একটি পাড়ার চায়ের দোকানে বাজেট চলাকালীন আলাপ এবং বিশ্লেষণসমগ্র

২৩৩৩ পঠিত ... ১৪:২৪, জুন ১০, ২০১৮

টিভিতে বাজেট অধিবেশন চলছে। দেশের আগামী এক বছরের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা জানাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব। উনি বেশ ফুরফুরে মুডে আছেন। কিছুদিন আগেই বলেছেন, আমার পরিকল্পনায় দেশ যে অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে, এখন মরেও সুখ।

এ কথাটা শোনার পর থেকেই সুখি নাগরিক জোট ও সুখি সাংবাদিক সমিতির লোকেদের মন অজানা আনন্দে মাতোয়ারা। তাই অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করার আগেই তারা এ বাজেটকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার, বিবৃতি লিখে, রঙ্গিন পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করিয়ে প্রস্তুত করে রেখেছেন। বাজেট বক্তৃতা শেষ হওয়া মাত্র আনন্দ র‍্যালিতে বেরিয়ে পড়বেন তারা।

ওদিকে চির-অসুখি কিন্তু গণভবনের ইফতারের দাওয়াতে সুখি রাজনীতিকদের এ বাজেট প্রত্যাখান করে ব্যানার, বিবৃতি লিখে, রঙ্গিন পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করিয়ে প্রস্তুত করে রাখা আছে। র‍্যালিতে বের হতে হবে অসন্তোষ প্রকাশে। ফলে তাদের এ বাজেট বক্তৃতা খুব একটা দেখতেই হয় না।

কিন্তু টিংটিঙ-এ চায়ের দোকানে ছোট একটা টিভি লাগিয়ে বাজেট বক্তৃতা দেখতে মানুষের জীবনে ঢল নেমেছে।

জনপ্রশাসনের লোকজনকে আরো স্বচ্ছন্দ জীবন দিতে তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি। আর স্বাভাবিক নিয়মে সামরিক খাতে বরাদ্দ সর্বোচ্চ।

অলংকরণ: সামির

চায়ের দোকানে বসা এক অশীতিপর বৃদ্ধ বলেন, 'পাকিস্তান আমলে এই আর্মি আর সরকারি চাকুরেদের পেছনে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দিতো রাওয়ালপিন্ডি প্রশাসন। আমাদের বাংলাদেশের এইটারে কি ভাওয়াল পিন্ডি প্রশাসন বলবো নাকি! ফাজলেমি করার জায়গা পায় না।'

চায়ের দোকানদার বলে, 'খালি দেইখা যাবেন চাচা। কমেন্ট্রি দেয়ার দরকার নাই। চারিদিকে টিকটিকি। ধইরা নিয়া গিয়া ফুটটুস কইরা দিবো। আপনের ডেডবডির পাশে একটা পিস্তল আর ইয়াবা রাইখা কইবো আপনে মাদক-ব্যবসায়ী। আর কয়দিনই বা বাঁচবেন চাচা। খুব অস্থির লাগলে মসজিদে যান। ঐখানে সামান্য ঠান্ডা বাতাসের অনুমোদন বাজেটে আছে।'

ছোট ফ্ল্যাট-বাড়ি কেনার খরচ বাড়ছে; কিন্তু আলিশান ফ্ল্যাট কেনার খরচ একই থাকছে।

দাঁড়িয়ে থাকা অফিস ফেরত এক যুবক বলে, এ শহরে মধ্যবিত্তের আর থাকার উপায় নাই। ইচ্ছা ছিলো একটা ছোট ফ্ল্যাট কেনার।

চায়ের দোকানদার বলে, 'এই শহরে শুধু আমরা নিম্নবিত্তরা থাকুম সাহেব গো সার্ভিস দিতে। বড় ফ্ল্যাট কিনতে না পারলে ঢাকা ত্যাগ করুন ভাইয়া।'
অশীতিপর বৃদ্ধটি বলে, সরকারি কর্মচারিদের গৃহনির্মাণের জন্য সহজ-শর্তে ঋণ ঠিকই দিচ্ছে।

অফিস ফেরত যুবকটি বলে, 'আমরা বেসরকারি সেক্টরের লোকেরা মারা পড়বো। আমাদের বেতনের ওপর যেভাবে কর বসিয়েছে; আমরা জীবন পানি করা পয়সায় আমলা-আর্মি পুষবো; যারা আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে। পুলিশ তো আজকাল দেহতল্লাশির নামে পকেটে ইয়াবা গুঁজে দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। কী করে বাঁচবো জানি না।

চায়ের দোকানদার বলে, 'আপনে তো স্মার্ট লোক; পারলে কাইটা পড়েন ভাইজান, একটু কষ্ট কইরা ইউরোপ-এমিরিকার দিকে চইলা যাইতে পারলে; জান্নাত পাইয়া যাবেন।'
এক তিরিক্ষি লোক চেঁচিয়ে বলে, 'রাখেন তো প্যাচাল। সব এক একজন টক শো এক্সপার্ট আইয়া পড়ছে। এক্সপার্টগো অত্যাচারে টিভি দেখি না। অহন চায়ের দোকানে আওন বন্ধ করতে হইবো মনে কয়।'
চায়ের দোকানদার ঠোঁটের সামনে তর্জনী রেখে বলে, চুপ করেন ভাইজানেরা। মন দিয়া হোনেন বুইড়া কী কয়!

