লেখা: রাজীব কান্তি রায়
(প্রথম পর্ব)
ব্যাপারী সাহেব একজন নিপাট ভদ্রলোক দোকানদার। তিনি সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই হাই কমোডে হাগতে যান। আয়নায় দাড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে, চুলটা একটু আঁচড়িয়ে নিয়ে পাশে থাকা মধুর শিশিটা খুলে ঠোঁটে লাগিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দোকানের উদ্দেশ্যে।
বাসা থেকে দোকানের পথের ফাঁক অল্প। হেঁটে হেঁটেই চলে আসেন। অনেকেই তাকে চেনেন। বলে, ব্যাপারী সাহেব শরীর ভালো। তিনি হেসে জবাব দেন, ভালো, ভালো আছি। হাসতে গেলেই ঠোঁট থেকে মধু ঝড়ে পরে। তখন জিহব্বা বের একটা চাটা দেন। কিন্তু সহজে চিনতে পারেন না কার কথার উত্তর দিলেন। তার ডিমেনশিয়া আছে। আগে এই কথা বুঝিয়ে বলতেন অন্যদের। এখন টায়ার্ড লাগে বলে ছেড়ে দিয়েছেন।
দোকানে তেমন কাজ থাকে না। বসে বসে তার মনে হয় জীবনের সময়গুলো কীভাবে কেটে যাচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছেন না। ইদানিং দোকানদারি থেকে মন উঠে গেছে । অথচ এই দোকানের জন্যই একসময় জান-প্রাণ দিয়েছিলেন। বউ ছেড়ে চলে গেছে, আশেপাশের মানুষ, বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে, পরিবারের লোকজনও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, তবুও অত খারাপ লাগেনি। দোকানে বসলে মানুষ আসত নানান মতের, খুনশুটি হতো, কী আনন্দের দিন। এখন আর তেমন লাগে না। মনে হয় দোকানটা এই জীবনের গোয়া মেরে দিয়েছে। যখন তরুণ ছিলাম, অত মনে হয়নি। এখন বয়স চল্লিশোর্ধ্ব । উঠতে গেলেই ব্যথা লাগে। এই কথা তো আর বাইরের কাউরে বলা যায় না। একান্তই নিজের সঙ্গে নিজের আলাপ।
ঘরে ফিরে শুয়ে শুয়ে ফেসবুক চালান। দেশে প্রতিদিনই বিরাট গ্যাঞ্জাম লাগে। তাই দেখে দেখে ঘুমিয়ে পড়েন খালেদ ব্যাপারী। আগামীকাল ছুটির দিন। সপ্তাহের এই একটা দিন দোকানে যেতে হয় না। কিন্তু তার ছুটির দিন বলে কিছু নাই। কেন নেই সে ফিরিস্তি পরে হবে।
দেশে চলছে অভ্যুত্থানের সরকার। ঘুম থেকে উঠে স্ক্রল করতেই ব্যাপারী সাহেবের চোখে পড়ল প্রধানমন্ত্রী বলছেন, নিজেদের গোয়া নিজেরা আর মারবেন না। অনেক হয়েছে এই কাজ। এইবার সেরা বিদেশীদের হাতে এই দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। মানুষের কষ্ট হলেও কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। খালেদ সাহেব খুশিতে টগবগিয়ে উঠলেন। নিজের ঠোঁটটা আরেকবার চেটে নিলেন অভ্যাসবশত। তার অনেকদিনের শখ পুরোনো দোকান ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বন্দরে ব্যাপসা-পাতি করার। ওখানে নানান পদের মানুষ থাকে, তার উপর বিদেশিরাও এখন থাকবে। দেশের সব মানুষ হইলো ফাঁকিবাজ। পরিশ্রম করতে চায় না। এরা নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নিতে পারে না। কিন্তু বড় বড় কথা বলে।
ভাবতে ভাবতে ব্যাপারীর মনে হলো, এইবার ভালো কিছু হবে। তার সারা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাড়া হয়ে গেল মুহূর্তেই। বউ চলে যাবার পর থেকেই তিনি হতাশার পুকুরে ডুবে ছিলেন। কখনোই ভাবেননি এমনটা তার সাথে ঘটতে পারে। তবে সত্যিকার অর্থেই জীবন এমনই যে, মুহূর্তেই কখন কী ঘুরে দাঁড়াবে বলা মুশকিল!
