হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : প্রথম পর্ব

৪৮০৪ পঠিত ... ১৭:০৬, মার্চ ৩১, ২০২০

অলংকরণ: তাইসির

মাজেদা খালার চিৎকার চেঁচামেচি কদিন ধরে মাত্রার বাইরে গেছে।

মাত্র তিনি আমার পেছন দিয়ে হিমালয় 'হান্দাইয়া দেয়া' উচিত বলে মত পোষণ করেছেন।
ঘটনা কিছু না। ঘটনা অতি সামান্য।
খালি পায়ে শহরের মোটামুটি অর্ধেক হেঁটে এসে আমি কলিংবেল চেপে মাজেদা খালার বাসার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। মাজেদা খালা আমাকে দেখেই খেই খেই করে উঠলেন, 'হিমু, তোকে না মানা করেছি খালি পায়ে তো দূরে থাক, তোর বাইরে হাঁটাহাটিই বন্ধ।'
: কেন খালা?
: কেন মানে? হারামজাদা, দেখছিস না করোনার ভয়ে কেউ ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না!
আমি খুবই স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলাম, 'করোনা?? তো?? মরো না!'
এই শুনে মাজেদা খালা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছেন। এবং আমার স্পর্ধা দিন দিন হিমালয়ের সমান হয়ে যাচ্ছে এবং সেই হিমালয় আমার পেছন দিয়ে 'হান্দাইয়া
দেয়া' উচিত বলে মত প্রকাশ করেছেন!
মাজেদা খালার ভাষার বিরাট অবনতি হয়েছে গত মাসখানেক ধরে। এর জন্য বাসায় নতুন আসা কাজের মেয়ে জমিলার প্রভাব আছে বলে আমার বিশ্বাস।
জমিলা কথায় কথায় বিশ্রী গালাগাল করে, সেটা আমি খেয়াল করেছি। সেদিন দেখলাম বাসার নিচের গেটের দারোয়ান খালেক চাচা জমিলাকে বাজারের ব্যাগ হাতে আসতে দেখে রসিকতা করে বলছেন, 'কি জমিলা, ইলিশ মাছের অর্ধেক তো তোমার বাজারের ব্যাগের বাইরে দেখন যায়।' জমিলা খালেক চাচা এবং আমাকে দুজনকেই অবাক করিয়ে দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক একটা বিষয় এনে উত্তর করলো, 'দেখন গেলে সমস্যা কি বুড়া মেয়া। ইলিশ মাছের কি নুনু আছে যে লজ্জা পাইবো।'

কি একটা অবস্থা। অবশ্য এই উত্তরের কারণে জমিলাকে আমি মনে মনে দশে দশ দিয়েছি। হিমুদের অবাক করতে পারা কম বিষয় নয়। জমিলা পেরেছে।

আমি গত বিশ দিন ধরে মাজেদা খালার বাসায় আশ্রয় নিয়ে আছি। দেশবাসী কোয়ারেন্টাইনে ঢোকার অনেক আগেই আমি কোয়ারেন্টাইনে ঢুকে গেছি। সেটা অবশ্য ভাইরাসের ভয়ে নয়। বাদলের ভয়ে। আমার খালাতো ভাই বাদল একই সাথে মহা জিনিয়াস এবং মহা উৎসাহী। তার ধারণা, আমি মহাপুরুষ। গত ডিসেম্বর থেকে সে আমাকে ঠেলছে, দেশে করোনা পরিস্থিতি আসবে এবং এই পরিস্থিতিতে কিছু করা উচিত। বাদলের মনে হয়, আমিই পারি তাকে সঠিক পথ দিতে।

আমি একটা পথ দেখিয়েছিলাম। শৈল্পিক পথ। সেটার ফল যা হয়েছে তা এক কথায় 'ভয়ানক টু দি পাওয়ার ইনিফিনিটি'।

বাদল তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু গাধা প্রকৃতির বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা গান লিখেছে এবং অদ্ভুত সুর করে সেটা ইন্টারনেট দুনিয়ায় দিয়েছে। গানের নাম, 'আহ করোনা উহ করোনা'। লিরিক্সটা এমন 'আহ করোনা উহ করোনা, মোদের পাবে না মোদের পাবে না!' এই গান আবার ভাইরালও হয়ে গেছে।

ঘটনা এই অবধি শেষ হলে কথা ছিল। বাদল এই গান পারিবারিক সচেতনতার অংশ হিসেবে সকালে উঠে ছাড়ে এবং পরিবারের সবাইকে দেখতে বাধ্য করে, ইনক্লুডিং জমিলা। আমি বেঁচে যাই মহাপুরুষ কোটায়।

