
লেখা: সুমন রাহমান
(এক বক্তা এক শ্রোতা: (ছবি কালের কন্ঠ) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার স্মরণে শোকসভার আয়োজন করে শহীদ আসাদ পরিষদ। সভাস্থলে গিয়ে দেখা যায় অতিথি হিসেবে রয়েছেন একজন। আর তার বক্তব্য শুনছেন মাত্র একজন। কালের কন্ঠ ১ আগস্ট ২০১০)
ছবিটি নির্ভার এক বিকালবেলার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভেজা চত্বর। ফোরগ্রাউন্ডে একজন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো। খানিক দূরে আরেকজন। ব্যাকগ্রাউন্ডে, দূরে, বৃষ্টিবন্দী হয়ে-থাকা মানুষের গন্তব্যে ফেরার স্রোত। গাছ ও ঘাসের সবুজ উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে বৃষ্টিধোয়া প্যানোরমায়। ছবিটি ছাপা হয়েছে দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকার ১ আগস্ট ২০১০ সংখ্যায়। ছবির ক্যাপশন, ‘এক বক্তা, এক শ্রোতা’। ছোট্র সংবাদটি পড়ে জানা যায়, এখানে শহীদ আসাদ পরিষদ নামে একটি সংগঠন সদ্যপ্রয়াত মান্নান ভুঁইয়ার স্মরণসভা ডেকেছিল।
এক বক্তা, এক শ্রোতা, সদ্যপ্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, স্মরণসভা। এই চতুষ্টয়ের যোগাযোগ আমাকে আবার ছবিটির দিকে তাকাতে আগ্রহী করে। এবার প্রথমেই চোখ যায় বক্তা ও শ্রোতার দিকে। ছবি যেভাবে আছে, তাতে বক্তাকে চেনার উপায় নেই। অবশ্য শহীদ আসাদ পরিষদের কাউকে আমি চিনিও না। কাঁচাপাকা চুল আর জুলফি থেকে ভদ্রলোককে পঞ্চাশের কাছাকাছি বলে আন্দাজ করা যায়। শ্রোতা যিনি, আরেকটু কম বয়সী হবেন। তারও মুখছবি ঝাপসা। পেছনে হাত বেঁধে মনোযোগী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। দূরে তাকালাম। একজন মাইকে বক্তৃতা দিচ্ছেন, তার অভিঘাত সম্ভাব্য শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে পড়ছে কিনা বোঝার জন্য। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকজনকে হাঁটতে দেখা যায় শহীদ মিনার চত্বর ঘেঁষে। তবে কারো মনোযোগই এদিকটায় নয়।
এক বক্তা, এক শ্রোতার বাইরে এই আয়োজনকে ঘিরে কমপক্ষে আরো দু’জন আছে। এক সাংবাদিক বা আলোকচিত্রী, যিনি এই ছবিটা তুলেছেন। আর মাইক্রোফোনের কর্ড ছবির ফ্রেম ছাড়িয়ে হাতের বাঁয়ে মাইকের এমপ্লিফায়ার পর্যন্ত যেখানে গেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন একজন মাইকম্যান। আমিও ছবি ছাড়িয়ে ভাবনা বিস্তার করি। এই আয়োজনের রাজনৈতিক ও আবেগী তৎপরতার বাইরে এক নিরাসক্ত মাইকম্যানের ছবি কল্পনায় আঁকতে চেষ্টা করি। কী করছে সে?
ততক্ষণে আমার নজর পড়ে যায় শ্রোতার বুকে সেঁটে থাকা কালো ব্যাজটির দিকে। শোক প্রকাশের স্মারক। বক্তার দিকে তাকাতেই দেখি তার পিঠে ঝোলানো একটি লাল ব্যাকপ্যাক। সাথে সাথেই আমার মনে হল, এই কালো ব্যাজ আর লাল পিঠব্যাগটাই এই ছবির মূল সিগনিফায়ার। শ্রোতার কালো ব্যাজখানা পরিষ্কার সিগনিফাই করে যে, তিনি এই সভার স্রেফ নির্দোষ শ্রোতা কিংবা রবাহুত কেউ নন। তিনি এই স্মরণসভার অন্যতম আয়োজক। আর বক্তা, যাকে পত্রিকা এই সভার “অতিথি” বলে লিখেছে, তিনিও প্রকৃতপক্ষে আয়োজকই হবেন। আমন্ত্রিত অতিথি হলে তিনি পোশাক-পরিচ্ছদে হয়ত আরেকটু তৈরি থাকতেন।