মাহিন পোদ্দার। ব্যাপারী সাহেবের একমাত্র ঘনিষ্ঠ কর্মচারী। বয়স কম, কিন্তু বুদ্ধি গিজগিজ করে। পরামর্শসহ নানান রকমের আলাপ হয় তার সাথে। নিঃসঙ্গতার সঙ্গী, কিন্তু সন্তানসুলভ ভালোবাসা দিয়ে ছেলেটিকে কাছে রেখে দিতে চান। তবুও তার মনে হয় কোনো একদিন হয়তো এই স্নেহের পোদ্দার তার হাতছাড়া হয়ে যাবে। যাক, জীবনের অনেককিছু ছেড়ে আসা মানুষ তিনি। এত ভয় পেলে চলে না। বন্দরের ব্যাপসা-পাতি নিয়ে তার সাথে একটা আলাপ অতীব জরুরি। সেটা কাল-পরশুর মধ্যে হলে সবথেকে ভালো হয়। কী কী নিয়ে আলাপ করবেন ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন ব্যাপারী সাহেব।
দেশে নতুন গ্যাঞ্জাম লেগেছে। এক সুন্দরী নায়িকাকে পুলিশ ধরে হাজতে পাঠিয়েছে। ব্যাপারী ঘুম থেকে উঠলেন। ফেসবুকে ঢুকেই গ্যাঞ্জামের খবর তার ফিডে চলে আসলো। তিনি খুবই সতর্কতার সাথে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে খবরটি বের করে জুম করে দেখলেন নায়িকাটির চেহারা আসলেই সুন্দর কিনা! নিশ্চিত হবার পর তার ভেতরে মুহূর্তের জন্য হাহাকার তৈরি হলো যে প্রত্যেক অপরাধীকে কোনো একদিন কৃতকর্মের শাস্তি পেতেই হয়।
খালেদ ব্যাপারী অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। শুধু গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর মাথায় রাখেন। দেশের এত এত খবর যে কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষেও কী তা মনে রাখা সম্ভব! দোকানের পথে হাঁটতে হাঁটতে অনেক কিছুই চিন্তা করছেন। তার মনে হলো, পুলিশ তো জনগণের বন্ধু কিন্তু ওরাও তো মানুষ। ওদেরও তো ভুল হতে পারে যেমন, ধরুন নায়িকাটিকে তারা ভুল করে আটকিয়েছে, কোনো অপরাধই নেই। এমনও তো হতে পারে। এই নায়িকাটির অত্যন্ত কাছের কি কেউই নেই, যে সবকিছু দিয়ে হলেও প্রিয়তমাকে বাঁচাতে ছুটে আসবে! খালেদ ব্যাপারীর মনে হলো সম্ভবত এমন কেউ নেই। তিনি তো নিজেও কত একা। এমন কাউকে পেলে কতই না যত্ন করে রাখতেন! মুছে ফেলতেন নিজের অতীতের সকল ভুলভ্রান্তি। অসহায় নায়িকাটির জন্য আজ কতকিছুই করতে ইচ্ছে করছে ব্যাপারীর! এই আকাঙ্ক্ষাটি তার মনের ভেতর প্রথমে পুলকিত এবং পরমুহূর্তেই নৈতিক বোধের জন্ম দিল। ভাবনাটি ছেড়ে দিয়ে দ্রুত হাঁটা দিলেন দোকানের দিকে।
আল্লাহর দুনিয়ায় মারা খাওয়াই আসলে বেশিরভাগ মানুষের ভাগ্য। অনেকে দ্বিমত করতে পারেন। কিন্তু নিজেকে নিয়ে একবার গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেন, ভিন্নমত পোষন করার সুযোগ পাবেন না। এই বাস্তবতাকে ব্যাপারী সাহেব মেনে নিয়েছেন। কিন্তু মাহিন নামের ছেলেটি অত্যন্ত বেয়ারা এবং পোঁদপাকা । বহুত তর্ক-বিতর্ক করে সে প্রমাণ করেছে এই মারা খাওয়ার দলে সে নেই। বিতর্ক জিনিসটা ব্যাপারী সাহেবের তেমন পছন্দ নয়। কিন্তু তার একাকিত্ব এবং বাৎসল্যের সুযোগ নিয়ে ছেলেটি ক্রমাগত বলে যায় আর ব্যাপারী সাহেব বরাবর শুনে যান।
