ঘিলু

১৮৯ পঠিত ... ১৫:৫১, মার্চ ২৭, ২০২৫

20thumb

লেখা: আহসানুল করিম

এক

আমি মানুষটা কেমন একটু বলি। তাহলে কী হচ্ছে কেন হচ্ছে সেটা শুনতে গিয়ে বারবার আপনার ভুরু কুঁচকে যাবে না।

ধরুন আপনি আমার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। আদর আপ্যায়নের এক পর্যায়ে যখন আপনার সাথে আমি কিংবা আমার সাথে আপনি কী নিয়ে আলাপ করবেন বুঝতে পারছেন না, তখন সেটা বুঝতে পেরে হয়তো টিভি ছেড়ে দেই এবং এমন কোনো একটা মুভি ছেড়ে দেই যেটা আমার আগে দেখে ভালো লেগেছিল কিন্তু আপনার আগে দেখা হয়নি অথচ ভালো লাগবেই এতে আমি মোটামুটি নিশ্চিত। তারপরে আমি ভান করি যেন মুভিটা আমি আগে দেখিনি যাতে আপনার কারণে আমার একটা দেখা মুভি আবার দেখতে হচ্ছে এই নিয়ে কোনো অস্বস্তি না হয়। সেই ভানের অংশ হিসেবে মুভির ট্যুইস্টের জায়গাগুলোতে বিস্ময়ের নিখুঁত অভিনয়েরও চেষ্টা করে যাই।

মানুষকে খুশি রাখতে আমি অনেক বড় বড় অসুবিধা নিজের কাঁধে নিয়ে নিতে পারি। মানুষের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেলে যখন বারবার না করা সত্ত্বেও অনেক খাবার পাতে তুলে দেয়, যত কষ্টই হোক আমি সবটা খেয়ে উঠি। হোস্টের যেন মনে না হয় যে আমার কাছে রান্না যথেষ্ঠ সুস্বাদু হয়নি। আমার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়, টাক বেয়ে ঘাম ঝরে, অথচ আমি টিস্যু দিয়ে সেই ঘাম মুছতে মুছতে গুরুপাক খেতে থাকি। মাঝে মাঝে রান্না বাজে হলেও, মাছে কিংবা মাংসে গন্ধ লাগলেও এই নিয়মের ব্যত্যয় হতে দেই না। বমি উঠে আসতে চাইলেও থামি না। এমনকি মনে মনেও কাউকে শাপশাপান্ত করি না এই ভয়ে যে মনের ভাব চেহারায় পাছে ফুটে ওঠে।

দুই

এ তো গেল বাইরের মানুষের প্রতি আমার বদান্যতা। আমি আমার স্ত্রীকেও কোনোরকম কষ্ট না দিতে চেষ্টা করি। সে যেন আমাকে অসুখী মনে না করে, কিংবা সেই অসুখী জীবনের জন্য নিজেকে দায়ী মনে না করে, সেজন্য নির্ঘুম যেসব রাতে আমার কান্না পায়, আমার স্ত্রী ঘুমিয়ে গেলে চুপচাপ উঠে গিয়ে বেলকনিতে বসে বসে নিঃশব্দে কাঁদি। নিজের দুঃখে কান্না শেষ হয়ে এলে, সারা পৃথিবীর মানুষের দুঃখে কাঁদি, নানান দেশের মাইনরিটি লোকজনের জন্য কাঁদি, প্যালেস্টাইনের দুঃখে কাঁদি, পরাজিত কামালা হ্যারিস বা ডেমোক্র্যাটদের দুঃখে কাঁদি, পলাতক খুনি হাসিনা আর তার আপনজন হারানোর দুঃখে যে আগে কেঁদেছি একসময়—সেই অপরাধবোধে কাঁদি, আগামী দুতিন দিনের সম্ভাব্য সকল দুঃখের জন্যও সেই সুযোগে আগাম কেঁদে নেই। মনে হতে পারে আমি আসলে অসুখী। কিন্তু মাঝে মাঝে নিবিড়ভাবে যখন বিশ্লেষণ করি দেখতে পাই আমি আসলে মোটেই অসুখী নই। বরং নিজেকে বেশ সুখি বলেই মনে হয় আমার।