লাল ব্যাগ অনেক কিছুই সিগনিফাই করে। বলতেই হবে, ভাগ্যিস বৃষ্টির কারণে চত্বর ভিজে গিয়েছিল। ফলে আমাদের বক্তা তার ব্যাগটিকে পিঠে ঝোলানো ছাড়া আর উপায় খুঁজে পান নাই। আবার ব্যাগ বক্তার কাঁধে বহাল থেকে প্রমাণ করল (১) তিনি আমন্ত্রিত অতিথি নন, এবং (২) তার পেছনে আর কেউ নাই যাকে এটা গছিয়ে দিয়ে দু-পাঁচ মিনিট মাইকে দাঁড়াবেন।
লাল ব্যাগ, বক্তার বয়স এবং পিঠে ঝোলানোর ভঙ্গি আরো কিছু সিগনিফাই করে। স্পষ্টতই তিনি ঢাকার স্থায়ী অধিবাসী নন এবং মাইকে নিয়মিত দাঁড়ান না। যতদূর জানি, শহীদ আসাদ পরিষদ নরসিংদী-বেইজড সংগঠন। ওটা মান্নান ভূঁইয়ার নির্বাচনী এলাকাও বটে। ফলে, আমাদের আয়োজকদ্বয়ের অন্তত একজন যে নরসিংদী থেকেই এসেছেন এই অনুমান জোরালো হয়। শহীদ মিনার চত্বরে অনুষ্ঠান আয়োজনের যে রিচুয়াল তাতে এটাও বোঝা যায় যে, এদের একজন দিনকয়েক আগে ঢাকায় এসে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গেছেন। এ ধরনের অনুষ্ঠানের অনুমতি এবং মাইক কোম্পানির সাথে চুক্তির ধরন হচ্ছে সময়ভিত্তিক। ফলে, এই ছবিখানার দুর্লভরকম প্রতীকী হয়ে-ওঠার পেছনে শ্রাবণের আকস্মিক বর্ষণের যে কার্যকরী ভূমিকা ছিল তাও স্পষ্ট হতে থাকে।
এরকম একটি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিটা কীরকম হয়ে থাকে? শহীদ আসাদ পরিষদ একটি সামজিক সংগঠন, তার একটি কার্যনির্বাহী কমিটি আছে, সাধারণ সদস্য ও শুভাকাক্সক্ষী আছে, তাদের একটা অংশ ঢাকা শহরেও থাকেন এগুলো বৈধ অনুমান। ফলে প্রয়াত মান্নান ভুঁইয়া যার মৃত্যু তার রাজনৈতিক দল বিএনপি-কে কোনোভাবে সক্রিয় করতে পারেনি, তার গুণগ্রাহী এবং সম্ভাব্য দানগ্রাহী সংগঠন শহীদ আসাদ পরিষদ যখন একটি স্মরণসভার আয়োজন করবে, তাও আবার ঢাকায়, তখন সেখানে কিছু দর্শকের আগাম ব্যবস্থা তারা করেই আসবেন এটা স্বাভাবিক। হয়ত আয়োজনটি এমন ছিল যে, আয়োজকবৃন্দ নরসিংদী থেকে আসবেন, তাদের অধিকাংশই শহীদ আসাদ পরিষদের সাথে যুক্ত। আবার রাজনৈতিকভাবে বিএনপি-র সাথেও যুক্ত। মান্নান ভূঁইয়া যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন এদের অনেকই এর সুবিধাভোগী ছিলেন। কিন্তু এক-এগার'র ফলশ্রুতিতে তিনি যখন মূল বিএনপি থেকে বাদ পড়ে যান তখন এই সুবিধাভোগীরা দোটানায় পড়েন। মান্নান ভূঁইয়ার মার্জিনালাইজেশন এবং এর দীর্ঘস্থায়িত্ব তাদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছিল। ফলে, এই প্রেক্ষিতে, নেতার মৃত্যু নিশ্চয়ই তাদের এই দোটানা থেকে রেহাই দেবে। কিন্তু শেষকৃত্যের দোটানা? একদিকে দল নীরব, অন্যদিকে এলাকার নেতা, এলাকার মানসম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ! রেহাই দিল বৃষ্টি!
