সময়কে আজকাল অনেকেই টাকার সাথে তুলনা করেন। গতির এই যুগে কোথাও থমকে থেকে, সেটা ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকা, সময় নষ্ট করাকে ভালো চোখে দেখা হয় না একেবারেই। তারপরেও ঢাকাসহ দেশের সব বড় শহরে ট্রাফিক জ্যামে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় অপচয় হচ্ছে। শুধু কি শহর-নগর, বাংলাদেশের প্রায় সব মহাসড়কেই নির্দিষ্ট কিছু জায়গা থাকে যেখানে জ্যাম লেগে চলে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। ফলে অনেকেই বিভিন্ন রকম বিকল্প ভাবতে শুরু করেছেন। এমন একটি বিকল্প হতে পারে হেলিকপ্টার।
নানান আকারে ভিন্ন ভিন্ন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হেলিকপ্টার পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক বাজারে। দামের রেঞ্জটাও কয়েক লাখ ডলার থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। তাই হেলিকপ্টার কেনার আগে ভেবে নিন আপনার প্রয়োজনটা ঠিক কেমন। তার উপর হেলিকপ্টার আপনিই চালাবেন (সেক্ষেত্রে হেলিকপ্টার চালানোর লাইসেন্স থাকতে হবে) নাকি একজন পাইলট রেখে চালাবেন, সেটিও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একজন থেকে শুরু করে ৬-৮ জন যাত্রী বহন করতে পারে এমন হেলিকপ্টারগুলোই ব্যক্তিগত যান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য যেসব হেলিকপ্টার আজকাল পৃথিবীজুড়ে ব্যবহৃত হয় তেমন কিছু হেলিকপ্টারের নাম ও পরিচিতি থাকল-
# রবিনসন আর-২২
এই যেমন একান্ত ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আপনি কিনতে পারেন রবিনসন আর-২২ হেলিকপ্টারটি। খুবই হালকা গড়নের দুই সিটের এই হেলিকপ্টারটির নতুন কিনতে গেলে লাগবে আড়াই লাখ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় খরচ পড়বে ২ কোটি ১০ লাখ টাকার মতো। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এক থেকে দেড় লাখ ডলারেই সেকেন্ড হ্যান্ড পাওয়া যায় এই হেলিকপ্টারটি। বাংলাদেশি টাকায় খরচ পড়বে ৮০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকার মতো। পাইলট রেখে চালালে, এই হেলিকপ্টারে কেবল একজনই চড়তে পারবেন।
# রবিনসন আর-৪৪ র্যাভেন
র্যাভেন-১ এবং র্যাভেন-২ এই দুই মডেলে পাওয়া যায় হেলিকপ্টারটি। পৃথিবীজুড়ে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য খুবই জনপ্রিয় চার সিটের এই আকাশযানটি। পাইলট রেখেও আরও ৩ জন অনায়াসে এটি ব্যবহার করতে পারে দেখে এটি একটি ছোট পরিবারের জন্য খুবই আদর্শ হেলিকপ্টার। রবিনসন আর-২২ এর মতো এটি অতটা হালকা নয় বলে, নিরাপত্তার দিক দিয়েও কিছুটা এগিয়ে থাকবে এটি। র্যাভেন ওয়ান কিনতে আপনার গুণতে হবে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা, আর র্যাভেন টু’র দাম প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।
# ইউরোকপ্টার ইসি১২০ কলিবরি হামিংবার্ড
অপেক্ষাকৃত কম শব্দ করা এই হেলিকপ্টারটিতে পাইলট ছাড়া বসতে পারেন ৪ জন যাত্রী। প্রাইভেট কারের মতোই চালকের পাশে যাত্রীর একটি আসন আর পিছনের দিকে এক সারিতে তিনটি আসন। নিরাপত্তার জন্য হেলিকপ্টারটিতে অসংখ্য অভিনব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এই হেলকপ্টারটি কিনতে আপনার খরচ পড়বে সাড়ে ১৪ কোটি টাকার মতো।
