প্রায়ই স্বপ্নে দেখি, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলছে

১১৭৮ পঠিত ... ১৩:৫৯, জুন ২৭, ২০১৮

আমার বন্ধু-কন্যা লীনা টেলিফোন করেছে। তার গলার স্বর ভারী ও বিষণ্ন। আমি বললাম, কী হয়েছে রে? সে বলল, চাচা, আজ কি কোনো কারণে আপনার মন খারাপ? আমি অবাক হয়ে বললাম, কই, না তো।

‘ঠিকমতো ভেবে তারপর বলুন। হুট করে বলবেন না।’

‘না, আমি ভালোই আছি। আমার মন খারাপ করার মতো কিছু কি ঘটেছে?’

‘বাংলাদেশ যে মালদ্বীপের সঙ্গে ফুটবল খেলায় ড্র করল, এতে আপনার মন খারাপ হয়নি?’

‘ও আচ্ছা, তা মন খারাপ কিছুটা হয়েছে।’

‘আপনি কি এই মন খারাপের কারণে আপনার মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন?’

‘ওদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব কেন? ওরা তো আর ড্র করেনি।’

‘তাহলে বাবা কেন আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে? বাবা কেন শুধু শুধু আমাকে চড় মারল?

টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে কান্নার শব্দ আসতে লাগল। হাউমাউ ধরনের কান্না। এতক্ষণে রহস্য ভেদ হলো। বোঝা যাচ্ছে, মালদ্বীপের সঙ্গে ড্র করার পর আমার বন্ধু রফিকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বাড়িতে মারধর শুরু করেছে। রফিকের ক্ষেত্রে এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক। ফুটবল আছে তার শয়নে, স্বপনে, চিন্তায় ও নিন্দ্রায়। লিগের খেলা হচ্ছে আর সে মাঠে নেই, এ হতেই পারে না।

তার পাল্লায় পড়ে একবার লিগ ফাইনাল দেখতে গিয়েছি। তার প্রিয় দল তেমন সুবিধা করতে পারছে না। তাকিয়ে দেখি তার চেহারা বিবর্ণ। বিড়বিড় করে কী সব দোয়া পড়ছে। একসময় সে তার পাঞ্জাবির সব বোতাম খুলে ফেলল। পায়জামার ফিতার গিঁট আলগা করে দিল। আমি হতভম্ব। হচ্ছে কী? রফিক বলল, ‘কুসাইত’ লেগে গেছে। এই সব করলে ‘কু’ কাটা যায়।

সেদিন পায়জামার ফিতা খোলার জন্যেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক রফিকের দল জিতে গেল। অবাক হয়ে তার আনন্দ প্রকাশের ভঙ্গি দেখলাম। তিন ছেলেমেয়ের বাবা, একটা কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়ায়, সেই লোক খালি গা হয়ে তার পাঞ্জাবি একবার আকাশে ছুড়ে মারছে আর লুফে নিচ্ছে। মুখে চিঁহি ধরনের শব্দ করছে, যে শব্দ ঘোড়ার মুখেই মানায়। আমি বলতে বাধ্য হলাম, ‘তুই পাগল হয়ে গেলি নাকি? সামান্য একটা খেলা।’

রফিক চোখ লাল করে বলল, ‘উইথড্র ইয়োর ওয়ার্ড। ফুটবল কোনো খেলা না, ফুটবল হলো লাইফ?’

বাঙালি ফুটবলের ব্যাপারে স্পর্শকাতর তা জানি। নব্বইয়ের বিশ্বকাপের পরপর ‘অয়োময়’ নাকের শুটিংয়ের জন্যে পুরো দলবল নিয়ে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম। শুটিং চলছে। হঠাত্ শুনি, রাস্তায় বিকট চিত্কার, ভয়াবহ হইচই। শুটিং বন্ধ করতে হলো। দেখা গেল, মিছিল বের হয়েছে। মিছিলের মানুষ স্লোগান দিচ্ছে, ‘মানি না। মানি না। বিশ্বকাপের সিদ্ধান্ত মানি না।’ ব্যাপার হলো, আর্জেন্টিনার পরাজয় তারা মানে না।

এই জন্যেই মিছিল। কোথায় বিশ্বকাপ আর কোথায় বাংলাদেশের এক মফস্বল শহরের মিছিল। ফুটবল নিয়ে কোন পর্যায়ের স্পর্শকাতরতা থাকলে এ-জাতীয় পাগলামি করা যায় তা সহজেই অনুমেয়। সেই স্পর্শকাতরতা যে কোন ধরনের তা রফিককে খুব কাছ থেকে না দেখলে জানা যেত না। কাজেই আমি বন্ধু-কন্যার কান্নায় বিস্মিত হলাম না। লীনাকে বললাম তার বাবাকে টেলিফোন দিতে। লীনা কাঁদতে কাঁদতেই তার বাবাকে ডাকতে গেল।

‘রফিক, কী হয়েছে?’

‘কিছু হয়নি। হবে আবার কি?’

‘তুই ভালো তো?’

‘হু।’

‘খুব নাকি হইচই করছিস? বাংলাদেশ মালদ্বীপের সঙ্গে ড্র করেছে তো কী হয়েছে?’

‘তোর কাছে এটা খুব সামান্য ব্যাপার মনে হচ্ছে?’

