ফেসবুকের নানান ছবিতে যত রকমের ক্যাপশন

৯৩৫৮১ পঠিত ... ২০:৩৮, নভেম্বর ২৫, ২০১৭

ফেসবুকে ছবির বিচিত্র-বর্ণাঢ্য ক্যাপশনগুলো গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ করলে উদ্বেগে উদাস হয়ে যেতে হয়, আবেগে আপ্লুত হয়ে যেতে হয়, তাণ্ডবের তেজে হতে হয় বেহুঁশ। ক্যাপশন কী হবে— এই চিন্তায় অনেকে ছবি তোলেন না, তুললেও আপলোড না করে ফেলে রাখেন ফোল্ডারে, ঘনিষ্ঠ জনদের সাথে এ নিয়ে লিপ্ত হন একনিষ্ঠ আলাপে-বিলাপে-প্রলাপে।

ক্যাপশন খুঁজে না পেয়ে কেউ-কেউ ক্যাপশনে লেখেন 'নো ক্যাপশন' এবং কেউ-কেউ 'সব ছবির ক্যাপশন লাগে না' মর্মে ছবি প্রকাশ করেন। অনেকে 'আমি নিজেই আমার ছবির ক্যাপশন' লিখে এর সাথে চশমা-পরা স্টিকার সেঁটে দেন। কেউ বা দুই শব্দে লেখেন— আমি এমনই। রাজা চতুর্দশ লুই 'আই অ্যাম দ্য স্টেট' বা 'আমিই রাষ্ট্র' বলে যে উক্তিটি করেছেন, তার সাথে এদের সবিশেষ সাদৃশ্য আছে। এ ধরনের ক্যাপশনদাতাদেরকে পঞ্চদশ লুই, ষোড়শ লুই, সপ্তদশ লুই ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত করা যেতে পারে।

কারো-কারো ক্যাপশন হ্যাশ ট্যাগময়। একটি ছবিতে এলোমেলো একডজন শব্দের পশ্চাৎদেশে সমসংখ্যক হ্যাশ যুক্ত করে এরা হ্যাশের জীবন-যৌবনকে সমূলে শ্যাষ করে দেন। কেবল হ্যাশের সর্বনাশ করেই ক্ষান্ত হন না তারা; একই হ্যাশের ছায়াতলে বিনা স্পেসে এরা টানা তিন-চারটে শব্দ লেখেন, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা পর্যন্ত যার পাঠোদ্ধার করতে হিমশিম খাবেন বলে লোকমুখে শোনা যায়। ব্যাপক ঘোরাঘুরি, বৃষ্টিতে ভেজাভিজি, বহুদিন পর হ্যাংআউট, হারামিগুলোর সাথে মাস্তি, লাইফ ইজ বিউটিফুল, অনলি ফুচকা ইজ রিয়েল— ইত্যাকার বিবিধ শব্দমালার পশ্চাৎদেশে একটি করে হ্যাশ যুক্ত হয়ে তৈরি হয় এ ধরনের খিচুড়ি ক্যাপশন। জাকারবার্গ হ্যাশ ট্যাগের সুযোগটি চালু করেছিলেন, যাতে হ্যাশের ওপর চাপ দিলে ঐ সংক্রান্ত সব লেখা একচাপেই পাওয়া যায়। বাঙালি হ্যাশ ট্যাগকে এভাবে ছলাৎ-ছলাৎ করে বলাৎকার করে ছেড়ে দেবে জানলে জাকারবার্গ আদৌ হ্যাশ ট্যাগ চালু করতেন না।