# এইচ-১২৫
বিশ্বখ্যাত বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসের এইচ-১২৫ হেলিকপ্টারটি কিছুটা দূরের যাত্রায় কাজে লাগবে। একবার জ্বালানী পূর্ণ করে নিলে হেলিকপ্টারটি আকাশপথে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার চলতে পারে নির্বিঘ্নেই। অর্থাৎ ঢাকা থেকে দেশের প্রায় যেকোনো প্রান্তে আপনি চলে যেতে পারবেন। পাইলট ছাড়াও এক সারিতে চারজন যাত্রী বসতে পারবেন এই হেলিকপ্টারটিতে। এই হেলিকপ্টারটি কিনতে আপনার খরচ পড়বে ১৮ থেকে ২১ কোটি টাকার মতো।
# বেল ৪০৭
৪ জন যাত্রী বহন করতে সক্ষম হলেও এই হেলিকপ্টারটিকে আপনি এইচ-১২৫ থেকে এগিয়ে রাখতে পারেন। এই হেলিকপ্টারটিতে ককপিট থেকে যাত্রীদের বসার জায়গাটি কেবিন দিয়ে আলাদা করা এবং চারজন যাত্রী দুই সারিতে মুখোমুখি বসেন। দূরের যাত্রার জন্য এমন হেলিকপ্টার এখন অনেকেরই পছন্দের তালিকার উপরের দিকে আছে। তবে টাকাও কিছুটা বেশি খরচ করতে হবে এটি কিনতে। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকা পড়বে এটি কিনতে।
বাড়তি তথ্য
এই হেলিকপ্টারগুলো ছাড়াও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আরও বেশ কিছু মডেলের হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীতে। বেল বি২০৬ সিরিজের জেটরেঞ্জার এবং লংরেঞ্জার, এনস্টর্ম টারবাইন ৪৮০বি-সহ আরও অসংখ্য মডেলের হেলিকপ্টার কিনতে পারবেন আড়াই থেকে ২৫ কোটি টাকার মধ্যে। তবে উপরে যেসব হেলিকপ্টারের দাম বলা হয়েছে সবগুলোর দামের সাথেই ট্যাক্স যুক্ত হবে। পাশাপাশি আপনি নিজেই যদি হন দক্ষ পাইলট সেক্ষেত্রে একলাই উড়ে চলার জন্য কিনে ফেলতে পারেন এক সিটের হেলিকপ্টার। চপার নামে অধিক পরিচিত এসব হেলিকপ্টার আপনি ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার মাঝেই কিনতে পারবেন।
আর একেবারে ব্র্যান্ড নিউ হেলিকপ্টার কিনতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা না থাকলে ব্যবহৃত হেলিকপ্টারের দিকে চোখ রাখতে পারেন। সেদিক দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে অর্ধেকেরও কম দামেই পাওয়া যায় উপরে উল্লিখিত হেলিকপ্টারগুলো। আর গাড়ির ভিতরের সবকিছু যেমন বদলে ফেলা যায়, তেমনি হেলিকপ্টারের ভিতরটাও আপনি আপনার রুচি ও আরামের সাথে মিলিয়ে বদলে নিতে পারবেন।
কোথা থেকে কিনবেন
জামা-কাপড়, বই বা অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মতো অনলাইনেও আপনি কিনতে পারবেন নতুন বা ব্যবহৃত হেলিকপ্টার। বিজনেসএয়ার, আপলিফটিং কিংবা অ্যারোট্রেডারের মতো আরও বেশ কিছু ওয়েবসাইট থেকে আপনি খুঁজে পেতে পারেন আপনার পছন্দের হেলিকপ্টারটি। তবে একেবারে সশরীর অসংখ্য হেলিকপ্টারের মাঝ থেকে নিজের পছন্দের হেলিকপ্টার কিনতে চাইলে উড়ে যেতে পারেন ইতালিত। লিওনার্দো হেলিকপ্টার এন্ড অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ হেলিকপ্টার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। রোমে গিয়ে যাচাই বাছাই করেই কিনে নিয়ে আসতে পারেন পছন্দের হেলিকপ্টারটি।
হেলিকপ্টার ভাড়াতেও পাওয়া যায়
