টিকটক সমাচার

৬৬০ পঠিত ... ১৬:৪৮, মে ১৬, ২০২২

Tiktok-somacher

টিকটক তারকাদের নিয়ে আমার কোনো কথাও নাই, মাথাব্যথাও নাই। আমার সব চিন্তা এবং বিস্ময় হচ্ছে টিকটকের ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা মানুষজন নিয়ে।

কয়েকটা উদাহারণ দিলে আমার বিস্ময়ের কারণটা আপনারা ধরতে পারবেন এবং আপনারাও বিস্মিত হয়ে পড়বেন।

সেদিন দেখলাম, একটি সাজানো গোছানো ছোট পরিবার টিকটক করছে। একটি ছেলে, একটি মেয়ে, একটি বাবা, একটি মা। মেয়েটি টিকটক তারকা। সে একটি রিং লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে খুব আবেগঘন একটি দৃশ্যপট তৈরি করেছে।

রিং লাইটের অপর পাশে একটি ছোট্ট ফ্যান হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মেয়েটির বাবা, যাতে ফ্যানের বাতাসে মেয়ের চুল ওড়ে এবং অন্যরকম আবহ তৈরি হয়।

কিন্তু শুধু চুল উড়লে তো হবে না, মেয়েটির আবেগ যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য দরকার একটা স্মোক মেশিন যেটা থেকে রাশিরাশি ধোঁয়া বের হবে।

কিন্তু স্মোক মেশিন না থাকাকে কোনো বাধাই হতে দিচ্ছেন না মেয়েটির মা। তিনি হাতে ময়দার গুঁড়া নিয়ে (হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন) পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। সেখান থেকে ফুঁ দিয়ে কিছু গুঁড়া পাঠিয়ে দিচ্ছেন মেয়ে এবং ক্যামেরার মাঝখানে, যেটা তৈরি করছে একটি আধিভৌতিক পরিবেশ!

পাশে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটির ভাই। সেখান থেকে একটু পরপর পানি নিয়ে চোখে দিচ্ছে মেয়েটি যাতে আবেগের কোনো ঘাটতি না হয়।

এই পুরো দৃশ্যপটে আবহমান বাংলার যেকোনো পরিবারকে কল্পনা করলাম। কল্পনায় দেখতে পেলাম, মায়ের হাতে ময়দার গুড়ার বদলে বড় একটা মুগুর যেটা দিয়ে তিনি মেয়েটাকে বারবার আঘাত করছেন।

আর বাবার হাতে ফ্যানের বদলা একপাটি জুতা যেটা দিয়ে মেয়ে এবং ছেলে দুজনকেই মারছেন। ছেলের কোনো অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও সে মার খাচ্ছে। কেন মার খাচ্ছে, আবহমান বাংলায় এই প্রশ্ন অবান্তর।

আরেকটা টিকটকে দেখলাম একটা মেয়ে নাচছে। নাচা কোনো অপরাধ না, নাচুক।

সে নাচছে 'টিপটিপ বারসা পানি'র সাথে। সমস্যা নাই। গানটা সুন্দর।

মেয়েটি আপাদমস্তক বোরখা দিয়ে ঢাকা। থাকুক।

মেয়েটি এই সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলা বাংলার জমিনেই কোনো এক গ্রামের কোনো এক ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে নাচছে। নাচুক। মেনে নিলাম।

কিন্তু আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা মানুষগুলোকে। এরা দিব্যি পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। এদের কোনো বিকার নেই! এদের মুখের মাংশপেশিতে এক বিন্দু পরিবর্তন নেই! যেন তাদের সামনে কিছুই ঘটছে না।

অথচ আমাদের চিরচেনা বাংলায় কোনো কিশোরীকে এভাবে চৌরাস্তায় শরীর দুলিয়ে নাচতে দেখলে আমরা জগতের সব কাজ থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।

আমাদের চোখে থাকতো বিস্ময় কারণ এমন অদ্ভুত দৃশ্য পৃথিবীতে আগে কখনও দেখা যায়নি, ভবিষ্যতেও দেখা যাবে না।

আমাদের হৃদয়ে থাকতো হতাশা কারণ সমাজটা আজ ধ্বংস হয়ে গেছে।

আমাদের মনে থাকতো করুণা কারণ মেয়েটা কনফার্ম দোজখে যাবে।

অথচ এখানে এইসবের কিচ্ছু হচ্ছে না! কিচ্ছুই না!