খালেদ ব্যাপারীর ঘরে রাখা শিশিতে মধু শেষের দিকে। আজ সকালবেলা ঠোঁটে লাগানোর সময় খেয়াল করলেন অতি সামান্য পরিমানে আছে। এইসব ব্যাপারে তিনি অতি সাবধানী। অথেন্টিক প্রোডাক্ট ছাড়া লাগান না। কিন্তু দেশের যা অবস্থা, কোনো কিছুতেই আস্থা নেই। মানুষ হিংস্র হয়ে উঠেছে। সবাই নিজের সুবিধার কথা ভাবতে গিয়ে অন্যের ক্ষতি করে চলেছে। বিশেষ করে এই ভেতো বাঙালিরা, এরা জীবনেও শুধরাবে না। এই রিয়ালিটিও তিনি মেনে নিয়েছেন। কর্মময় দিনের ক্লান্তি শেষে, রাতেরবেলা মোনাজাতে বসে ‘আল্লাহ, তোমার কাছে বিচার দিলাম’ বলার পর ব্যাপারীর ভেতরে এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি কাজ করে। তখন এক ফোঁটা খাটি মধু তার কাছে খুবই নগন্য মনে হয়। এই ইহজাগতিক জীবনও অতি নগণ্য হয়ে ওঠে । গতরাতে এতই ভালো ঘুম হয়েছে যে শরীর, মেজাজ দুটোই ফুরফুরে লাগছে তার। তাই সকালে উঠে একটা জম্পেস নাস্তা সারলেন। এই নাস্তাটি তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। একলা জীবন বড়ই বেদনাদায়ক। নিজেকেই সব করতে হয়। তবে সুবিধাও আছে বহুত। তার স্বাস্থ্যসুরত অতি চমৎকার। লাল জাম্বুরার মতো উর্বর চেহারা আর ভরপুর যৌবন পেকে টসটস করছে। আসলে প্রত্যেক সফলতার পেছনে থাকে কঠোর অধ্যবসায়। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত ঘুম, হাসিখুশি কর্মময় জীবন আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সবই রয়েছে ব্যাপারীর জীবনে। একবারে ষোল আনা। তাই ব্যাপারী সাহেবকে দেখলে সবাই হিংসে করে। আহা! কী সুন্দর মুক্ত-স্বাধীন পরিচ্ছন্ন জীবন। সত্যিই তাই।
কিন্তু এদেশের নিরীহ এবং মোটাদাগে গরিব মানুষদের জন্য ব্যাপারীর খারাপ লাগে। জন্ম থেকে মরণ অবধি এরা রোগে-শোকে ভোগে, এদের নিজ ভাগ্য কতই না স্বার্থপর আর নির্মম! ভাবতে গেলে দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। কিন্তু এও সত্যি যে সর্বদা ভাগ্যের দোহাই দেওয়া তো ভালো কথা নয়। অলস লোকেরাই কেবল এই কথা বলে আর পাওনার বেলা ষোল আনা চায়। কী অদ্ভুত, বিচিত্র এই দেশ! আর দেশে এই মাসুদের সংখ্যাই বেশি, শতকরা নব্বই ভাগ। খালেদ ব্যাপারীর আক্ষেপ হয় যে, ওরা আর কোনোদিনই ভালো হবে না। যদি এইসব লোক পরিশ্রম করতে জানত, নিজেদের দুঃখের কথা গভীরভাবে ভাবত, আমার ধারণা দেশে একজন অভাবি মানুষও থাকত না। কী নেই আমাদের! উর্বর ভূমি, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু সবই আছে। কেবল নেই তার মতো কিছু পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী আর স্বপ্নবান পুরুষ।
ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা,
আমাদের এই বসুন্ধরা ,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক…
(চলমান)
পাঠকের মন্তব্য