেইটা কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন আনে না। বরং বলা যায় এইগুলা ক্ষুব্ধ ও ভীত অবস্থার এক ধরনের রিলিফ বা স্বস্তির কাজ করে। লোকে এই ধরনের জোক বলে একধরনের 'ভুয়া স্বাধীনতার তৃপ্তি' পায়। 

ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস আইরনির ক্ষেত্রে যা বলছেন, আমি প্রতিবাদ হিসাবে জোকের ক্ষেত্রেও সেইটা উচ্চারণ করতে চাই—কৌতুক হইতেছে সেই পাখির গান যে তার খাঁচারে ভালবাসতে থাকে।

প্রতিবাদের হাতিয়ার না হইলেও সাময়িক টেনশন রিলিজের কাজ তো করে জোক। আর আমাদের মতো দেশে, আদর্শিক দেউলিয়াত্ব আর খুল্লামখুল্লা লুটপাটতন্ত্রের মধ্যে আপনার অবস্থানগত সিগনাল দিতেও রাজনৈতিক জোক করতে পারেন। নিয়মিত রাজনৈতিক জোক বলেন, অন্তত সাময়িক স্বস্তিতে থাকেন। 

পাঠক, আরেকটা জোক বলে লেখা শেষ করি।  

তিনজন লোকরে প্রিজন ভ্যানে তোলা হইছে।

প্রথম: আমরা একটা অথরিটারিয়ান স্টেটে আছি, পুলিশি রাষ্ট্রে আছি, ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছু নাই—এইসব লিখছিলাম। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ধরে আনছে। 
দ্বিতীয়: আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বর্ণযুগে এবং সুবর্ণভূমিতে আছি। কোনো জোরজবরদস্তি নাই দেশে ইত্যাদি লিখছিলাম। স্যাটায়ার মনে করে ধরে আনছে।
প্রথম ও দ্বিতীয়জন একসাথে তৃতীয়জনরে প্রশ্ন করলো: আপনি কী করছেন ভাই?
তৃতীয়: আমি কিছু করি নাই। আমার নাম গুঞ্জন রহমান। গুজব রহমান মনে কইরা ধইরা আনছে। 

১০১৭৯ পঠিত ... ১৯:৪৪, জুন ১৬, ২০২০

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top