পরের ঘটনাটি একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের।

সদ্য বিবাহিত স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন গাড়ির দিকে। এই গাড়িতে উঠার সাথে সাথেই নবপরিণীতার ঠিকানা বদলে যাবে, পরিচয় বদলে যাবে। হৃদয়বিদারক দৃশ্য।

হঠাৎ করে সেখানে চলে আসলেন একজন টিকটকার। স্বামী-স্ত্রীকে ফ্রেমের ভিতরে রেখে তিনি উঠানের কাদায় গড়াগড়ি খেতে শুরু করলেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে লাগলো গান, যার অর্থ হচ্ছে, তার আদরের পোষা পাখি আজ তাকে ধোকা দিয়ে অন্যের ঘরে চলে যাচ্ছে। এজন্য তার হৃদয় আজ কাঁদছে, তিনি মরে যাচ্ছেন।

টিকটকারের মুখ এবং অঙ্গভঙ্গির সাথে পুরো দৃশ্যপট হুবুহু মিলে যাচ্ছে। তিনি হাত বাড়িয়ে তার পাখিকে আটকে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এ সমাজ তাকে ধাক্কা দিয়ে বারবার কাদার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

অভিনয় এবং প্রতিভায় কোনো খাদ নেই।

কিন্তু আমাদের পরিচিত পৃথিবীতে এই ঘটনা ঘটলে তার পরিণতি কী হতো?

বরের পিতা কন্যার পিতার কানেকানে বলতেন, 'বেয়াই সাহেব, বিষয়টা কী? এই ছেলে কে? সে এরকম করছে কেন? এর সাথে আপনার মেয়ের সম্পর্ক কী? আমাকে খুলে বলতে পারেন। আমি তো এখন আর দূরের কেউ না।'

কন্যার পিতার চোখ মুখ শুকিয়ে যেতো। তিনিও ভেবে কূলকিনারা পেতেন না, এই ছেলে কে? এ কী চায়!

পিতার নিরবতা পুরো পরিবেশকে আরো গুমট করে তুলতো। অল্প কিছুক্ষণের ব্যবধানে আনন্দযজ্ঞ রুপ নিতো ধ্বংসযজ্ঞে। একটি সম্ভবনাময় সুখের সংসারের ইতি ঘটে যেত এখানেই।

অথচ এখানে কিছুই হচ্ছে না। বর দিব্যি কনেকে নিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। বরযাত্রীরাও যার যার মতো ব্যস্ত। যেন এটাই বাংলার ঐতিহ্য। নতুন স্বামী-স্ত্রী হেঁটে যাবে আর উঠানের কোনোয় এক টিকটকার প্যাকের মধ্যে গড়াগড়ি খাবে!

এরকম অসংখ্য উদাহারণ দেয়া যাবে।

মাঝে মাঝে মনে হয়, টিকটকার এবং তাদের আশপাশের মানুষরা অন্য কোনো প্যারালাল ইউনিভার্সের বাসিন্দা। তারা আমাদের কেউ না, আমরাও তাদের কেউ না। আমাদের নিয়ম ও তাদের নিয়ম আলাদা।

আমাদের এখানে ই=এম সি স্কয়ার। ওদের ওখানে এম=ই সি স্কয়ার।

আমাদের mRNA-এর একটা স্টপ কোডন UAG, ওদের সব স্টপ কোডন XXX.

আমাদের এখানে আকাশের রঙ নীল। ওদের ওখানে আকাশের কোনো নির্দিষ্ট রঙ নেই। কখনও সেটা বেগুনী, তাদের জুতার মতো। কখনও হলুদ, তাদের চুলের মতো। আবার কখনও লাল, তাদের প্যান্টের মতো।

৬৬০ পঠিত ... ১৬:৪৮, মে ১৬, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top