কারো-কারো ছবির ক্যাপশন জ্ঞানের অতল আধার। সেসব ছবিতে থাকে সুগভীর প্রজ্ঞাপূর্ণ বিদেশী বাণী, যে বাণীতে লুকিয়ে থাকে না-বলা ব্যাপক তাৎপর্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য ছবির সাথে বাণীর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক থাকে না। যে মনীষীর বাণী ছবির মালিক ব্যবহার করেছেন, তার ব্যাপারে মালিকটি তেমন কিছু জানেনও না। অনেকে অন্তর্জাল থেকে ভারী-ভারী বাণী নামিয়ে মজুদ করে রাখেন হালকা ছবির সাথে সেঁটে দিয়ে ঐ ছবিকে কিঞ্চিৎ ভারী করার জন্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে মনীষীদের সাথে নিজের আধ্যাত্মিক দহরম-মহরম প্রমাণ করার জন্য। ঐ মনীষীর বাড়ি কোন মুল্লুকে— অধিকাংশ ছবিমালিক এই প্রশ্নের জবাবে আকাশপানে তাকিয়ে থাকেন।

কারো ক্যাপশন হয় চাতুর্যপূর্ণ। তারা নতুন ছবিতে 'খেয়ে-খেয়ে দিন-দিন হাতি হয়ে যাচ্ছি' ক্যাপশন দেন এবং পুরোনো ছবিতে 'ইশ, আগে কী শুকনা ছিলাম' বলে বানোয়াট আফসোস করেন। এদের গোপন লক্ষ্য থাকে, কেউ একবার 'তুমি মোটেও মোটা হচ্ছ না' কিংবা 'তুমি এখনও যথেষ্ট স্লিম আছো' বলুক। জাতিকে বিভ্রান্ত করে পরোক্ষ সান্ত্বনা আদায় করে নেওয়াই এই ক্যাপশনের উহ্য উদ্দেশ্য।

কোনো-কোনো ক্যাপশন হয়ে থাকে ক্রেডিটের ভারে ভারাক্রান্ত। এ ক্ষেত্রে একটিমাত্র ছবিতে যত জনকে ক্রেডিট দেওয়া হয়, তা গুনতে-গুনতে অাঙুলের কড়েরা ক্লান্ত হয়ে যায়। 'জীবনে প্রথমবার আজকে শাড়ি পরলাম। শাড়ি ক্রেডিট যূথী, শাড়ি পরানো ক্রেডিট বীথি, মেকআপ ক্রেডিট সিঁথি, গয়না ক্রেডিট তিথি, সানগ্লাস ক্রেডিট রথি, ক্যামেরা ক্রেডিট ইতি, ফটো ক্রেডিট প্রীতি, এডিট ক্রেডিট স্মৃতি; আর পোজ ক্রেডিট? কে আবার, পোজ ক্রেডিট গোজ টু ওয়ান অ্যান্ড অনলি মি'— এ ধরনের লোমহর্ষক ক্যাপশন এই ফেসবুকে নেহায়েত দুর্লভ নয়। 'বাদ যাবে না কোনো শিশু' নীতিতে বিশ্বাসী এই ক্রেডিটকুমারীরা, সম্ভব হলে, বাংলার ষোলো কোটি জনতার অন্তত ষোলো লক্ষ জনের নাম ছবির ক্যাপশনে উল্লেখ করতেন।

কেবল রঙে-রঙে রঙিন নয়, ঢঙে-ঢঙে ঢঙিন ক্যাপশনও এই ফেসবুকে চোখে পড়ে। ফটো ক্রেডিট দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা 'হাত মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে ভাত খাওয়া' নীতিতে বিশ্বাসী। 'ফটো ক্রেডিটের জন্য সারা দিন পেছন-পেছন ঘ্যানঘ্যান করেছিস; এই নে, মালিহা হারামি, দিলাম তোকে ফটো ক্রেডিট'— এই মর্মে মালিহাদেরকে কেউ-কেউ করুণা করেন, কিংবা 'যা আনিকা হারামি, দিলাম না তোকে ফটো ক্রেডিট; যা করতে পারিস, কর গিয়ে' মর্মে কেউ-কেউ আনিকাদেরকে থোড়াই কেয়ার করেন। মাঝখান দিয়ে বন্ধুমহলে ফালুদা হয় মালিহা-আনিকাদের মান-ইজ্জত-সম্ভ্রম।

'ফটো কে তুলে দিয়েছে, বোঝেনই তো' লিখে কেউ-কেউ গোলাপি হৃৎপিণ্ডের ইমো কিংবা লজ্জারাঙা স্টিকার সেঁটে দেন ক্যাপশনে। এ ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে ক্যাপশনদাতা সম্প্রতি প্রেমে পড়েছেন এবং তার আশেপাশে প্রেমপ্রার্থীদের ঘোরাফেরা না করাই উত্তম।