ওদিকে জমিলাকে স্পষ্ট বলতে শুনেছি 'সব গুলা খা***র পোলা'... ঈষৎ বিরক্ত হয়ে খালু ধমক দিয়েছেন 'আহ জমিলা, মুখ খারাপ করবে না'।
খালা-খালু সন্তানের স্নেহে অন্ধ হয়ে এই ভিডিও দেখেছেন ঠিকই এবং দেখতে গিয়ে শকড হয়েছেন।

আজ সন্ধ্যায় বাসার রুফটপে খালু আমাকে ডেকেছেন শুনেই বুঝে গিয়েছিলাম আজকের টপিক 'আহ করোনা উহ করোনা।'
সন্ধ্যার পরে, যাকে বলে বাদ মাগরিব, ছাদে গিয়ে দেখলাম খালু একটা বালতির মাঝে বসে চুরুট খাচ্ছেন এবং বালতি ভর্তি বাদামী একধরনের তরল পদার্থ। খালুর ডান হাতে আরেকটা পেগ ধরা।

: খালু, স্লামালিকুম।
: ইয়াং ম্যান, আসো আসো। (খালুর গলা অত্যন্ত ভারি)
: খালু, আপনি এটা কিসের মধ্যে বসে আছেন?
: এলকোহল ইয়াং ম্যান৷ এলকোহল।
: মানে!?
: তুমি কিছু ক্ষেত্রে চালাক হিমু। সে কারণে আমি তোমার পরামর্শ নেই। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তুমি খুব বোকা।
: কেন খালু?
: এলকোহল হচ্ছে করোনার যম ইয়াং ম্যান। পুরো এক বোতল শিভাস রিগ্যাল তাই বালতিতে ঢেলে দিয়েছি। দিয়ে এই যে বসে পড়েছি। করোনা যাবে কোথায়!

আমি অত্যন্ত অবাক হলাম। খালুর আজ বেশ চড়ে গিয়েছে। কিন্তু এই কথা তাকে এখন বলা যাবে না।
: ইয়াং ম্যান।
: জ্বি খালু।
: তুমি কি বাদল ও তার বন্ধুদের 'আহ করোনা, উহ করোনা' গানটা শুনেছো?
: জ্বি খালু।
: এখন তুমি বলো, এমন একটা গাধার বাচ্চা আমি কিভাবে জন্ম দিলাম! দেশের এত বড় একটা বিপদ আর এই মুহূর্তে ও একটা গান লিখলো আহ করোনা, উহ করোনা!
: জ্বি। খুব খারাপ করেছে।
: অবশ্যই খুব খারাপ করেছে। তুমি ওকে বলবে। গাধা প্রকৃতির ছেলে। এখনো ওর বিয়ে দেইনি। আহ করোনা, উহ করোনার ও কি বুঝবে।
: আমি বুঝিয়ে বলবো খালু।
: ঘটনা আরো আছে...
: কী খালু?
(ঘটনা আর কি আছে আমি জানি, যে ঘটনা খালু বলবেন সেটা আমার পরামর্শেই হয়েছে। মাজেদা খালার বাসায় দুটি বেড়াল। আমি বাদলকে বলেছি একটার নাম যেনো রাখে 'আহ করোনা', আরেকটা বেড়ালের নাম 'উহ করোনা'। এই কাজ বাদলে সানন্দে করেছে এবং করোনা সচেতনতার অংশ হিসেবে তাদের এলাকায় এটা ঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করেছে। ফলাফল হয়েছে করুণ। প্রায়ই মেয়েলি স্বরে কারা যেন মাজেদা খালাদের এই দোতলা বাসার বারান্দার দিকে ডাক দেয় 'আহ করোনা', আরেকদল বলে, 'না না, উহহহ করোনা'.. এই উহ করোনাটা আবার দীর্ঘায়িত স্বরে হয়। খালু এই কাহিনীই বলা শুরু করলেন)...

: বেড়াল দুটোর নামও রেখেছে আহ করোনা, উহ করোনা...
এই বলে খালু পুরো ঘটনার ফিরিস্তি দিলেন।
: খুব লজ্জার কথা খালু। সংকটেরও বটে, আপনি আর মাজেদা খালা চাইলেও তো এই বয়সে আহ উহ করতে পারবেন না...