এই বৃষ্টিই অনুপস্থিত সদস্যদের জন্য চমৎকার অজুহাত তৈরি করে দিল। যে দুজনকে আমরা ছবিতে দেখলাম, তারা মোটামুটি পৌরাণিক সাহসে ভর করে ঢাকাগামী বাসে ওঠেছিলেন ঘোর বর্ষণ মাথায় নিয়ে। কেননা তারা জানতেন অনুষ্ঠানের সময় বেঁধে দেয়া আছে, সময় শেষ হয়ে গেলে মাইক অন্য জাযগায় ভাড়া চলে যাবে কোনো অজুহাত চলবে না। আগের দিন লিখিয়ে আনা ব্যানারটা ভাঁজ করে লাল ব্যাগে ঢুকিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন এই দুজন। ঢাকায় আসতে আসতে তারা নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন যে বাদবাকিরা বৃষ্টি থামতে থামতে নিশ্চয়ই পৌঁছাবে, অন্তত যাদের যাদের মোবাইল ফোন খোলা ছিল তাদের কাছ থেকে এরকম আশ্বাসই পাচ্ছিলেন।
তারপর তারা যখন পৌঁছুলেন, শহীদ মিনার তখন তাদের সামনে ট্রয়ের ময়দান। প্রলম্বিত বৃষ্টি, ফাঁকা চত্বর, মাইকম্যানের তাগাদা, আশ্বাস-দেয়া বন্ধুদের বন্ধ মোবাইল, সর্বোপরি রাজনৈতিক ভ্রƒকুটি। সহসাই তারা বুঝতে পারলেন যে বর্ষার ঘনঘোর ফাঁদ থেকে আজকে আর মান্নান ভুঁইয়ার স্মরণসভাটিকে বের করে আনতে পারবেন না। আর ওদিকে বৃষ্টি, যানজট আর জলজট মিলে অনুপস্থিত বন্ধুদের জন্য অজুহাতের চমৎকার পটভূমি তৈরি করেই রাখল। বৃষ্টিবন্দী মানুষ এতক্ষণে মুক্তি পেয়ে যার যার গন্তব্যের দিকে পাগলের মত ছুটছে। এই নিরাভরণ অমনোযোগের মধ্যেই তারা তাদের ঐতিহাসিক ও নিরুপায় ভূমিকাগুলোতে অবতীর্ণ হলেন।
এই দুজনের দিকে আবারো তাকাই। খেয়াল করি, তাদের হাতগুলো অবলম্বন খুঁজছে। একজনার ক্ষেত্রে কোমরের পেছনে, অন্যজনার ক্ষেত্রে কোমরে সামনে। রাজনৈতিক আর প্রাকৃতিক ভ্রুকুটির বিপরীতে নিজেদের প্রতিশ্রুতির সামনে বিরামচিহ্নের মত নিরালম্ব হয়ে পড়েছে দুজন ব্যক্তিমানুষ। অথচ অন্যরকম হতেই পারত। বিকালবেলার শহীদ মিনার এমন জনশূন্য নাও থাকতে পারত। চত্বরে পা ছড়িয়ে বসে বাদাম চিবাতে চিবাতে সময় কাটাতে পারত দুচার-ডজন লোক। কিছু উৎসাহী পথচারী মাইকের শব্দ শুনে মিনিট পাঁচ-দশ থমকাতে পারত। আসতে পারত টিভি ক্যামেরা, কিংবা শখের হ্যান্ডিক্যাম। কে জানত, কী ছিল বর্ষার ঘনঘোর মনে?
.............
পোস্ট স্ক্রিপ্টাম
..
এই আলোকচিত্র কী সিগনিফাই করে? প্রথমেই বলে নেয়া ভাল এটা কোনো গোয়েন্দা রিপোর্ট নয়, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় পঠনও নয়। একে চিহ্নশাস্ত্রীয় পঠন বলা যেতে পারে। চিহ্নশাস্ত্রীয় রীতি অনুসারে, এটা বাস্তবের বিবৃতি নয়, বরং এই ছবি যে-বাস্তবতাকে “উৎপাদন” করছে তার বিবৃতি।
বিতর্কিত এক-এগারো এবং তাতে মান্নান ভূঁইয়ার মত নেতার ভূমিকা নিয়ে প্রচুর আলোচনা আছে সেসবের পুনরাবৃত্তি না করি। বলা হয়ে থাকে, এক-এগারো দুর্নীতি ও পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার নাম করে রাজনৈতিকতা ও গণতন্ত্রের বিরূদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছিল। মজার বিষয় হল, মিলিটারি-কর্পোরেট-মাল্টিন্যাশনাল টেকনোক্রেসির এই ফর্মূলা সেই সময় যেসব রাজনৈতিক নেতা গিলেছিলেন (বা গিলতে বাধ্য হয়েছিলেন), তাদের প্রায়-কারোরই ভোটাভুটির রাজনীতি দিয়ে হাতেখড়ি হয় নি। তারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রথম যৌবনে, তারপর পাল্টি খেয়ে জীবন কাটিয়েছেন গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায়। আর জীবনসায়াহ্নে এ ধরনের পটপরিবর্তনের স্বপ্নের মধ্যে হয়ত প্রথম জীবনে দেখা স্বপ্নের কিঞ্চিৎ উত্তেজনা খুঁজে পেয়েছিলেন।
এক-এগারো’র ব্যর্থতা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশকে। তেমনি সুফল এনে দিয়েছে আনুগত্যের রাজনীতির জন্য। মুক্তি-পাওয়া শিশু দলতন্ত্র, বিষম খেয়ে ধাতস্ত পরিবারতন্ত্র, আর সদাসজাগ দুর্নীতি মিলে আগামী বাংলাদেশের যে সংসদীয় রাজনীতি, সেটা তার টিকে-থাকার স্থায়ী বর্ম খুঁজবে শর্তহীন আনুগত্যের মধ্যে। এই ছবি, তার অন্তর্গত বিষাদ, তার নিরালম্ব ঐতিহাসিকতা, তার কুশীলবের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতির রাজনীতির মাধ্যমে এটাই সিগনিফাই করে।
২০১০ ব্রিসবেন
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন