কমলা রঙের ঈদ

২৪৯ পঠিত ... ১৬:৪৬, মার্চ ২২, ২০২৫

40

লেখা: পলা নাজ

পড়াশোনার জন্য বহুদিন ধরে বিদেশে থাকতে হয়েছে। এখনও আছি, তবে পড়ালেখার পাট চুকে গেছে। দেশমাতৃকার মাটি ছুঁই না বহুবছর | সে অর্থে প্রবাসী বলাই যেতে পারে আমাকে।

বিদেশে পিএইচডি শুরু করবার এক বছরের মাথায় আমার প্রবাস জীবনের স্বপ্ন ভেঙে গেল। সদ্য বাবাকে হারিয়েছি, দেশে রেখে এসেছি একলা মাকে। নিরুপায় আমি। ধীরে ধীরে একা হতে শুরু করলাম। আমাকে এগিয়ে দিতে এয়ারপোর্টে আসা বাবার হাত ধরে থাকার স্মৃতিই তার সঙ্গে আমার শেষ স্পর্শের স্মৃতি। এরপর ভিডিও কলে কথা হয়েছে বহুবার, কিন্তু তাকে ছুঁতে আর পারিনি। আমার কাছে তখন রাত আর দিন বলে আলাদা কিছু ছিল না। কেবলই পড়াশোনা করা আর ‘বাবা নেই’ এই অসম্ভব বাস্তবকে মেনে নেওয়া ছাড়া | ইদ এল কী গেল, তাতে আমার কিছুই আসত যেত না। মনে পড়ে, ওই সময়টায় আমি স্রষ্টার উপাসনায় কঠোর হয়েছিলাম, বুঝিবা আকাশের অপর প্রান্তে বাবাকে একটু ভালো রাখতে চাওয়ার আশায়। রোজা রাখতাম নিয়মিত, কিন্তু ইদের আনন্দ ভুলতে বসেছিলাম প্রায়। দেশে থাকা বন্ধুদের আর আত্মীয়-স্বজনদের দেওয়া হাসি হাসি মুখের ইদের ছবিতে ফেসবুক ছেয়ে যায়, কিছুই আমাকে দোলা দেয় না। লাল, হলুদ, কমলা, সবুজ রঙের ছোট্টোবেলার সেই আনন্দের ইদের ছুটিগুলি কোথায় যে হারিয়ে গেল!

তবু রমজান তার নিয়মেই আসতো। মনে পরে, ইউনিভার্সিটির ‘প্রেয়ার হাব’ এ রমজানের সময়কার জুম্মার নামাজের কথা। সেখানে পরিচয় হয়েছিল যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিরিয়া থেকে আসা একজন মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটির দারুণ মনোবল আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ভাবাই যায় না তার জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার কথা। সেই জায়গা থেকে কী বিপুল তারুণ্য আর সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে সে। ঠিক তারই মতো যুদ্ধবিদ্ধস্ত আরেক দেশ থেকে এসেছিল মিয়া (ছদ্মনাম)। মিয়ার জীবন নিয়ে খুব সরল চিন্তাধারাও আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, এইসব মেয়েরা কেমন করে এত মানসিক শক্তি পায়, যেখানে জীবন তাদের কাছে বিভীষিকাময় কিছু স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা কিন্তু তাদের পেছনে ফেলে আসা জীবনটাকে ভুলে যায়নি, শুধু শক্তি সঞ্চয় করে সামনে এগিয়ে গেছে। গাজায় বসবাসকারী নারী, শিশু ও পুরুষদের মনোবল কেন এত শক্ত তার পাঠ আমি তখনই পেয়েছিলাম।

ইউনিভার্সিটির খুব কাছে, মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্যোগে প্রতি রমজানের সন্ধ্যায়ই আয়োজিত হতো ইফতার। আমি আমার ফ্ল্যাটমেটকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে। চীন থেকে আসা সেই অমুসলিম মেয়েটি এত সুন্দর আয়োজন আর ফ্রি ইফতার দেখে এত খুশি হয়েছিল, যে পরদিন লাঞ্চে খাবার জন্য সে আরেক প্যাকেট ফ্রি ইফতার চেয়ে নিলো। মুসলিমদের পাশাপাশি নানা দেশ থেকে আসা প্রচুর অমুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরাও সেখানে অংশ নেয়। কোনো বাধা নেই।

ছাত্রজীবনের শেষদিকে এসে আমি এক রমজানে ঠিক করলাম, এবার ইদে এলাহী আয়োজন করব। মেহমান মাত্র একজন, ইরানি একজন বান্ধবী। তবুও, ছোট্টোবেলার ইদের স্মৃতি কিছুটা হলেও ফেরাতে চেয়েছিলাম। আমি ততদিনে রান্নায় কিঞ্চিৎ সুনাম কুড়িয়েছি। আমার এত আয়োজন দেখে বান্ধবীটি খুব অবাক। কঠোর ইসলামী অনুশাসনের জন্যেই খুব সম্ভবত ইরানে ইদ ততটা আনন্দের নয়, যতটা আনন্দের নওরোজ। জোর করে ধর্ম চাপিয়ে দেবার ফল বুঝিবা এমনই হয়। সেই ইদ আয়োজন করতে গিয়ে মনে হলো, এবারের ইদ কি কিছুটা হলেও কমলা রঙের? হয়তোবা ফিরে এল সেই ছোট্টোবেলার বর্ণিল ইদ—অন্তত কিছুটা!  

তারপর পরিবারের সঙ্গে ইদ করেছি প্রবাসে, সবাই মিলে। দেশের ইদের সিকিভাগ মজাও তাতে হয় না। সব থেকে খারাপ লাগে, যখন দেখি শুধুমাত্র উন্নত জীবনের আশায় এসাইলাম নিতে আসা মানুষের দুর্ভোগ। তারা এক অনিশ্চয়তায় বসবাস করে, দেশে ফেলে আসে পরিবার, প্রবাসেও খুব টাকার অভাবে থাকে। বাঙালি গ্রোসারি শপে তাদের জন্য এক ডলারে মাছের মাথা বিক্রি করতে দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। এসব দেখে ভাবি আমার সেই কমলা রঙের ইদটাই কি ভালো ছিল না?

২৪৯ পঠিত ... ১৬:৪৬, মার্চ ২২, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top