‘দুঃখজনক ব্যাপার তো বটেই। তবে ড্র করার পরের খেলাগুলো ভালো হবে। বাংলাদেশি প্লেয়াররা লজ্জা পেয়ে জান দিয়ে খেলবে। দেখবি নেপালকে হারিয়ে ভূত বানিয়ে দেবে। এই ড্রটা আমাদের জন্যে শাপে বর হয়েছে।’

‘কথাটা মন্দ বলিসনি।’

‘রাগারাগি, হইচই বন্ধ করে স্বাভাবিক হ।’

‘মালদ্বীপের সঙ্গে ড্রয়ের পর মনটা এত খারাপ হয়েছিল, ইচ্ছা করছিল সেলুনে গিয়ে নিজের মাথাই কামিয়ে ফেলি। কী অপমান!’

‘অপমানের কিছু না। অঘটন ফুটবলে মাঝে মাঝে ঘটে। দেখবি, ফুটবলে সোনা এবার আসবে আমাদের ঘরে।’

‘ইনশা আল্লাহ বল দোস্ত। ইনশা আল্লাহ না বললে শেষে—’

আমি ইনশা আল্লাহ বললাম। রফিকের আনন্দের সীমা রইল না। সেও আমার সঙ্গে এক শ ভাগ একমত হলো, এবারের সোনা আমাদের।

বাংলাদেশ হারল নেপালের কাছে। আমাদের ফুটবল টিম পুরো জাতিকে বিরাট লজ্জায় ফেলে দিল। আমার নিজেরই এত খারাপ লাগছে, রফিকের না জানি কেমন লাগছে। তার বাসায় টেলিফোন করলাম। সে টেলিফোন ধরল না। তার স্ত্রী জানাল, রফিক আজ খেলা জেতার জন্যে মানত করে রোজা রেখেছিল। এখন ঘর অন্ধকার করে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে। কারও সঙ্গে কথা বলছে না।

‘রাগারাগি করছে না তো?’

‘না। তা করছে না। ভাই, আপনি একবার আসুন। তার সঙ্গে কথা বলে তাকে শান্ত করে যান।’

‘আচ্ছা আমি আসছি।’

আমি রফিককে শান্ত করার জন্যে যাচ্ছি। রিকশা নিয়েছি। রিকশাওয়ালা বলল, ‘ঘটনা কি হইছে দেখছেন স্যার? ভালোমতো কেউ খেলে নাই। পা-ও বাঁচাইয়া খেলছে।’

‘পা বাঁচিয়ে খেলাটা কী?’

‘সামনে লিগের খেলা। পা জখম হইলে খেলব কী? আর না খেললে লাখ টেকা ক্যামনে পাইব?’

পরাজয়ের দুঃখে রিকশাওয়ালা কাতর। শুধু রিকশাওয়ালা নয়, পুরো জাতি আজ বিষণ্ন। এই বিষণ্নতা কি আমাদের লাখ টাকা দামি খেলোয়াড়দের স্পর্শ করেছে? আজ তাঁরা কেমন আছেন সোনারগাঁও হোটেলে? তাঁরা কি সত্যি সত্যি জানেন বাতাসভরা ছোট একটা চামড়ার বল নিয়ে ছোটাছুটির এই খেলার সঙ্গেও জাতির আত্মা মিশে যেতে পারে? যদি জানেন, তাহলে কেন এই মৃত্যুসম পরাজয়?

নেদারল্যান্ডের এক সাহেব একবার আমাকে বলেছিল, ‘তোমরা এই খেলাটা খেলতে পারো না। তার পরেও এই খেলার প্রতি তোমাদের এত মমতা কেন? কারণটা কী?’

আমি সাহেবকে বললাম, ‘বাংলাদেশ মানেই বর্ষা, আর বর্ষা মানেই ফুটবল?’

‘তার মানে?’

‘মানে তুমি বুঝবে না। বাদ দাও?’

সাহেবের সঙ্গে বকবক করতে ইচ্ছা করেনি। ইচ্ছা করলে বলা যেত—এই খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ফেলে আসা শৈশব। ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ছে, একদল কিশোর বাতাবিলেবু নিয়ে নেমে পড়েছে মাঠে। যে যেদিকে পারছে, কিক বসাচ্ছে। উত্তেজনার সীমা নেই। কাদায় গড়াগড়ি, পানিতে গড়াগড়ি। বাতাবিলেবুর স্টেজ পার হলো, চাঁদা তুলে কেনা হলো প্রথম চামড়ার ফুটবল। চামড়া নরম করার জন্য সেই ফুটবলে মাখন নিয়ে ঘষাঘষি। কী আনন্দ। কী আনন্দ। গঠন করা হলো ফুটবল ক্লাব। সব ইংরেজি নাম—গ্রিন বয়েজ ক্লাব, টাইগার ক্লাব,...

টেলিভিশনে বিশ্বকাপের খেলা যখন দেখি তখন মনে হয় এরা তো আমাদের খেলা খেলছে, আমরা কেন খেলছি না?

বলা হয়, আমাদের শারীরিক যোগ্যতা নেই। আমাদের দম থাকে না।

তার মানে কী? ফুটবল খেলতে হলে দৈত্য হতে হবে? আর আমাদের দম না থাকলে কাদের থাকবে?

বলা হয়, আমাদের খেলোয়াড়েরা ফুটবলের আধুনিক কৌশল জানেন না।

কৌশল জানেন না, শিখবেন। আমরা কি বেকুবের জাত যে শিখতেও পারব না?

আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখি, বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলছে। এগারোজন খেলোয়াড় তাঁদের জার্সির ভেতর বাংলাদেশের হৃদয়কে নিয়ে খেলতে নেমেছেন। ওই তো বাংলাদেশ ছুটে যাচ্ছে গোলপোস্টের দিকে। কার সাধ্য তাদের রুখে ?

১১৭৮ পঠিত ... ১৩:৫৯, জুন ২৭, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top