আমি কী ধরনের মানুষ ঠিকমতো বোঝাতে গেলে আরও উদাহরণ দিতে হবে। ধরুন আমার স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে। এরপর কিছুক্ষণ আমি বেশ সাবধানে হাঁটি বা কাজকর্ম করি। কারণ জোরে শব্দ হলে সে ভাবতে পারে আমি রেগে গিয়েছি। আসলে তো আমি রাগি নাই। কেননা রাগ বলে কোনো অনুভূতিই আমার নাই। সে যদি ভাবে আমি রেগে গিয়েছি তাহলে দুটো ব্যাপার হতে পারে। প্রথমত আমাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য তার অপরাধবোধ হতে পারে। দ্বিতীয়ত তার মনে হতে পারে আজকাল আমি বিনা কারণে রেগে যাই এবং তাকে আগের মতো ভালোবাসি না। আর একথা মনে হলে তার মনে একটু হলেও কষ্ট হতে পারে। দুটোর কোনোটিই আমি হতে দিতে পারি না। আমি আসলেই তাকে ভালোবাসি।

সন্দীপণ চট্টোপাধ্যায় আমার প্রিয় একজন লেখক। তার কোনো এক উপন্যাসে কথা প্রসঙ্গে এক রাজার রাজদরবারের জনৈক বিদূষকের কথা বলা হয়েছিল। দরবার চলাকালে একবার সেই বিদূষকের ভীষণ বাতকর্মের চাপ আসে। বেচারা সেই বাতকর্ম চাপিয়ে রাখে। পাছে চাপিয়ে না রাখলে দূর্গন্ধে যদি রাজার কষ্ট হয়। দরবার চলাকালে অনুমতি নিয়ে বাইরে যাবেন তাতেও রাজার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো হয়ে যেতে পারে। অনেকক্ষণ এভাবে চাপতে চাপতে একসময় বিদূষকের হার্ট অ্যাটাক হয়। গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল বিদূষক লোকটি আচারে প্রকারে অনেকটা আমারই মতন।

তিন

এবারে বিশেষ একটা ঘটনার কথায় আসা যাক। ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। পাঠক, খুব সম্ভাবনা আছে এতক্ষণের ভনিতার পরে মূল গল্প শুনে আপনি হয়তো চটে যাবেন। কেননা মূল গল্প খুব সংক্ষিপ্ত। কিংবা কে জানে আপনি বিরক্ত হবেন এই ভয়ে হয়তো আমি অহেতুক টেনে লম্বা করতেই থাকব। কেউ আমার উপরে বিরক্ত হতে পারে এটা ভাবলে আমার খুব কষ্ট হয় এবং আমি সেটা ঠিক নিতে পারি না। এর কারণও হলো এই যে আপনি যদি বিরক্ত হন, তবে ছোট্টো এই জীবনের অল্প কিছুটা সময় আপনার খারাপ যাবে, তাও সেটা আমার কারণে, এটা হতে দেওয়া খুব কঠিন আমার জন্য।

মূল ঘটনা ঘটল সেদিন রাতে। সপ্তাখানেক আগে। আমার স্ত্রী সেদিন আগেই ঘুমিয়ে গেছেন। পূর্ণিমার রাত। আমি বেলকনি থেকে সবে সন্ধ্যায় দেখা খায়রুল বাশার আর তটিনির বিয়োগান্তক নাটকটাতে কাল্পনিক চরিত্রগুলো যে দুঃখকষ্টের ভেতর দিয়ে গেছে সেগুলো নিয়ে একটু চোখের পানি ফেলে এলাম। বিছানায় খুব সাবধানে বসলাম যেন ঘুমের কোনো ব্যাঘাত না ঘটে ওর। তারপর খুব সাবধানে শুয়ে পড়লাম। মনে পড়ল মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া হয়নি। অন্ধকারে হাতড়ে মোবাইল খুঁজতে গিয়ে হাতের ধাক্কায় নিভে থাকা টেবিল ল্যাম্পটা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে সেটা দ্রুত ধরার চেষ্টা করলাম। পেটের কাছে মাংসপেশীতে প্রচণ্ড একটা টান লাগল। কিন্তু ভাগ্য ভালো টেবিল ল্যাম্পটা পড়েনি, ধরে ফেলেছি। এবারে ধীরে ধীরে মাংসপেশীর টানের ব্যথা সামলাতে সামলাতে নিজেকে বাহবা দিতে লাগলাম টেবিল ল্যাম্প পড়ে যাওয়া ঠেকাতে পেরেছি বলে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। টেবিল ল্যাম্পের ধাক্কায় নাইট স্ট্যান্ডের কিনারে রাখা মোবাইল ফোনটা পড়ে গেল। পড়ার সময় সাথে নিয়ে পড়ল একটা কাচের গেলাস। ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল আমার শিরদাড়া দিয়ে। যদ্দূর মনে পড়ে গ্লাসে খানিকটা রেড ওয়াইন ছিল। শব্দে আমার স্ত্রী উঠে না গেলেই হয়। কয়েক মুহূর্ত শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতা।

