আমাকে রেখে যাওয়া হয়নি, মালিকের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় আমি নিজেই বের হয়ে চলে এসেছি : জনৈক মার্সিডিজ

৩২৬০ পঠিত ... ১০:২৬, মে ০৫, ২০১৭

কয়েকদিন আগেই মহাখালীতে পাওয়া গেলো একটি বেওয়ারিশ বিলাসবহুল মার্সিডিজ গাড়ি। এর আগে রাস্তায় পাওয়া মার্সিডিজের সঙ্গে চিঠি পাওয়া গেলেও এবার পাওয়া যায়নি এমন কিছুই। ঢাকার পর গত ৪ মে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় পাওয়া গেছে আরও দুটি কোটি টাকার মার্সিডিজ। মালিকরা কেন এভাবে ফেলে রেখে যাচ্ছেন তাদের এত শখের কোটি টাকার গাড়ি? কেন এই আত্মত্যাগ?

গাড়ির মালিকরা যেহেতু নিজেদের পরিচয় দিতে চান না, অগত্যা eআরকি টাইমসের এই প্রতিবেদক কথা বলেছে রাস্তায় পাওয়া একটি মার্সিডিজের সঙ্গেই। বর্তমানে তিনি আছেন পুলিশ হেফাজতে। সাক্ষাৎকারকির বিশেষ অনুমতি নিয়ে জনাব মার্সিডিজের কাছে ভিড়তেই দেখা গেল, তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছেন। বাতাবরণে একটা বিরক্তির ছাপ। আমাদের দেখা মাত্রই পেছনের একজস্ট পাইপ দিয়ে ফুঁস করে কিছু গ্যাস ছেড়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি। আমরা তার বিরক্তিকে পাত্তা দিতেই যাচ্ছিলাম, পরে মনে পড়লো, ও এটা তো একটা গাড়িই, একে এত পাত্তা দেয়ার কী আছে! অতএব বেশি সময় নষ্ট না করে আমরা শুরু করি আমাদের আলাপচারিতা।

eআরকি : কেমন লাগছে এখানে?

মার্সিডিজ : আছি, এটাই কি অনেক না? রাস্তার ধুলাবালি কাদার মধ্যে পড়ে থাকার চেয়ে অনেক ভালো। সাচ এ ডার্টি সিটি!

: ঢাকা শহরের রাস্তায় তো আপনার নিত্ত নৈমিত্তিক চলাফেরা ছিলই, অভ্যস্ততা আসেনি কেন!

: ওহ, এক্সকিউজ মি! আমার জন্য বাসায় কয়টা চাকর রাখা জানেন? আই মিন, কয়টা চাকর রাখা ছিল? এই কান ইম্যাজিন, আমার চাকা ধোয়া চাকরের বেতন আপনার চেয়ে বেশি হবে, ইউ স্টুপিড। ঢাকা শহরের ধুলা কাদায় ঘোরা হয়েছে ঠিকই কিন্তু ফেরার পর পরই দ্রুত হট শাওয়ার নেয়া হত, বডি বিভিন্ন উপায়ে ক্লিন করা হত। আরও কত পরিচর্যা! এগুলা বুঝবেন না আপনারা, নট স্যুটস ইউর লেভেল আই গেস।

: কিন্তু সেই লেভেল ছেড়ে এমন নিচু লেভেলে আসতে হলো কেন? মানে, কী ধরণের পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন মালিকেরা?

: মালিকেরা মানে? মালিকেরা সিদ্ধান্ত নেয়ার কে? চাপে পড়তে পারে, সেটা তো সিদ্ধান্ত হয় না।

: মানে বলতে চাচ্ছেন আপনি যে বেওয়ারিশ নাম ঠিকানাহীন ভাবে রাস্তায় পড়ে আছেন, আপনার মালিকরা এখানে রেখে যায় নি?

: নাআআআ! তাদের চাকররা রেখে গেছে!

: ওহ, না, মানে সেটা বলছি না, সিদ্ধান্তটা তো মালিকই নিচ্ছেন যে আপনাদেরকে এই বিলাসের জীবন থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নাম পরিচয় সব মুছে ফেলে রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হবে!?

: আমাকে কেউ রেখে যায় নি। আমি নিজেই চলে এসেছি। আমি কারো জন্য বিপদের কারণ হতে চাই না!

: আপনি নিজেই চলে এসেছেন? মানে স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে এমন বিলাসী জীবন ছেড়ে নেমে পড়েছেন রাজপথে?

: ইয়া। তাই।

: এর পেছনের কারণটা জানতে পারি কী?

: জাস্ট পারসোনাল। আর কিছু না। বলতে পারেন, মালিকের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। এইটুকুই।

: মালিকের সঙ্গে এডজাস্ট না করতে পেরে আপনি বের হয়ে পড়েছেন?

: ইয়া, ইউ ক্যান সে। ওর সাথে আর না। আমার এক ইঞ্জিনে এত প্যাড়া আর সহ্য হয় না।

: বনিবনা হচ্ছিল না ঠিক কেন, মানে কোন কোন ব্যাপারে মনে হচ্ছিল যে সমস্যা হচ্ছে?

: আসলে ও আমাকে অনেক আন্ডারএস্টিমেট করতো! আমাকে এই যে পণ্য হিসেবে, বড়লোকীর প্রতীক হিসেবে অথবা জাস্ট গ্ল্যামার আইটেম হিসেবে সব জায়গায় প্রেজেন্ট করতো, এটা আমার ভালো লাগত না। আমারো একটা যোগ্যতা আছে! আমার গতি ভালো, একজন দুর্দান্ত গাড়ি হিসেবে ট্রিটেড হওয়ার সব কোয়ালিটি আমার আছে। আমাকে শুধু টাকা দেখানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারটা আমার আত্মসম্মানে লেগেছে বলতে পারেন।

: আর কোনো সমস্যা যেমন মিসবিহেভ বা এমন কিছু?

: হ্যাঁ, তাও করতো। লাইক রিসেন্টলি মালিবাগের কোন মেয়ের সঙ্গে কী করছে জানি না। রেগুলার তার আমাকে নিয়ে মালিবাগ যেতে হবে। আরে তাকে বুঝাতে পারিনি, এইটা রাস্তা না রে ভাই এইটা লেক, লেক! আমার এই নাজুক চার পা দিয়ে আমি ওখানে কী করে যাব। সে আমার এসব দিক কখনও ভাবতো না।

: আচ্ছা, আচ্ছা। আপনি এই যে পালিয়ে চলে আসলেন, আপনার মালিক আপনাকে খুঁজবে বলেও মনে করেন না? মানে আর্থিক না হলেও, মনের টান?

: হাহাহা! অসম্ভব! আর এখন তো আরও অসম্ভব!

: এটা কি ট্যাক্সজনিত ইস্যু?

: নো কমেন্টস। জাস্ট এটুকু বলতে পারি যে আমি চলে এসেই আসলে ওকে বাঁচিয়েছি।

: আচ্ছা, ব্যক্তিগত প্রশ্ন থাকুক। বিলাসবহুল জীবন থেকে বের হয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

: মুক্ত লাগছিল প্রথমে। কিন্তু পরে এলাকার বখাটে কালো ট্যাক্সি, ছোট ট্রেনিং কারগুলো আমাকে টিজ করা শুরু করে। হেডলাইট জ্বালিয়ে নিভিয়ে বাজে সিগনাল দেয়... ইট ওয়াজ সো প্যাথেটিক।

: কেন, ওরা ওভাবে টিজ করলো কেন? এমন কোনো অভিযোগ তো আগে শোনা যায় নি!

: বোঝেন না, আমি ধনীর দুলালী। সারাজীবন ভাব নিয়ে চলছি, রাস্তায় ওভারটেক করে গেছি। পেছন থেকে হর্ন দিয়ে মাথা খারাপ করে ফেলছি, ভিআইপি সিগনাল দিয়ে ওদের ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখে আমি বের হয়ে গেছি! কত কিছু! ইটস লাইক শ্রেনী বৈষম্য... ওই শ্রেণীর আমার শ্রেণীর প্রতি রাগ তো থাকবেই, কী আর করা!

: ওহ, আচ্ছা। এরপর বখাটে ট্যাক্সিগুলোর বাম্পার থেকে থেকে মুক্তি পেলেন কীভাবে?

: আসলে এমন গোলযোগের সময়েই পুলিশ চলে আসে! আর এরপরই তো আমার এখানে আসা। 

: কী ভাবছেন? কী করতে চান?

: জন্মভূমিতে ফিরে যেতে চাই। এছাড়া আর কিছু ভাবছি না।

: জীবনের এমন কোনো স্বপ্ন যা এখনো দেখেন? এখনো ভাবলে মনে হয় জীবনের রাস্তায় ফার্স্ট গিয়ারে চলতে থাকা আনন্দময়?

: ফার্স্ট এন্ড দ্যা ফিউরিয়াসের কোনো এক পর্বে এক শটের জন্য হলেও অভিনয় করতে চাই! আই লাভ ইট, আই জাস্ট লাভ ইট! অবশ্য পিক্সারের 'কার' মুভিতে অভিনয় করাও আমার ড্রিম।

: বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে আপনার কোন মূল্যায়ন?

: এ দেশের মানুষ খুব অতিথি পরায়ন। আর দামী জিনিসকে এরা খুব সমীহ করে। অযথাই যদিও। 

: আরাম আয়েশের বিলাসী ঘর ছেড়ে বেরোনোর পর যে জীবনবোধ আপনাকে গ্রাস করেছে খুব...

: রাস্তায় কিছু গরু দেখলাম, ওদের গলায় রশি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওদের মালিক!  কী সুন্দর একটা পারিবারিক সুর। তাও ওদের এমন একটা মালিক আছে যে ওদেরকে নিজের কাছে রাখতে চায়, নিজের পরিচয় দিতে চায়। নিজেকে গরুর চেয়েও অধম মনে হলো!

সাক্ষাৎকার শেষে যাওয়ার সময় পুলিশকে যখন চা-পানির খরচা দিচ্ছি, দেখলাম জনাব মার্সিডিজের উইন্ডশিল্ড ভেজা। একটু পর পর ওয়াইপার দিয়ে মুছে নিচ্ছেন। আবেগে আমাদের চোখও আরেকটু হলেই ভিজে যাচ্ছিল। পরে মনে পড়লো, ও, এইটা তো একটা গাড়িই...!

৩২৬০ পঠিত ... ১০:২৬, মে ০৫, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top