স্বাধীন বাংলাদেশে সম্পদের সীমাহীন বৈষম্য আর জন অভিমত শাসকের কাছে গুরুত্বহীন হওয়ায় জনমানসে গভীর হীনমন্যতা তৈরি হয়েছে। যে কারণে অবৈধপথে সম্পদ অর্জন আর নিজস্ব অভিমতে অনড় পাথর হয়ে থাকার ম্যাগালোম্যানিয়া তৈরি হয়েছে। যে অভিমতের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি না মিললেই সে রেগে কাঁই হয়ে যায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কর্মী সংগ্রহের ক্ষেত্রে অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনের লোভ আর একটি অভিমতের পক্ষে শিং ঘষার উপযোগী তালগাছ মানসকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
যে দেশে মৌলিক মানবাধিকার পূরণের নিশ্চয়তা আছে; সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্য আছে; সেখানে যুক্তিবোধ বিকশিত হয়; ভিন্নমত শোনার মতো সহিষ্ণু মানস আছে; ফলে সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হবার পরিবেশ আছে।
বাংলাদেশে শিশুরা ইংরেজি মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম ও আরবি-উর্দু মিডিয়ামে ত্রিধাবিভক্ত হয়ে শিক্ষালাভ করে। আর জনসংখ্যার বড় অংশ কোনোরকম শিক্ষার সুযোগ না পেয়ে বড় হয়। এরফলে চাররকম মানসিকতার লোক একইসঙ্গে বসবাস করে।
বাংলা মিডিয়ামে যারা পড়ে; তাদের একটি অংশ বৃটিশ আমলে কলকাতায় নির্মাণ করা বাঙালি সংস্কৃতি রপ্ত করে। এদের আচার-আচরণে বৃটিশ মিডলম্যান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারদের মতো একটি হাবভাব তৈরি হয়। এরা তাদের নতুন রপ্ত করা বাংলা সংস্কৃতি শেখাতে চেষ্টা করে। সামনের লোকটির দাদা হয়তো রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন অবসরে। কিন্তু প্রথম প্রজন্মের রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত সামনের লোকটি সম্পর্কে কিছুই না জেনে তাকে রবীন্দ্র শিক্ষা দিতে উদ্যত হয়। এরকম হাস্যকর একটি পরিস্থিতি বিরাজ করে নতুন রবীন্দ্র সংস্কৃতি মহলে।
আরবি ও উর্দু মিডিয়ামে যারা পড়ে; তাদের একটি অংশ সৌদি আরবে পশ্চিমা প্রণোদনায় নির্মিত ওয়াহাবী সংস্কৃতি রপ্ত করে। এদের আচার আচরণে সৌদি মিডলম্যান অনুদান বন্দোবস্তের ধর্মের ম্যানেজারের একটি হাবভাব তৈরি হয়। এরা লোকজনকে ঈমান ও তাওহিদ শেখাতে চেষ্টা করে। সামনের লোকটির দাদার বাবা হয়তো সেইকালে জল জাহাজে চড়ে মক্কা থেকে হজ্জ্ব করে এসেছেন। মুসলিম দর্শন পাঠ করতেন অবসরে। কিন্তু প্রথম প্রজন্মের ইসলাম শিক্ষিত সামনের লোকটি সম্পর্কে কিছুই না জেনে তাকে ইসলাম শিক্ষা দিতে উদ্যত হয়। এরকম একটি হাস্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করে নতুন ইসলাম শিক্ষিত মহলে।
বৃটিশ আমলে সম্পন্ন কৃষক ও কারিগর সমাজকে দুঃস্থ করে ফেলা হয়। সেই যে বাঙালির উদার মানসে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে; আজও আমরা সেই অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছি। বৃটিশ কোলাবরেটর চিরস্থায়ী জমিদারদের নিষ্পেষণে মানুষ আত্মবিশ্বাস হারায়। সেই আত্মবিশ্বাসহীন সমাজ কষ্টেসৃষ্টে রবীন্দ্রনাথ অথবা ইসলাম শিখে; চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হতে চেষ্টা করে। যেহেতু এরা ভূমিহীন ও নিঃস্ব; তাই আঙুল উঁচিয়ে যাকে তাকে পাকিস্তান ও ভারত চলে যেতে নির্দেশ দেয়। এই যে দারিদ্র্যে বিশীর্ণ কর্কশ শৈশবে বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়েরা; তারা আওয়ামীলীগ বা জামায়াতের বন্দোবস্তী নিয়ে নতুন জমিদার হবার স্বপ্নে বিভোর।