'একটুও আদা-ময়দা মাখি নাই, এডিটও করি নাই একদম, একদম র ছবি'— এই মর্মে যারা ক্যাপশন দেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সততার জন্য তাদেরকে পদক দেওয়া উচিত। কিন্তু আর কেউ না জানলেও তাদের ঈশ্বর জানেন— আটা-ময়দা না মাখলেও তারা ছানা-মাখন মেখেছেন, এডিট না করলেও ছবিটিতে তারা আলো-বাতাস বাড়িয়েছেন-কমিয়েছেন এবং ছবিটি 'র' কি না, এ ব্যাপারে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা খোদ র-ও ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা আছে।

নতুন মোবাইল ফোন কেনার পর অনেকে ভোগেন নজিরবিহীন নিম্নচাপে। তিনি যে একটি দামি ফোন কিনেছেন, ফেসবুকে এই চাঞ্চল্যকর তথ্যটি জানানোর জন্য তিনি আঁটতে থাকেন বিবিধ কৌশল। কোনো কৌশল আবিষ্কার করতে না পেরে শেষতক একটি সেলফি তুলে তারা 'ফটো ক্রেডিট গোজ টু মাই নিউ গ্যাজেট আইফোন সেভেন' লিখে ক্যাপশন দেন এবং এই ঘটনা ঘটাবার পর তাদের নিম্নচাপ ক্রমশ হ্রাস পেয়ে পরিস্থিতি শান্ত হয়, তার দামি ফোন খরিদের খবর জেনে জাতি ধন্য হয়।

ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের নতুন কর্মী বা মাঝারি গোছের নেতারা দিবা-নিশি মত্ত থাকে ভাইবন্দনায়। এই কলিযুগে 'ভাই' কোনো সম্পর্কের নাম নয়, এদের কাছে 'ভাই' একটি পদবির নাম। ধারে-কাছে ঘেঁষতে না পেরে দূর থেকে ভাইয়ের শরীরের অগ্রদেশের বা পশ্চাৎদেশের অংশবিশেষের সাথে সিকি ডজন বেঢপ স্বালোকচিত্র তুলে তৎক্ষণাৎ আপলোড করে এরা ক্যাপশন দেয় 'ভাইয়ের সাথে সেলফি' কিংবা 'ভাই আমার ভাই' এবং রাতদুপুরে ভাইয়ের একটি একক ছবি আপলোড করে ভাইকে ট্যাগ করে তারা ক্যাপশনে শুধু 'ভাই' শব্দটি লেখে। এক শব্দের এই ক্যাপশনে যে কত ব্যারেল তেল লুকিয়ে থাকে, তা আমেরিকা জানতে পারলে বাংলাদেশের ওপর মার্কিন হামলা অনিবার্য।

ছবি তোলার জন্য আমাদের আয়োজন ব্যাপক, বর্ণাঢ্য, বেশুমার। ছবি তোলার স্থান-কাল, পোশাক-পরিচ্ছদ; ছবির ক্রেডিট-এডিট, ফটোশপ-রেজোলিউশন, লাইকের সম্ভাব্য পরিমাণ ইত্যাদির ব্যাপারেও সর্বাঙ্গীন সতর্কতার অন্ত নেই কারো। যে ব্যাপারে জনগণ একেবারই আলাভোলা-অবুঝ-মাসুম, সেটি বানান। অতি সুদর্শন শিক্ষিতজনও ক্ষুদ্র একটি ক্যাপশনে এতগুলো বানানভুল করেন যে, তা দেখে ঈশ্বরকে বলতে ইচ্ছে করে— এই লোকটি শুধু ছবিই দিক, কখনও সে মুখ না খুলুক, কখনও আঙুল না চালাক ফোনের অসহায় অবলা কিবোর্ডে।

৯৩৫৮১ পঠিত ... ২০:৩৮, নভেম্বর ২৫, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top