নাহ ওঠেনি।

এখন এই অন্ধকারে আমাকে নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামতে হবে। রেড ওয়াইনে মাখামাখি ভাঙা গেলাসের কাচ এড়িয়ে মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে সেটার টর্চ জ্বালতে হবে। এরপর কাচের টুকরোগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। কার্পেটে রেড ওয়াইন কতটা লেগেছে কে জানে। অবশ্য গাঢ় রঙের কার্পেট। কিন্তু যদি তাও দাগ দেখা যায়? বড় টুকরোগুলো সরানো গেলেও কাচের গুড়োগুলো তো ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ছাড়া পরিষ্কার করা যাবে না। আর যাই হোক এই গভীর রাতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না। নিঃশব্দে রান্নাঘরে যেতে হবে। কয়েক টুকরো কাপড় বা ন্যাকড়া যা পাওয়া যায়।

কিন্তু এ কী? আমার এমন লাগছে কেন? প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে নাকি? বুক চিন চিন করছে। চোয়ালের কাছটা আড়ষ্ট হতে শুরু করেছে নাকি? হার্ট অ্যাটাক না তো?

এই যাহ, পা কেটে গেল, কাচ বিঁধেছে। ব্যান্ডেজ লাগবে। রক্ত বের হচ্ছে। চেপে ধরলাম হাত দিয়ে। রক্তে হাত ভিজে গেল। অন্ধকারে হোঁচট খেলাম খাটের এক পায়ায়। অপ্রস্তুত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে গেলাম। মাথায় আঘাত লাগল কিছুতে। এত জোরে আঘাত আর কোনোদিন পেয়েছি কিনা জানি না। জ্ঞান হারালাম নাকি?

চার

জ্ঞান ফিরে এল বেশ তাড়াতাড়ি। অদ্ভুত ব্যাপার। মাথাটা হালকা লাগছে। সেই প্যানিকের ভাবটা নেই। হাতড়ে হাতড়ে বুঝলাম বেডরুমেই পড়ে আছি। মাথায় যেখানে আঘাত লেগেছিল সেখানে হাত চলে গেল। জায়গাটা ফেটে ফাঁকা হয়ে আছে। চটচটে জিনিসটা মনে হয় আমার ঘিলুই হবে। রক্ত আর ঘিলুতে মাখামাখি অবস্থায় কী করা যায় ভাবছি। কিন্তু ভাবনাটা শেষও করা যাচ্ছে না। যেহেতু খানিকটা ঘিলু বেরিয়ে গেছে।

এই দূর্ভোগের গল্প আর দীর্ঘ করে পাঠককে কষ্ট দেওয়াটাও হবে আমার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। এরপরে যা হলো তা খুব দ্রুত হলো। আমার স্ত্রী উঠে পড়ল। আলো জ্বেলে আমার অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে ইমার্জেন্সি নম্বরে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকল। অ্যাম্বুলেন্স এলো, প্যারামেডিকেরা এলো। ওরা আমাকে বেঁধেছেদে স্ট্রেচারে তুলে নিল। ঐ অবস্থাতেও আমার খারাপ লাগছিল অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে প্রতিবেশীদের ঘুম নষ্ট হচ্ছে ভেবে।

ডাক্তাররা খুব যত্নের সাথে আমার ঘিলুটা খুলির ভেতর ভরে দিলেন (পরে জেনেছি)। সামান্য ঘিলু পাওয়া যাচ্ছিল না যদিও (ডাক্তারের অনুমান ১০০-১৫০ গ্রামের মতো)। আমার মনে হচ্ছিল খাটের নিচে খুঁজলে হয়তো সেটুকুও পাওয়া যেত। কিন্তু আবার হাসপাতাল থেকে কাউকে বাসায় পাঠানো, মানুষকে ঝামেলায় ফেলা, তাই চেপে গেলাম। যা ফিরে পেয়েছি তাই অনেক।

এসব কয়েকদিন আগের ঘটনা। হাসপাতালের বিছানায় বসে বসে লিখছি। মনে হচ্ছে ঐ ঘিলুটুকুতে যতগুলো নিউরণ ছিল সেগুলোর অভাবেই হয়তো এই গল্পের শেষটা ঠিকঠাকমতো করা গেল না। একই কারণে দয়া করে বানান বা ব্যাকরণ ভুল দেখলেও পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করছি।

১৮৯ পঠিত ... ১৫:৫১, মার্চ ২৭, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top