বলেই বুঝলাম একটা বিস্ফোরণ হবে। বিস্ফোরণ হল না। ঢুলু ঢুলু ভাবে আড়চোখে খালু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
: তুমি বেশ ফানি হিমু। কিন্তু ছেলে ভালো। I like you!... কিন্তু তোমার খালা বেশ আপসেট।

খালুর গলার 'I like you' বলার দরদ আমাকে স্পর্শ করলো। আমি তাকে আরেকটি মহান পরামর্শ দিলাম।

: খালু, আপনি এক কাজ করুন। খালা আপসেট তার ছেলের এসব কাজ নিয়ে। এখন তার মন ভালো করার দায়িত্ব আপনার। আপনাকে বোঝাতে হবে যে এই পরিবারে রেসপন্সিবল মানুষও আছে।
: কিভাবে ইয়াংম্যান? বলো হিমু বলো, say it!...

আমি খালুকে পরামর্শ দিলাম, খালু সম্মতি দিলেন। আমরা পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে বাসার ছাদ থেকে নেমে এলাম।

রাত ঠিক এগারোটা বাজতে না বাজতে আমি আমার কোয়ারেন্টাইন রুম থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম মাজেদা খালার চিৎকারে।
একপাশে খালু বিরাট অপরাধী মুখ নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। তার পাশে বাদল। তার মুখে একশো ওয়াটের বাল্বের মত উজ্জ্বল হাসি। মাজেদা খালার মুখ থমথমে। মেঘগম্ভীর গলায় মাজেদা খালা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন-

: হিমু।
: জ্বি খালা।
: তুই ছাদে গিয়েছিলি?
: জ্বি খালা।গিয়েছিলাম, জুতা পায়ে যাইনি। ভুল হয়েছে।
: তুই খালি পায়ে গেছিস না জুতা পায়ে সেটা আমি জানতে চাইনি। যেটা জানতে চাচ্ছি সেটা সত্যি করে বলবি।
: জ্বি বলবো খালা।
: বাড়ির কলের পানিতে হুইস্কির গন্ধ কেন?

আমি নিশ্চুপ..

: বাড়ির পানির ট্যাংকিতে বালতি ভর্তি মদ ঢালার পরামর্শ তোর খালুকে তুই দিয়েছিস।
: জ্বি খালা।
: কেন?
: এলকোহল একটি এন্টি করোনা জিনিস খালা। এই পবিত্র পানি এখন এই বাড়িকে রক্ষা করবে।

এই মুহূর্তে বাদল হাতে চাপড় দিয়ে উঠে বললো, 'ঠিক হিমু ভাইয়া। তুমি যদি বল এই পানি আমাদের রক্ষা করবে, তাহলে এই পানিই আমাদের রক্ষা করবে।'

মাজেদা খালার রামঝাড়ি খেয়ে বাদল থেমে গেল।

: হিমু।
: জ্বি খালা?
: তুই এক্ষন এই বাড়ি ছেড়ে বের হবি। খালি পায়েই বের হবি। এবং জীবদ্দশায় আমাকে আর তোর খালি পা আর চেহারা কোনটাই দেখাবি না।
: জ্বি।
: বারবার জ্বি জ্বি করছিস কেন? এক্ষন বের হ। আর বাদল, তুই চাইলে তুইও বের হতে পারিস। তোদের অত্যাচারে মরার চাইতে করোনায় মরবো...

খালুর মুখে একটা কথাও নেই। চুপচাপ বসে আছেন। তার মুখ দেখে এখন মনে হচ্ছে, এই লোক পাস্তুরিত তরল দুধ ছাড়া জীবনে আর কোন নেশা জাতীয় পানীয় ছুঁয়েও দেখেনি।

আমি বের হয়ে এলাম। আমার পিছে পিছে বের হয়ে এল বাদল। রাত বাজে বারোটা। আমরা দুটো মানুষ রাস্তায় চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটছি। গৃহত্যাগী চাঁদ উঠেছে আজ। নীরবতা ভেঙে দিয়ে প্রশ্ন করলো বাদল, 'আচ্ছা হিমু ভাইয়া, এই যে তুমি খালি পায়ে হাঁটো। তোমার করোনার ভয় করে না?'

সরকার দলীয় নেতার মত ভাবলাম একবার বলি, 'হিমুরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী'... তা বললাম না। আমি বললাম আমার সেই কঠিন মহাপুরুষ উক্তি,
'হিমুদের কখনো করোনা হয় না।'

(চলবে)

আরও পড়ুন: 

হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : দ্বিতীয় পর্ব

 

হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : তৃতীয় পর্ব

 

হিমু এবং কয়েকটি নীল করোনা : চতুর্থ পর্ব

৪৮০৪ পঠিত ... ১৭:০৬, মার্চ ৩১, ২০২০

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top