অর্থমন্ত্রী বলেন, 'জাতীয় বাজেটের ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা জোগাড় করতে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা কর আদায় করতে হবে।'
যুবকটি বলে, 'বাকি রাখা খাজনা, বেশি ভালো কাজ না।' অর্থমন্ত্রী বলেন, '১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা ঘাটতি রয়ে যাবে।' চাখানার অশীতিপর বৃদ্ধ বলেন, 'বৈদেশিক ঋণ আর ব্যাংকের কাছে হাওলাত নেবে। ব্যাংকগুলোকে ঝাঁঝরা করে ছেড়ে দেবে।'

অলংকরণ: সামির

চায়ের দোকানদার বলে, 'আপনারে না মসজিদে যাইতে বললাম চাচা। জনগণ হইতাছে মুরগা; এইটারে ওরা কোন দিক দিয়া কাইটা কে রানের গোশত খাইবো-কে বুকের গোশতো খাইবো; হেইডা হ্যাগো ব্যাপার।'

টকশো ঘৃণাকারী ভদ্রলোক বলেন, 'আপনারা অনুমতি দিলে একটা কথা বলি।' চায়ের দোকানদার বলে, 'এতক্ষণে বুঝলেন চায়ের দোকানে একটু কথা-বার্তা না কইলে মজা হয় না। কন কন।' লোকটা বলেন, 'এই বাজেটটা হইতে বিলাইয়ের খাঁচায় বাঘ রাখনের চেষ্টা।'

কম্পিউটারের দাম বাড়বে বাজেট বক্তৃতায় এ কথা শুনেই এক তরুণ বলে, 'শিট এইটা নাকি ডিজিটাল বাংলাদেশের বাজেট।' চায়ের দোকানী বলে, 'আপনেরাও ভাইজান ফেসবুক খুব জ্বালাইতেছেন সরকার বাহাদুররে। যা করতেছে করতে দেন না। অগো লম্বা মধুচন্দ্রিমায় আপনেরা আলকাতরা ঢাইলা দিয়া কী লাভ! টেকাটুকা তো উইড়া উইড়া বিদ্যাশে যাইতেছে। বিদেশে বাড়ি-ঘর কইরা বাচ্চা-কাচ্চা পাঠাইয়া দিছে জমিদারেরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে টেকাটুকা নিয়া গেছে; তার চেয়ে বেশি টেকাটুকা এরা নিয়া গেছে।'

অশীতিপর বৃদ্ধ বলে, 'এইগুলি হইতেছে ঘরের শত্রু বিভীষণ।'

অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় বোঝা যায় স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ সামান্য কমেছে।

অফিস ফেরত যুবক বলে, 'নিজেরা খেয়ে বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট স্বাস্থ্যবান হয়েছে; আর কথায় কথায় বিদেশে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে যায়। দেশের হাসপাতালের দিকে তাকানোর দরকার কী!'

অশীতিপর ভদ্রলোক চা-দোকানীকে জিজ্ঞেস করেন, 'দশ বছরে জিনিসের দাম চার-পাঁচ গুণ বেড়েছে; এটা জানতে নিশ্চয়ই পরিসংখ্যান বুড়োর কাছে যেতে হবে না। প্রত্যেকদিন বাজারে যাই। জ্বর হলে মানুষ যেমন থার্মোমিটারে তাকিয়ে জ্বর মাপে; আমি তেমনি মেপেছি বাজার দর।'

তরুণ বলে, 'অবশ্য ফাইভ স্টার হোটেলে পার্টি করার খরচ বেড়েছে।'

যুবক উত্তর দেয়, 'ভাওয়ালপিন্ডিতে এদের সবার একটা করে ফাইভ স্টার সামার হাউজ তৈরি হয়ে গেছে। হোটেলে যাওয়ার দরকার নাই জন্য পার্টির খরচ বাড়াইছে। বিদেশীদের পকেট ঝেড়ে টাকা-পয়সা নিয়ে নেবে। এইদেশে পর্যটকের সংখ্যা কমবে।

টকশো অপছন্দকারী ব্যক্তি বলে, 'আমার একটাই ক্ষোভ এই বাজেট সম্পর্কে।' সবাই উৎসুক চোখে তাকায়। লোকটা বলে, 'দেশে যেই হারে তেল দেয়া বাড়ছে; তেলের ওপর ভ্যাট বসাইলো না ক্যানো! দেশ তো ত্যালে ভাইসা যাইবো।'

যুবক বলে, 'অর্থনীতি মানেই চাহিদা ও জোগানের সম্পর্ক।' প্রধানমন্ত্রীর এক একটা প্রেস কনফারেন্সে যে বিশাল তেলের খনি তৈরি হয়; এতো বড় তেলের খনি তো সৌদি আরবেও নাই। তেলের এতো জোগান; ভ্যাট বসিয়ে "তেলের বিনিময়ে খাদ্য" প্রকল্পের তেলের খনির শ্রমিকদের বেকার করে দেয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই চাকরির বাজারে যে হা-হুতাশ।'

অর্থমন্ত্রী এভারেস্ট জয়ের আনন্দ নিয়ে বাজেট বক্তৃতা শেষ করেন। পরম পরিতৃপ্তি নিয়ে বলেন, 'এবার আমি অবসরে যাবো।'

চায়ের দোকানের অশীতিপর বৃদ্ধটি বলে, '২০১৫ থেকে সঞ্চয়পত্রের লাভের হার কমিয়ে চোরের খনিতে আমাদের মতো বেকুব বুড়োদের যেভাবে পথে নামিয়ে দিয়েছেন, এর চেয়ে চলুন একসঙ্গে "অন্তর্জলী যাত্রা" করা যাক।'

অর্থমন্ত্রী টিভির সরাসরি সম্প্রচারে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, 'কী বাজেটটা খুব সুন্দর, তাই না!'

২৩৩৩ পঠিত ... ১৪:২৪, জুন ১০, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top