এদের শৈশবের একটি জিনিস কমন; এরা চৌধুরীদের বাড়ির রাস উৎসব লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল। সেই থেকে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা তৈরি হয়েছে তাদের মাঝে। মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলীর নৌকা চড়ে এরা ওয়েস্টইনে পাপিয়ার আসরে যায়; অথবা দাঁড়িপাল্লায় ভর দিয়ে মদিনা গিয়ে সেলফি তোলে।
বৃটিশেরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে হিন্দু জমিদার তৈরি করলেও; সুলতানি-মুঘল-নবাবি আমলে দেওয়ানি লাভ করা বেশ কিছু সম্পন্ন মুসলমান পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে রয়ে গিয়েছিল। যে পরিবারগুলো বাংলা-আরবি-ফার্সির মতোই দ্রুততার সঙ্গে ইংরেজি শিখে ফেলেছিল। ফলে বৃটিশ আমলে এসব পরিবারের লোক আইনব্যবসায়ী, পরিবহন ব্যবসায়ী, চা-বাগানের ম্যানেজার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিল। শত শত বছরের পুরোনো পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে এরা সিম্পল লিভিং ও হাই থিংকিং-এর লোক।
কিন্তু কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁর কারণে অনেক পরে রুলিং অ্যালিট হওয়া হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি অংশের ধারণা; তারাই বঙ্গে সভ্যতা এনেছে। সেই আবেশে প্রথম প্রজন্মে শিক্ষিত হয়ে একটু প্রতিষ্ঠা পেয়ে হিন্দু পরিবারের কিছু ছেলে ফেসবুকে বংকিমচন্দ্র ও ডি এল রায় হয়ে ঘুরে। এইসব দৃশ্য হাস্যকর তো বটেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গভীর দুঃখ আসে এদের জন্য; কী এক জমিদারির স্বপ্ন বৃটিশেরা দিয়ে গেল যে; আজ ৭৮ বছর পরেও সে স্বপ্ন হানা দেয়; ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স; ফেইক সুপিরিরিয়রিটির আদলে প্রকাশিত হয়।
আমার বরং স্বশিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান কৃষক ও কারিগরকে খুব ভালো লাগে। এই যে যারা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে চলেছেন। তাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিলে মৌলিক জ্ঞান লাভ করা যায়; প্রচলিত উপকথা-লোককথার মাঝে যে প্রত্ন বাংলাদেশ লুকিয়ে আছে; তার প্রজ্ঞারত্নের অনুসন্ধান পাওয়া যায়। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে; এই সোনার মানুষদের শ্রম-ঘামের উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া যাবে; তাদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া যাবে; এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকি।
জীবনের দীর্ঘ পথ হেঁটে নিজ দেশে ও অন্যান্য দেশে যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে; অনায়াস মেলামেশা সম্ভব হয়েছে; কখনও কোনো তিক্ততা উঁকি দেয়নি একটি মুহূর্তের জন্য; গল্পে গল্পে খুঁজে পেয়েছি; এদের নানা-দাদারা সেই আদ্যিকালে ফিলিম দেখে বখে যাওয়া ছেলেরা। চলচ্চিত্র দেখার নেশা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বন্ধুত্বময় সব আনন্দগাথা তৈরি করতে পারে। আমি একে বন্ধুত্বের চলচ্চিত্র সূচক বলি।



পাঠকের মন্তব্য