কিনে ফেলা ছাড়াও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য ভাড়াতেও পাওয়া যায় হেলিকপ্টার। বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় হেলিকপ্টার দিয়ে থাকে। ৩ জন যাত্রীর জন্য রবিনসন-৪৪ ভাড়া নিতে খরচ পড়বে ঘন্টায় ৭০ হাজার টাকা। ৪ জন যাত্রীর জন্য হেলিকপ্টার ভাড়া নিতে খরচ পড়বে ৮৫ হাজার টাকা। ৬ সিটের হেলিকপ্টার ভাড়া নিতে গুণতে হবে ঘন্টায় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। এর সাথে ১৫% করে ভ্যাট যুক্ত হবে। শুধুমাত্র হেলিকপ্টার উড্ডয়নের সময়সীমা এই খরচে বিবেচনা করা হয়। হেলিকপ্টারের ওয়েটিংয়ের খরচটাও তাই জেনে নিতে হবে। প্রতি ঘন্টা অপেক্ষার জন্য ১০-১৫ হাজার টাকা চার্জ করা হয় হেলিকপ্টারভেদে। তবে ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্র-শনিবারে হেলিকপ্টার ভাড়া নিতে গেলে আরও ৩০% বেশি খরচ করতে হবে। আপনি হেলিকপ্টার ভাড়া নিয়ে কোথাও সারা রাতের জন্য রাখলে এক রাতের জন্য ৫৫ হাজার টাকা খরচ করতে হবে।
আকাশপথে ঢাকা থেকে কোন জেলায় যেতে কেমন সময় লাগে? ঢাকা থেকে সিলেটের রাউন্ড ট্রিপ ২ ঘন্টা ১০ মিনিটের। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাউন্ড ট্রিপ ২ ঘন্টা ২০ মিনিট এবং ঢাকা-কক্সবাজার রাউন্ড ট্রিপ ৩ ঘন্টা ১০ মিনিট সময়ের। সেই হিসেবে ঢাকার জ্যাম এড়িয়ে চলতে চাইলে শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সামান্য সময়েই পৌঁছে যেতে পারবেন। কাছাকাছি খরচে বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন কাজের জন্য হেলিকপ্টার ভাড়া দেওয়া হয়। স্কয়ার এয়ার লিমিটেড, ইমপ্রেস এভিয়েশন লিমিটেড, সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইন্স লিমিটেড এমনই তিনটি প্রতিষ্ঠান।
কিছু সতর্কতা
শুধু হেলিকপ্টার কিনলেই তো হবে না। ল্যান্ডিংয়ের বিষয়টাও মাথায় রাখতে হবে। মোটেও একটা হেলিকপ্টার নিয়ে আপনি যেখানে সেখানে ল্যান্ডিং করে ফেলতে পারবেন না। সাধারণত হেলিপ্যাডেই ল্যান্ডিং করতে পারে একটি হেলিকপ্টার। বিমানবন্দর আছে এমন কোথাও গেলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানেই হেলিকপ্টার নিয়ে নামতে পারবেন। এছাড়া কোন এলাকায় গিয়ে মাঠ বা কোথাও হেলিকপ্টার ল্যান্ডিংয়ের আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নিতে হবে।
বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও হেলিকপ্টারে চড়ার অভিজ্ঞতা কিন্তু একেবারেই আলাদা। হেলিকপ্টারে আপনার দৃষ্টি অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত থাকে, তাই যদি আপনার উচ্চতাভীতি থাকে তাহলে হেলিকপ্টারে চড়ার আগে বেশ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নিরুপায় না হলে সামনের সিটে বসবেন না, কারণ হেলিকপ্টারের সামনের সিট থেকেই দৃষ্টি চারপাশে অনেক বেশি উন্মুক্ত।
আধুনিক হেলিকপ্টারগুলোতে শব্দ কমানোর জন্য অনেক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও, সাধারণ হেলিকপ্টারগুলোতে শব্দ অনেক বেশি হয়। তাই হেলিকপ্টারে উঠার আগে ইয়ারপ্লাগ নিয়ে উঠতে পারেন।
তাছাড়া উপরে উল্লিখিত কোন হেলিকপ্টারেই প্রাকৃতিক কর্ম করার সুবিধা নেই। তাই, হেলিকপ্টারে চড়ার আগে অবশ্যই এসব সেরে উঠবেন।
পাঠকের মন্তব্য