ক্ষোভ

১৪৩৫ পঠিত ... ১০:৫৮, মে ০৯, ২০১৭

খুব আন্তরিকভাবে আজ একটা গল্প শোনাব আপনাকে, হালিমা আপা। জানি না, গল্প শোনার মানসিকতা আপনার আছে কি-না! কারণ আপনার স্বামী হযরত আলী, আপনার ৮ বছর বয়সী মেয়ে আয়েশাকে নিয়ে কয়দিন আগে ঝাঁপ দিয়েছিলেন দেওয়ানগঞ্জগামী তিস্তা ট্রেনের নিচে। মারা গেছেন দু’জনই। অথচ আপনারা নিঃসন্তান দু’জন মাত্র একদিন বয়সী ওই মেয়েটাকে অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিলেন নিজেদের কাছে। বুকের সমস্ত ওম আর ভালোবাসা দিয়ে বড় করছিলেন একটু একটু করে।

দুর্ঘটনাটি ঘটার পরপরই দেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ছবি ছাপা হয়েছে আপনার। আপনাকে নিয়ে, আপনার পরিবারকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক কিছু। সেসব পড়ে মানুষ কেঁদেছে, হাহাকার করেছে। দু’পা দু’হাতওয়ালা একজন মানুষ আপনার ওই ছোট্ট মেয়েটাকে উত্ত্যক্ত করত পথে-ঘাটে। আপনার স্বামী বিচার চেয়েও পাননি। বিচার চাওয়ার অপরাধে আপনাদের একমাত্র গরুটাকে কেড়ে নিয়ে গেছে সেই প্রভাবশালীরা। জনগণের বন্ধু হিসেবে বুলি আওড়ানো পুলিশ ভাইরা চুপচাপ বসে থেকে চা-সিগারেট খেয়েছে প্রতিদিন। ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে তারপর তাদের সেই নৃশংস আত্মহনন!

ঘটনা এটাই তো—তাই না!

এবার তাহলে আপনাকে ওই গল্পটা বলি।

মানুষটা লেখক হতে চেয়েছেন, গায়ক হতে চেয়েছেন, গীতিকার হতে চেয়েছেন, নাট্যকার হতে চেয়েছেন, সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হতে চেয়েছেন। এ সবই করেছেন তিনি টাকার জোরে। বিশাল একটা চাকরি করতেন তিনি। বেতন যা পেতেন তার কয়েকশ’ গুণ টাকা আসত অন্য পথে। ফলে বানের জলের মতো ভেসে আসা টাকা খরচ করতে তার কোনো কার্পণ্য ছিল না, দ্বিধা ছিল না; কেবল একটা কাজের জন্য—তার নামটা ছাপা হোক পত্রিকায়। জ্বলজ্বল করুক কালো কালো অক্ষরের মাঝে।

মানুষটা এটাও চেষ্টা করেছেন—সব পত্রিকায় তার নাম ছাপা হোক, সবাই তার নাম জানুক; মুখে মুখে ফিরুক তার স্বসম্পাদিত নাম।

একদিন হলোও তাই।

নিজের বউ থাকা সত্ত্বেও অন্যের বউয়ের সঙ্গে মিশতে লাগলেন তিনি। এবং সেই বউয়ের স্বামীকেও মেরে ফেলার সন্দেহে আটকে গেলেন পুলিশের হাতে। ব্যস, দেশের সব পত্রিকায় ছাপা হয়ে গেল তার নাম—প্রথম পাতায়, শেষ পাতায়, মাঝের পাতায়, নানান পাতায়। ‘একদিন তার জেগেছিল সাধ, পূর্ণ হলো শেষে অনেক ক্ষতির পর।’ আপনি কি জানেন হালিমা আপা—এটা কার কথা?

থাক, আপাতত জানার দরকার নেই। এবার আপনার কাছে আমি জানতে চাচ্ছি—আপনার কি এমনতর সাধ ছিল?

আমি নিশ্চিত—ছিল না।

কোনো কোনোদিন এমন হয়; কিছুই ভালো লাগে না। না আকাশ, না মাটি। বৃক্ষের মতো আঁকড়ে থাকি নিজের অস্তিত্বে; স্থির হয়ে রই পাহাড়ের মতো। কারণ সে আমার ঔরসে আসতে চেয়েছে কি-না জানি না, কিন্তু এসেছে। একটা মেয়ে আমাকে বাবা বলে ডাকে, ক্ষণে ক্ষণে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বাবা, তুমি এত ভালো কেন?’

ক্লান্তির অতলে যখন আমি তলিয়ে যাই, পানসে মনে হয় জীবনের সব উজ্জ্বলতা, তখন আমি আমার মেয়ের দিকে তাকাই। সহস্র কোটি তারার আলো ঘিরে ধরে আমাকে। সব পঙ্কিলতা দূর হয়ে আলোকিত হয়ে উঠি আমি নিমিষে।

স্রষ্টা না করুক, যদি আমার মেয়ের দিকে সামান্যতম আঁচড় দিতে চায় কোনো দু’হাত-পাওয়ালা অমানুষ, তাহলে আমি শুধু তাকে না; মঙ্গল গ্রহে বাস করা ক্ষমতাবানকেও পায়ের নিচে পিষ্ট করব; প্রজ্বলিত ছুরিতে তার বুক চিরে বলব, ‘আমার বুকের ভেতর যা আছে, আপনার বুকেও তা আছে। আমার ব্যথাও তাই বুঝতে হবে আপনাকে। আমি একটু একটু করে মরে যাচ্ছি, মরে যান আপনিও।’

স্রষ্টাকে আমি একদিন বলেছিলাম—প্লিজ, গিভ মি অ্যান আঞ্জেল। স্রষ্টা আমাকে একটা মেয়ে দিয়েছে। সেই স্রষ্টার কসম, ওই মেয়ের জন্য আমি সব করতে পারি। হালিমা আপা, অভূত ক্ষতি আর নিঃস্ব হওয়ার পর আমি কাঁদতে চাই না, রাষ্ট্রের কপট করুণাও চাই না। চাই না ক্ষতির আগে সাহায্য না পাওয়া মানুষের ক্ষতির পরের সাহচর্য!

হালিমা আপা, সত্যি বলছি—আপনার মতো এত স্বচ্ছ চোখের জল আমার চোখে নেই! 

১৪৩৫ পঠিত ... ১০:৫৮, মে ০৯, ২০১৭

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top